আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) এমন সময় ঘর থেকে বের হলেন, যে সময়ে তিনি সচরাচর বের হন না এবং এ সময় কেউ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেও আসে না। (এ মুহূর্তে) আবূবকর (রা.) এসে উপস্থিত হলেন। তিনি প্রশ্ন করেলেন, হে আবূবকর! আপনি কি মনে করে এলেন? তিনি বললেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে দেখা করতে, তাঁর বরকতময় মুখমণ্ডল দেখতে ও তাঁকে সালাম প্রদানের উদ্দেশ্যে এসেছি। এরপর ওমর (রা.)ও এসে উপস্থিত হলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রশ্ন করলেন, হে ওমর! আপনার এ সময় আসার কারণ কী? তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! ক্ষুধার তাড়নায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমিও এরূপ কিছু অনুভব করছি। এই বলে তারা আবূল হায়ছাম ইবনু আত-তায়হান আল-আনছারী (রা.)-এর বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করলেন।
আবূল হায়ছাম ছিলেন প্রচুর খেজুরগাছ ও বকরীর মালিক। তার কোনো খাদেম ছিল না। তারা তাকে বাড়িতে না পেয়ে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার (জীবন) সঙ্গী কোথায়? তিনি বললেন, তিনি আমাদের জন্য সুপেয় পানি আনতে গেছেন।
ইতোমধ্যে আবূল হায়ছাম (রা.) পানিভর্তি মশক নিয়ে ফিরে আসলেন এবং সেটা রেখেই রাসুলুল্লাহ (সা.)কে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কোরবান হোক! তারপর তিনি তাদেরকে নিয়ে তার বাগানে গেলেন এবং তাদের জন্য বিছানা বিছিয়ে দিলেন। অতঃপর খেজুরগাছ থেকে কয়েক গুচ্ছ খেজুর নামিয়ে এনে তাদের সামনে রাখলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন, আমাদের জন্য পাকা খেজুর বেছে আলাদা করে নিয়ে এলে না কেন? তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমি ভাবলাম যে, আপনারা নিজেদের ইচ্ছামতো তাজা কিংবা পাকা খেজুর বেছে খাবেন (এজন্য দু’রকম খেজুরই পেশ করলাম)।
তারা খেজুর খেয়ে সেই পানি পান করলেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, যাঁর হাতে আমার প্রাণ সেই মহান সত্তার শপথ! কিয়ামত দিবসে এসব নিয়ামত প্রসঙ্গেও তোমাদেরকে প্রশ্ন করা হবে। এই সুশীতল ছায়া, সুস্বাদু কাঁচা-পাকা খেজুর ও ঠান্ডা পানি (কতই না সুন্দর নিয়ামত)।
এরপর আবূল হায়ছাম (রা.) তাদের জন্য খাবার তৈরি করতে চলে গেলেন। নবী করীম (সা.) তাকে বলে দিলেন, কোনো অবস্থাতেই দুধেল পশু জবেহ করবে না। কাজেই তিনি নবীন একটি নর ছাগল জবেহ করলেন এবং রান্না করে তাঁদের জন্য নিয়ে এলেন। তাঁরা তা খেলেন। এ সময় নবী করীম (সা.) তাকে প্রশ্ন করলেন, তোমার কি কোনো খাদেম আছে? তিনি বললেন, না।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, যখন আমার নিকট বন্দি আসবে তখন তুমি এসো। পরে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে দু’টি গোলাম আসে। তাদের সঙ্গে তৃতীয় কোনো গোলাম ছিল না। আবূল হায়ছাম (রা.) নবী করীম (সা.)-এর কাছে গেলে তিনি তাকে বললেন, এদের মধ্যে যাকে ভালো লাগে বেছে নাও। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আপনিই আমাকে পছন্দ করে দেন। তখন নবী করীম (সা.) বললেন, ‘যার কাছে পরামর্শ চাওয়া হয় তাকে আমানতদার হতে হয়। ঠিক আছে, তুমি একেই নাও। কেননা আমি একে সালাত আদায় করতে দেখেছি।’
(এরপর তিনি বললেন) আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি তার সঙ্গে উত্তম আচরণ করার জন্য। আবূল হায়ছাম (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উপদেশ প্রসঙ্গে তার স্ত্রীর কাছে গিয়ে তাকে জানিয়ে দেন। তার স্ত্রী বললেন, একে মুক্ত করা ব্যতীত আপনি নবী করীম (সা.)-এর বক্তব্যের মর্ম পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবেন না। তিনি বললেন, ঠিক আছে, সে এখন মুক্ত।
নবী করীম (সা.) বললেন, আল্লাহ তায়ালা যত নবী ও খলিফা প্রেরণ করেছেন, তাদের সবাইকেই দু’জন করে একান্ত পরামর্শক দিয়েছেন। একজন সাথি তো তাকে ভালো কাজের আদেশ দিতে থাকে এবং অন্যায় কাজে প্রতিহত করে। আর অন্যজন তাকে ধ্বংস করার কোনো সুযোগই ছাড়ে না। যাকে এই অসৎ পরামর্শক থেকে হেফাজত করা হয়েছে তাকেই বাঁচানো হয়েছে।’ (তিরমিজি: ২৩৬৯)
ঘটনা থেকে শিক্ষা
১. রাসুল (সা.) ও তাঁর দুই সাহাবি ক্ষুধার্ত ছিলেন। তাঁরা ক্ষুধা নিবারণের জন্য শরয়ী পদ্ধতিতে চেষ্টা করেন।
২. কোনো সাথি-বন্ধুর সচ্ছল অবস্থা ও উত্তম মানসিকতার বিষয় জানা থাকলে তার বাড়িতে বিনা দাওয়াতে খাবার গ্রহণের উদ্দেশ্যে যাওয়া যায়।
৩. আল্লাহর নিয়ামত লাভ করে এবং তা ভক্ষণ করে তাঁর শুকরিয়া আদায় করা জরুরি।
৪. মেহমানদের অত্যধিক সম্মান করতে দেখলে মেজবানকে সতর্ক করতে নসিহত করা যায়, যাতে সে অতি আবেগে মূল্যবান বস্তু নষ্ট করে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
৫. উত্তম আচরণের প্রতিদান প্রদান করা যায়। যেমন রাসুল (সা.) আবূল হায়ছামকে খাদেম দিয়েছিলেন তার স্বতঃস্ফূর্ত আপ্যায়নের জন্য।
৬. প্রকৃত জ্ঞানী সেই ব্যক্তি যে দূরদর্শী লোকের কাছ থেকে পরামর্শ নেয়।
৭. সালাত আদায় করা তাক্বওয়ার পরিচায়ক। যেমন রাসুল (সা.) আবূল হায়ছামকে সালাত আদায়কারী খাদেমকে গ্রহণ করার পরামর্শ দিলেন।
৮. সফর থেকে প্রত্যাবর্তন ছাড়াও কোলাকুলি করা যায়। যেরূপ আবূল হায়ছাম রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে করলেন।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ