ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শূকরের চর্বিজাত খাবার ও প্রসাধনী নিয়ে সতর্কতা

প্রকাশনার সময়: ১৩ আগস্ট ২০২৪, ২৩:১১ | আপডেট: ১৩ আগস্ট ২০২৪, ২৩:১৩

খাদ্যসহ ব্যবহার্য সব সামগ্রীতে হালাল-হারাম যাচাই করা মুসলমান মাত্রেরই দায়িত্ব। অনেক সময় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শুধু অজ্ঞতার কারণে আমরা হারাম দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকি অথচ এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা লাভ করা এবং এসব থেকে বিরত থাকা আমাদের জন্য জরুরি। ইউরোপ, আমেরিকা, পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় শূকরের চর্বি খাদ্যদ্রব্য রান্না ও প্রসাধন-সামগ্রী তৈরির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় বাটার অয়েলের পরিবর্তে রান্নায় শূকরের চর্বি ব্যবহূত হয়ে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে রান্নার পাশাপাশি রুটি, পিজা, পিঠা, কেক, স্ন্যাক্স, সস, স্যান্ডউইচ, বার্গার, বিস্কুট, মিষ্টি ও ঝাল খাবারে শূকরের চর্বির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষণীয়। এ ছাড়া সাবান, লোশন, চকোলেট, চিপস, শ্যাম্পু, লিপস্টিক, ক্যান্ডি, শেভিং ক্রিম, অয়েন্টমেন্ট তৈরিতে শূকরের চর্বি অপরিহার্য উপাদান।

এসব খাদ্য ও কসমেটিকস সামগ্রীতে যে আঠালো পদার্থ আছে তার বৈজ্ঞানিক নাম জিলেটিন। এটি শূকরের হাড় ও পায়ের খুরের চর্বি থেকে সংগৃহীত হয়। শূকরের চর্বি সয়াবিন তেল, মারকারাইন ও ভেজিটেবল ফ্যাটের মতো স্বাস্থ্যসম্মত না হলেও খাদ্যদ্রব্য ফ্রাইংয়ের ক্ষেত্রে যে গন্ধটি বের হয় পাশ্চাত্যের ভোক্তাদের কাছে তা বেশ জনপ্রিয়। শূকরের দেহের যে কোনো অংশের ফ্যাটি টিস্যু থেকে চর্বি আহরণ করা যায়। এ চর্বির নানা গ্রেড রয়েছে। এর মধ্যে কিডনি ও মাংসপেশির আশপাশের চর্বির কদর বেশি। কিডনি থেকে প্রস্তুত চর্বির বাণিজ্যিক নাম হলো লিফ লার্ড। আল্লাহর স্পষ্ট হুকুম— ‘তুমি বলে দাও, আমার নিকট যেসব বিধান ওহি করা হয়েছে, সেখানে ভক্ষণকারীর জন্য আমি কোন খাদ্য হারাম পাইনি যা সে ভক্ষণ করে, কেবল মৃত প্রাণী, প্রবাহিত রক্ত ও শূকরের মাংস ব্যতীত।’ (সুরা আন’আম: ৬/১৪৫)

১০০ শতাংশ পশু চর্বি (সাধারণত শূকরের গোশত) থেকে তৈরি করা হয়, যা গোশত থেকে আলাদা করে রাখা হয়। বেশির ভাগ লার্ড তৈরি করা হয় রেন্ডারিং নামের একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, যেখানে শূকরের চর্বিযুক্ত অংশগুলো (যেমন পেট, কিডনি ও কাঁধ) চর্বি গলে যাওয়া পর্যন্ত ধীরে ধীরে রান্না করা হয়। তারপর এ চর্বি গোশত থেকে আলাদা করা হয়। লার্ড হলো শূকরের গলিত চর্বি, যা রান্না, বেকিং এবং গভীর ভাজাতে চর্বি হিসেবে ব্যবহূত হয়। এটির একটি ক্রিমি সাদা রং রয়েছে এবং স্বাদহীন ও গন্ধহীন বিভিন্ন ধরনের ব্র্যান্ড পাওয়া যায়।

লার্ডের তিনটি প্রধান জাত রয়েছে—

১. রেন্ডারড লার্ড হলো শূকরের গোশতের চর্বি যা গলিয়ে তারপর ফিল্টার করা হয় এবং ঠান্ডা করা হয়।

২. প্রসেসড লার্ড গলিয়ে, ফিল্টার করা হয় এবং তারপর হাইড্রোজেনেট করা হয় যাতে তা স্থিতিশীল থাকে।

৩. লিফ লার্ড হলো একটি বিশেষ ধরনের লার্ড যা শূকরের কিডনির চার পাশে চর্বির পাতার আকৃতির অংশ থেকে আসে। এখান থেকে সবচেয়ে পছন্দের লার্ড পাওয়া যায় বলে মনে করা হয়।

পাতার লার্ড অন্যান্য ধরনের লার্ডের চেয়ে নরম ও ক্রিমি। এটি তার মসৃণ ধারাবাহিকতার জন্য মূল্যবান এবং সাধারণত বেকিংয়ের জন্য ব্যবহূত হয়। পাতার চর্বিটি ভিসারাল ফ্যাট থেকে তৈরি করা হয়, যা শূকরের কিডনিকে ঘিরে রাখে এবং এটিকে সর্বোচ্চ গ্রেডের লার্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বিবিসি পরিবেশিত খবরে জানা যায়, ইউক্রেনে সালু নামে একটি চকোলেট বেশ জনপ্রিয়। ভিতরে লবণাক্ত ও বাইরে মিষ্টি এসব চকোলেট তৈরি হয় শূকরের চর্বি দিয়ে। পুরো ইউরোপে হূদরোগের ক্ষেত্রে ইউক্রেনের অবস্থান শীর্ষে। অন্যান্য পশুর চেয়ে শূকরের চর্বিতে কোলেস্টেরলের মাত্রা অনেক বেশি। ১০০ মিলিগ্রাম শূকরের গোশতে কোলেস্টেরলের পরিমাণ ৯২ মিলিগ্রাম।

শূকরের গোশত পরজীবী ভাইরাস বহন করে। শূকরভোজীরা সব সময় গুরুতর শারীরিক ঝুঁকিতে থাকে। ১৯৪৩ সালে আমেরিকান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের বিশেষজ্ঞরা এক প্রতিবেদনে অভিমত প্রকাশ করেন, আমেরিকায় প্রতি ছয় জনে একজন ট্রাইচিনোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে উন্মাদ হয়ে পড়ে।

পাশ্চাত্যের বহু দেশে বাণিজ্যিকভাবে শূকর উৎপাদিত হয়। শূকর উৎপাদন ও বিপণন আয়ের বড় উৎস। ফ্রান্সে ৪২ হাজার ও আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনায় এক লাখ শূকরের খামার রয়েছে। পৃথিবীর ১০টি দেশ অধিক হারে শূকর উৎপাদন করে এবং শূকরের গোশত থেকে চর্বি তৈরি করে। এর মধ্যে চীন, জার্মানি ও ব্রাজিল শীর্ষে। আমেরিকায় দৈনিক খাবারের তালিকায় শূকরের গোশত অপরিহার্য অনুষঙ্গ। ৭৫ ভাগ শূকর গোশত খাওয়ায় ব্যবহূত হয় আর বাকি ২৫ ভাগ শূকরের গোশত আগুনে গলিয়ে চর্বি বের করা হয়। টিনজাত করা শূকরের চর্বি লার্ড বাজারে সহজলভ্য। সিলভার লিফ ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত শূকরের চর্বি ব্রিটেনে বেশ জনপ্রিয়। ব্রিটেনে দেখা যায়, বাবা ও দুই ছেলের ছবিসহ দেয়ালে সাঁটানো একটি পোস্টারে লেখা আছে, তারা সুখী যেহেতু তারা শূকরের চর্বি খায়।

ইউরোপীয় দেশগুলোতে বাজারজাতকৃত যে কোনো খাদ্যদ্রব্য ও প্রসাধন সামগ্রীর প্যাকেটে প্রস্তুতকরণের মূল উপাদান উল্লেখ থাকা বাধ্যতামূলক। এটি রাষ্ট্রের স্বীকৃত আইন। শূকরের চর্বি দিয়ে আগে যেসব সামগ্রী তৈরি হতো তাতে চরম ফ্যাট লেখা থাকত। এতে ইউরোপীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ভোক্তাদের কোনো অসুবিধা হতো না। কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানির প্রস্তুতকৃত এসব সামগ্রী যখন মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতে থাকে, চরম ফ্যাট (শূকরের চর্বি) লেখা থাকায় মুসলমান ও নিরামিষভোজীরা এসব সামগ্রী ব্যবহার থেকে বিরত থাকেন। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে তাদের বৈদেশিক বাণিজ্য ৭৫ ভাগ হ্রাস পায়।

ইসলামে শূকরের গোশত ও চর্বি খাওয়া হারাম। বহুজাতিক কোম্পানি তাদের দেশের খাদ্য প্রশাসন বিভাগের সহায়তায় ব্যবসায়িক স্বার্থে উপাদানের ক্ষেত্রে সরাসরি চরম ফ্যাট না লিখে ইদানিং ‘ই-কোড’ ব্যবহার করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মেডিকেল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডা. আমজাদ আলী খান জানিয়েছেন, যেসব পণ্যের প্যাকেটে নিম্নলিখিত ‘ই-কোডস’ লেখা থাকবে নিঃসন্দেহে সেখানে শূকরের চর্বি থাকবে। খাদ্য ও প্রসাধন সামগ্রী কেনার সময় ভালোভাবে যাচাই করে নিতে হবে। তাহলেই আমরা হারাম থেকে বাঁচতে পারব।

পবিত্র কোরআনের সুরা বাক্বারা ১৭৩, সুরা মায়েদা ৩, সুরা আন’আম ১৪৫ ও সুরা নাহল ১১৫ নম্বর আয়াতে শূকরের গোশত হারাম হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, শূকর যেসব ব্যাকটেরিয়াল, ভাইরাল ও প্যারাসাইটিক রোগে আক্রান্ত হয় এর প্রায় সবগুলোই মানবদেহে অতি সহজেই সংক্রমিত হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা করার পরও সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা সম্ভব হয় না। ফলে এগুলোর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের কারণে মানবদেহের মারাত্মক ক্ষতি হয়। বিশেষ করে পর্ক টেপ ওয়ার্মে আক্রান্ত হলে সিস্টিসারকোসিস রোগ হয় এবং এগুলো মানুষের হূদপিণ্ড, স্পাইনাল-কর্ড ও মস্তিষ্কে পৌঁছে ক্ষতিসাধন করে। মস্তিষ্ক আক্রান্ত হলে তাকে নিউরো সিস্টিসারকোসিস বলে।

পশ্চিমা দেশগুলোর বহু রেস্তোরাঁয় অনেক গ্রাহকের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত খাদ্য তালিকাগত বিধিনিষেধের কারণে রান্নাঘরে লার্ডের ব্যবহার বাদ দিয়েছিল। বিকল্প লার্ডের জন্য গরুর গোশতের টালোর দিকে ধাবিত হয়। সম্প্রতি শূকরের লার্ড আবার যুক্তরাজ্যে ঐতিহ্যবাহী ব্রিটিশ খাবারের অনুরাগীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ২০০৪ সালের শেষের দিকে দেশকে লার্ড সংকটের দিকে পরিচালিত করে।

পবিত্র কোরআনের খ্যাতনামা ইংরেজি অনুবাদক ও ভাষ্যকার আল্লামা আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলী (রহ.) সুরা বাক্বারার ১৭৩ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘শূকরের বসবাস মূলত আবর্জনাপূর্ণ স্থানে এবং ময়লা তার খাবার। যদি কোনো শূকরকে পরিচ্ছন্ন জায়গায় রেখে কৃত্রিম খাদ্য খাওয়ানো হয় তাহলেও তার স্বভাব ও প্রকৃতি বদলায় না।’ তিনি মন্তব্য করেন, ‘শূকর অন্য দিক দিয়েও নোংরা প্রাণী এবং নোংরা প্রাণীর গোশত খাদ্য হিসেবে গ্রহণকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাংসপেশি গঠনের যেসব উপাদান রয়েছে তার মধ্যে শূকরের মাংসে চর্বির পরিমাণ অধিক। অন্যান্য প্রাণীর মাংসের চেয়ে শূকরের মাংসপেশির টিস্যুতে চুলের মতো ক্ষুদ্র ট্রাইচিনোসিস বহনকারী ভাইরাস থাকায় অধিক হারে রোগ ছড়াতে পারে।

সাইয়েদ কুতুব (রহ.) এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এখন শূকরের গোশত সম্পর্কে কিছু সংখ্যক উগ্রমস্তিষ্ক লোক বিতর্ক তুলেছে যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে বন্যশূকর, গৃহপালিত শূকর নয়, অথচ যে কোনো সুস্থ প্রকৃতির মানুষ, সুরুচিসম্পন্ন যে কোনো ব্যক্তি মনে করে শূকর একটি ঘৃণ্য প্রাণী। এর সঙ্গে এটাও বাস্তব সত্য যে, বহু শতাব্দী পূর্ব থেকে আল্লাহ শূকরের গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে রেখেছেন।

স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের জ্ঞান গবেষণায় অতি সাম্প্রতিককালে ধরা পড়েছে যে, শূকরের গোশত, তার রক্ত ও নাড়ি ভুঁড়ির মধ্যে একপ্রকার মারাত্মক ফিতাকৃমি ও তার অসংখ্য ডিম বিদ্যমান থাকে, যা মানুষের জন্য ধ্বংসাত্মক। কিন্তু এখন একদল লোক বলছে, আধুনিক রান্না পদ্ধতিতে যে উন্নতি হয়েছে সেই প্রক্রিয়ায় ওইগুলো রান্না করলে ওইসব কৃমি তার ডিম আর ক্ষতিকর থাকে না, তাপমাত্রার একপর্যায়ে এসে ওইগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। এসব কথা বলার সময় একটি কথা তারা ভুলে যায় যে, ক্ষতিকর যে একটি জিনিস এতকাল পরে তাদের জ্ঞান গবেষণায় ধরা পড়েছে তা দূর করার জন্য না হয় তারা একটি পদ্ধতি বের করল, কিন্তু অনাগত ভবিষ্যতে আরো যে অনেক ক্ষতিকর উপাদান আবিষ্কৃত হবে তা তারা কি করে অস্বীকার করবে’? (তাফসীর ফি যিলালিল কুরআন, সুরা বাক্বারা ১৭৩, ২/৮৩)

ওহিভিত্তিক ধর্মে শূকরের গোশত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ মূসা (আ.) এবং তার অনুসারীদের শূকর খেতে নিষেধ করেছেন। কারণ যদিও এটির বিভক্ত খুর আছে এবং জাবর কাটতে পারে না। তাদের গোশত তোমরা খাবে না এবং তাদের মৃতদেহ স্পর্শ করবে না; তারা তোমাদের কাছে অপবিত্র। সেই বার্তাটি পরবর্তীতে ডিউটারোনমিতে জোরদার করা হয়েছে। রোমান আমলে, শূকরের গোশত খাওয়া থেকে ইহুদিদের বিরত থাকা ইহুদি ধর্মের সবচেয়ে শনাক্তযোগ্য বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে বিশ্বাসের বাইরের লোকদের কাছে। খ্রিস্টানরা শূকরের গোশত খেতে পারে না। কারণ একটি শাস্ত্রীয় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অথচ পরিতাপের বিষয় হলো, দুনিয়াব্যাপী ইহুদি ও খ্রিস্টানদের খাদ্য তালিকায় সবচেয়ে উপাদেয় খাবার হলো শূকরের গোশত ও চর্বি।

লেখক: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ