ঢাকা, শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

জুলুম থেকে সাবধান

প্রকাশনার সময়: ০৯ আগস্ট ২০২৪, ০৯:১৬

কোনো উ উপলক্ষ বা মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়ার পর একজন বুদ্ধিমান মানুষের উচিত সেখান থেকে অর্জিত শিক্ষা বা জ্ঞানকে পরবর্তী জীবনের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করা এবং তা জীবনে প্রয়োগ করা। সদ্য বিদায় নেয়া আশুরার ঘটনাকে যদি কোরআনের বর্ণনানুযায়ী এক কথায় সংজ্ঞায়িত করি, তাহলে বলতে হয় সেটা ছিল মজলুমের বিজয় আর জালিমের পতনের দিবস। আশুরা আমাদের মাঝে আসে আর যায় কিন্তু আমরা তা থেকে শিক্ষা নিই না। নিজেদের জীবনের সঙ্গে মেলাই না। যদি মেলাতাম তাহলে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্বের স্ব স্ব পদে বহাল ফেরাউন চরিত্রের সবাই তা থেকে শিক্ষা নিত। কিন্তু ‘ইতিহাসের বড় শিক্ষা ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।’

প্রশ্ন আসে আশুরা এসেছিল মুসা (আ.)-এর বিজয় নিশ্চিত করতে আর জালিম ফেরাউনের পতন ঘটাতে। কিন্তু এখন তো আমরা ফেরাউন চরিত্রের কাউকে পানিতে ডুবে মরতে দেখি না? আমাদের দয়ার নবী (সা.) আল্লাহর কাছে সুপারিশ করেছিলেন, পাপের কারণে পূর্ববর্তী জাতিকে যেমন সমূলে ধ্বংস করেছেন। তেমন করে পাপের কারণে আমার উম্মতকে আপনি ধ্বংস করেন না। কারণ মানুষের চরিত্রই এমন যে ঘুরে ঘুরে সে পাপ করবে আর বিভিন্ন ধরনের জুলুমে লিপ্ত হবে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার সামনে জাহান্নাম পেশ করা হলো। সেখানে আমি বিড়ালকে শাস্তি দেয়ার কারণে বনি ইসরাইলের এক নারীকে শাস্তি পেতে দেখলাম। সে নারী বিড়ালটির খাবারের ব্যবস্থা নিজে করেনি এবং তাকে ছেড়েও দেয়নি, যাতে সে নিজের খাবার নিজে সংগ্রহ করতে পারে। বিড়ালটিকে বেঁধে রেখেছিল। (মুসলিম)

একটা অবলা প্রাণীকে আটকে মারার কারণে যদি এত ভয়ানক শাস্তি হয়, তাহলে সৃষ্টির সেরা মাখলুক মানুষের হক নষ্ট করলে, অধিকার হরণ করলে, তাদের প্রতি জুলুম করলে কেমন শাস্তি হতে পারে? মানব হত্যা করলে কী পরিণতি হতে পারে?

পুরো কোরআন জুড়ে আল্লাহ তায়ালা প্রায় ৭০ জায়গায় ‘জলিমুন’ শব্দটি উল্লেখ করেছেন। জুলুম এমন ভয়নক গুনাহ যার শাস্তির ব্যাপারে কোরআন-হাদিসে বারবার সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে। তারপরও আমরা কেউ জুলুম করছি, আর কেউ জুলুমের শিকার হচ্ছি। আমাদের এ ধরনের বড় দুর্ভোগের কারণ হলো আমরা কোরআন ছেড়ে দিয়েছি। কোরআন যদি আমরা বুঝতাম তাহলে জালিম জুলুম করতে পারত না আর মজলুম জুলুম করার সুযোগ দিত না। জালিম এজন্য জালিম যে সে অন্যের ওপর জুলুম করে। অপরদিকে মজলুম এজন্য জালিম যে তার নীরবতার কারণে জালিম তার কাঁধে বসে তার ওপর জুলুম করে।

রাসুল (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের মাঠে আল্লাহ তায়ালা ছয় শ্রেণির মানুষকে বিনা হিসেবে জান্নাত দান করবেন। তাদের প্রথম শ্রেণি হলো ন্যায়পরায়ণ বাদশা বা শাসক। আবার এর বিপরীতে ছয় শ্রেণির লোককে বিনা হিসেবে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তার মধ্যে প্রথম শ্রেণি হলো জালিম বাদশা বা শাসক। (আল হাদিস, সংক্ষিপ্ত)

আশুরার আরো একটি মর্মান্তিক, বেদনাদায়ক, কলিজা বিদীর্ণ করার মতো ঘটনা। নবী (সা.) এর কলিজার টুকরো— যার কপালে, গালে, চোখে, মুখে পবিত্র মুখের চুমুর স্পর্শ বিদ্যমান। নবী (সা.)-এর দৌহিত্র বেহেশতের যুবকদের সর্দার হুসাইন (রা.)কে নির্মমভাবে শহীদ করা হয়, ইরাকের কুফায় ঐতিহাসিক কারবালার ময়দানে। মুসা (আ.)-এর ঘটনা ঘটেছিল রাসুল (সা.)-এর আগমনের আগে আর হুসাইন (রা.) শহীদের ঘটনা ঘটেছিল রাসুল (সা.)-এর মৃত্যুর ৫০ বছর পর। কিন্তু ঘটনা দুটোর পটভূমি একই। মুসা (আ.)-এর ঘটনায় যেমন জালিমের পতনের ইতিহাস রচিত হয়েছিল তেমনি হুসাইন (রা.)-এর শহীদের ঘটনাতেও জালিমের পরাজয়ের পটভূমি রচিত হয়েছে।

ওইখানে মুসা (আ.) জালিম ফেরাউনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। এখানেও হুসাইন (রা.) জালিমকে রুখতেই মদিনা থেকে কুফায় গিয়েছিলেন। তৎকালীন সময় কুফায় মুয়াবিয়া (রা.)-এর সন্তান, যোগ্য পিতার কুলাঙ্গার সন্তান এজিদ, খলিফার মতো পবিত্র পদে বসে সেখানে জুলুমের রাজত্ব কায়েম করেন। তখন সেখানকার মুক্তিকামী মানুষগুলো, কুফাবাসীরা হুসাইন (রা.)কে প্রায় তিন হাজার চিঠি পাঠান। তারা বলেন, আপনি কুফায় আসুন। আপনি এখানে ইনসাফ কায়েম করুন। আমরা আপনার সঙ্গে থাকব। আপনার হাতে বায়াত হয়ে আমরা আলাদা রাষ্ট্র গঠন করে রাসুল (সা.)-এর দেখানো পন্থায় জীবন পরিচালিত করব।

তিনি পরামর্শ করলেন, ইস্তেখারা করলেন। সব কিছুর পরে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আমার সেখানে যাওয়া দরকার। নবী (সা.) এসেছিলেন ইনসাফ কায়েম করতে। পরবর্তীতে খলিফারাও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাদের অনুসারী হয়ে, উত্তরসূরি হয়ে কিভাবে আমি জুলুমকে প্রশ্রয় দেব। অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ সাহাবি (রা.) তাকে নিষেধ করেছিলেন। ইবনে ওমর (রা.) বলেছিলেন, ‘কুফাবাসীরা পল্টিবাজ প্রকৃতির। এমনও তো হতে পারে আপনি যাওয়ার আগেই তারা তাদের মতো পরিবর্তন করে ফেলবে।’

হয়েছিলও তাই! তারপরও হুসাইন (রা.) তার নিজের মতকে প্রাধান্য দিলেন এবং কুফায় যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। তাই স্বশরীরে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য হুসাইন (রা.) তার চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকিলকে পাঠালেন। তিনি সেখানে যাওয়া মাত্রই তার হাতে বায়াত হতে শুরু করে কুফাবাসীরা। মুসলিম বিন আকিল এ আগ্রহ দেখে হুসাইন (রা.)কে পত্র লিখলেন। তারা আপনার আগমনের অপেক্ষায়। তারা আপনাকে খলিফা বানাতে প্রস্তুত। তারা আপনার হাতে বায়াত হতে আগ্রহী। এমন বার্তা দিয়ে একজন অশ্বারোহীকে পাঠালেন। মুসলিম বিন আকিলের পত্রের মাধ্যমে কুফাবাসীর আগ্রহের সত্যতা পেয়ে তিনি রওনা হলেন। যদিও প্রবীণ অনেক সাহাবি (রা.) তাকে নিষেধ করেছিলেন। এটা একটি ইস্তহাদি বিষয় ছিল। ইস্তিহাদ সফল হলে দ্বিগুণ সওয়াব আর ভুল হলেও একটি সওয়াব, কিন্তু গুনাহ নেই।

হুসাইন (রা.) রওনা হলেন। পথিমধ্যে হঠাৎ তাঁর কাছে খবর এলো, এজিদের হুকুমে তার নিয়োগকৃত গভর্নর ওবায়দুল্লাহ, মুসলিম বিন আকিলকে বন্দি করেছে। আর তাকে বন্দি হতে দেখে তার হাতে যারা বায়াত নিয়েছিল তারা সবাই পালিয়ে গেছে। যেমন করে ৫ মে শাপলা চত্বরে সাউন্ড গ্রেনেড মারার সঙ্গে সঙ্গে আধা ঘণ্টায় মাঠ ফাঁকা হয়েছিল। কুফাবাসীর ওই চরিত্র আমাদের মধ্যে এখনো বিদ্যমান। তাই তো জালিমরা আমাদের ওপর জুলুম করতে সুযোগ পায়।

হুসাইন (রা.)কে মাঝপথে বাধা দেয়া হলো, বারণ করা হলো। আপনার ওখানে যাওয়ার দরকার নেই। তিনি বললেন, আমি বের হয়ে গেছি ফি সাবিলিল্লাহ। জিহাদে বের হওয়ার পর আর পেছনে ফেরার সুযোগ নেই। যা হবে তা জীবন দিয়ে হলেও মোকাবিলা করব। কুফায় পৌঁছার পর শুরু হলো অসম এক লড়াই। লম্বা ঘটনা সংক্ষেপ করছি।

পরিশেষে তাঁকে চারিদিক থেকে যখন ঘিরে ফেলল, তখন হুসাইন (রা.) তাদের কাছে প্রস্তাব রাখলেন— ১. আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও আমি এ রাজ্য ছেড়ে সীমান্তের কোনো মুসলিম এলাকায় গিয়ে সারা জীবন জিহাদ করে কাটিয়ে দেব। ২. অথবা আমাকে তোমরা এজিদের কাছে যাওয়ার সুযোগ দাও আমি তার সঙ্গে দেখা করব। তো যাই হোক তাঁরা তার প্রস্তাব গ্রহণ না করে তাঁকে শহীদ করে দিল। ইতিহাসের পাতায় রচিত হলো এক মর্মান্তিক ইতিহাস। এ ঘটনার পর এজিদের ক্ষমতা খুব বেশি দীর্ঘায়িত হয়নি। অভিশপ্ত এজিদ খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে শোচনীয়ভাবে ক্ষমতাচ্যুত হন।

তো আশুরার দুটো ঘটনার বার্তা একই জালিমের পরাজয় সুনিশ্চিত। তার পরাজয় হবেই দু’দিন আগে অথবা পরে। প্রিয় বন্ধু জালিম পরাজিত হবেই, জালিমের পতন হবেই। কিন্তু আমাকে আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে আমরা যেন জালিমের সহযোগী বা সমর্থনকারী না হই। হলে কী হবে? ওই ফেরাউনের সহযোগীদের মতো। সহযোগিতা করার কারণে যেমন ফেরাউনের সঙ্গে তাদেরও সলিল সমাধি রচিত হয়েছিল।

অথচ জুলুম বর্তমান পৃথিবীতে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেন সত্যটাই জুলুম আর মিথ্যাটাই এখন ইনসাফ হয়ে গেছে। তাই সত্যবাদীরা চুপ হয়ে গেছে আর মিথ্যুকরা দাপটের সঙ্গে বুক উঁচিয়ে চলে। আফসোস! যুগের ফেরাউনরা শিক্ষা নেয় না। যতক্ষণ না আল্লাহ তাদের ডুবিয়ে মারেন।

বর্তমান যুগের সিরিয়ার একজন দার্শনিক আলেম শায়েখ ড. রাতেব আন নাবলুসি বলেছেন, কোরআনে বারবার ফেরাউনের কথা আলোচনা করার কারণ গবেষণা করতে গিয়ে দেখলাম, ‘পৃথিবীর কমন চরিত্র হলো ফেরাউনের চরিত্র।’ যার কারণে তার কথা কোরআনে রিপিটেড আলোচিত হয়েছে।

ভাই, আমরা যার যার জায়গায় একেকজন ফেরাউনরূপী জালিম। জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ানোর কারণে, মুখ বুজে, চুপ করে বসে থাকার কারণে। কারণ যে জুলুম দেখেও চুপ থাকে সেও একটা জালিম ফেরাউন।

তাই আমাদের উচিত যার যার অবস্থান থেকে জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়া যেমন দাঁড়িয়েছিলেন হুসাইন (রা.)। কথা বলে হোক, লিখে হোক, জনসচেতনতা তৈরি করে হোক জুলুমের বিপক্ষে আপনাকে দাঁড়াতে হবে। জালিমকে অন্তর থেকে ঘৃণা করতে হবে। কোনো যুক্তিতেই আমরা যেন জালিমের সমর্থক বা সহায়ক না হই।

কোরআন ও হাদিসে বারংবার জুলুম থেকে সাবধান করা হয়েছে। এমনকি আল্লাহ নিজেও নিজের ওপর জুলুমকে হারাম করেছেন। হাদিসে কুদসিতে নবীজি (সা.) ঘোষণা করেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে আমার বান্দারা! আমি আমার নিজের জন্য জুলুম করা হারাম করে নিয়েছি এবং তোমাদের পরস্পরের মধ্যেও জুলুম হারাম করেছি। সুতরাং তোমরা একজন অন্যজনের ওপর জুলুম করো না।’ (মুসলিম, তিরমিজি)

পুরো কোরআনজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ জালিমদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা আলে ইমরান: ৫৭) ‘আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না।’ (সুরা বাকারা: ২৫৮) ‘জালিমদের ঠিকানা কতই না নিকৃষ্ট!’ (সুরা আলে ইমরান: ১৫১) ‘অচিরেই জালিমরা জানতে পারবে, তাদের প্রত্যাবর্তনস্থল কোথায় হবে।’ (সুরা: শুআরা, আয়াত: ২২৭) ‘আর আল্লাহ জালিমদের ব্যাপারে অধিক জ্ঞাত।’ (সুরা আনআম: ৫৮) ‘আল্লাহ মানুষের প্রতি কোনোই জুলুম করেন না; কিন্তু মানুষ তাদের নিজেদের প্রতি জুলুম করে।’ (সুরা ইউনূস: ৪৪)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে অন্যায় দেখবে সে যেন তা তার হাত দিয়ে বাধা দেয় আর যদি হাত দিয়ে বাধা না দিতে পারে তবে যেন মুখ দিয়ে বাধা দেয়, আর যদি মুখ দিয়ে বাধা না দিতে পারে তবে যেন অন্তর দিয়ে ঘৃণা করে আর এটি হলো দুর্বল ঈমানের পরিচয়।’ (মুসলিম)

আসুন ভাই আমরা তওবা করি। নিজেকে প্রশ্ন করি, আমার দায়িত্বের জায়গায় বসে আমি কারো ওপর জুলুম করেছি ও করছি কি না। নিজেকে সংশোধন করতে হবে যদি জুলুমে লিপ্ত থাকি। কারণ আমাদেরকে নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

১৯ জুলাই ২০২৪ টঙ্গীর আন-নুর জামে

মসজিদে প্রদত্ত জুমার বয়ান থেকে

অনুলিখন— মুহা. আব্দুল খালেক আশিক

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ