সত্যকে সমর্পিতচিত্তে গ্রহণ করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য। সত্যের সামনে সমর্পিত হলেই তো মুমিন ‘মুমিন’ হয়। তার অস্তিত্বই বিকশিত হয় এ স্বীকারোক্তির মাধ্যমে, মিথ্যা ও শিরক বর্জন করেছি, সত্য ও তাওহীদকে গ্রহণ করেছি। তাওহীদের কালিমা- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’রও দাবি- শিরকের মলিনতা ঝেড়ে তাওহীদের আলোয় আলোকিত হওয়া। মিথ্যা ও বাতিলকে অগ্রাহ্য করে সত্যের সামনে নতশীর হওয়া। দ্বীনি কোনো বিষয়ে যখনই সত্য উদ্ভাসিত হয়, কায়মনো বাক্যে তা গ্রহণ করা, সর্বান্তকরণে সত্যের অনুগত থাকা। এর দৃষ্টান্ত প্রচুর! ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন নবীজীর পুণ্যাত্মা সাহাবিরা। পেয়েছেনও মহান প্রভুর পক্ষ থেকে সন্তুষ্টির ঘোষণা। রাদিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া রাদু আনহু।
দুনিয়াতেই যারা জান্নাতের সুসংবাদ পেয়ে ধন্য হয়েছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) তাঁদের অন্যতম। ছিলেন ইহুদিদের ধর্মগুরু। মেধা ও প্রতিভা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় ওই মহলে তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল সর্বজনস্বীকৃত। খ্যাতি ছিল তুঙ্গস্পর্শী। তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটিও জগতজোড়া মশহুর। নব্যুয়তের সত্যাসত্য যাচাইয়ের জন্য নবীজীর খেদমতে নিবেদন করেছিলেন তিনটি প্রশ্ন। নবীজি তাঁর নবীসুলভ ঐশী জওয়াব দিয়ে পরিতৃপ্ত করে দিলেন ইবনে সালামের অনুসন্ধিৎসু হূদয়কে। ঈমানের ঢেউ খেলে গেল ইবনে সালামের হূদয়-আত্মায়। হকের পিপাসু এ ইহুদি ধর্মগুরুর আর তর সইল না। ঈমানদীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা দিয়ে দিলেন ‘আশহাদু আন্নাকা রাসুলুল্লাহ’- সাক্ষ্য দিচ্ছি, নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রাসুল। (বুখারি: ৩৩২৯; সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৪/৬৬)
হ্যাঁ, এভাবেই সত্যকে মাথা পেতে বরণ করে নিতে হয়। সত্যের সামনে নিজেকে নিঃশর্তভাবে সঁপে দেয়ার বহু ক্ষেত্র-উপলক্ষ আসে মুমিনের জীবনে। নিজের মতের ভ্রান্তি নিশ্চিত হওয়ার পর তা বর্জন করতে কুণ্ঠিত না হওয়া মুমিনের এক মহিমান্বিত গুণ, চারিত্রিক এবং আদর্শিক বৈশিষ্ট্য। দীর্ঘদিন ধরে, এমনকি জীবনভর চলে আসা পথের ভ্রষ্টতা শরিয়তের দলিলের আলোকে যখন প্রমাণিত হয়ে যায়, সব যুক্তিতর্ক, স্বার্থচিন্তা এবং মনোবাসনাকে পেছনে ঠেলে মুমিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সঠিক পথটিই বেছে নেয়। সত্যি বলতে কী, এর জন্য প্রয়োজন তাকওয়ায় উজ্জীবিত একখানা হূদয়। এবং বলতে দ্বিধা নেই, তাকওয়ার এই ধন যার হূদয়ে যত বেশি সঞ্চিত হবে, তত সহজেই সে হক এবং সত্যের সন্ধান পেয়ে যাবে। এক্ষেত্রে কোরআনের সেই অমোঘ বাণীও স্মরণ করা যেতে পারে— ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় কর, তবে তিনি তোমাদের দান করবেন (সত্য-মিথ্যার মধ্যে) পার্থক্যকারী বস্তু। তোমাদের থেকে তোমাদের গুনাহ দূর করে দেবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।’ (সুরা আনফাল: ২৯)
হক ও সত্য চিহ্নিত হয় শরিয়তের দলিলের আলোকে, বিজ্ঞ ও খোদাভীরু আলেমদের হাতে, যারা দলিলের যথাযথ বিশ্লেষণ এবং দলিলের মাধ্যমে সঠিক সমাধানের যোগ্যতা রাখেন। যদিও বিজ্ঞ আলেমদের মাঝে শরিয়তের বিভিন্ন বিষয়ে মতভিন্নতা হয়ে থাকে, কিন্তু সেটি সর্বদা দলিল নির্ভর এবং শাখাগত বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকে।
সঠিক পথে ফিরে আসা মুমিনের সহজাত গুণ। মুমিনের জন্য শোভনীয় নয়- ভুল পথে হাঁটা এবং অন্যকেও ভুলের দাওয়াত দেয়া। আমর ইবনে উবাইদ (রহ.) একজন মু’তাযিলী আলেম ছিলেন। একটি বিষয়ে মত প্রকাশ করতে গিয়ে একদিন তিনি ভুল করে ফেললেন। মজলিসে উপস্থিত ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ ওয়াসেল ইবনে আতা নামক আরেক মু’তাযিলী। তিনি তাঁর সঙ্গে একমত পোষণ না করে পাল্টা প্রশ্ন এবং তর্ক জুড়ে দিলেন। একপর্যায়ে আমর ইবনে উবাইদের কাছে ওই বিষয়ে নিজের ভুল ধরা পড়ে গেল। আর দেরি নয়; স্বভাবজাত অহমকে জয় করে সঙ্গে সঙ্গেই নিজের মতটি পরিত্যাগ করে সঠিক মতের দিকে ফিরে আসলেন এই বলে— ‘হক আর আমার মাঝে কোনো দুশমনি নেই। সভাসদকে সাক্ষী রেখে আমি ঘোষণা করছি, এ বিষয়ে আমার যে অবস্থান ছিল তা থেকে আমি সরে এসেছি এবং সঠিক অবস্থানটি গ্রহণ করছি।’ (আলমুনইয়াতু ওয়াল আমাল, ইবনুল মুরতাযা, পৃ. ৫১; রিসালাতুল মুসতারশিদীন, টিকা: শায়েখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ পৃ. ১০৯)
একজন মু’তাযিলী বিদআতি হওয়া সত্ত্বেও নিজের ভুল স্পষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এলেন ভুল থেকে। শুধু ফিরেই আসেননি; জনতার সামনে ঘোষণা দিয়ে ফিরে এসেছেন এবং সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছেন— ‘ভুল’ আঁকড়ে থাকার কোনো বিষয় নয়; ফিরে আসাটাই বাহাদুরি। হকের সঙ্গে দুশমনি আর ভুল আঁকড়ে থাকার মাঝে নিজেরই ক্ষতি। বহু ভালো হতো, তিনি যদি এতেজালের বিদআত থেকেও ফিরে আসতে পারতেন!
আরেকটি ঘটনা। উবাইদুল্লাহ ইবনুল হাসান আলআম্বরী (রহ.)। দ্বিতীয় শতাব্দীর শুরুতে জন্মগ্রহণ করেন, মৃত্যুবরণ করেন ১৬৮ হিজরিতে। তিনি ছিলেন তৎকালীন বসরার বিজ্ঞ আলেম ও ফকীহ। একসময় কাজির পদেও অধিষ্ঠিত হয়েছেন। সে কারণে লোকজনের অন্তরে ছিল তাঁর প্রতি বিশেষ এক শ্রদ্ধাবোধ। তাঁর একান্ত শিষ্য বিশিষ্ট মুহাদ্দিস আব্দুর রহমান ইবনুল মাহদী (রহ.) বর্ণনা করেন, তখন আমি ছোট। একদিন এক জানাজায় অংশগ্রহণ করলাম, উস্তাদজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ। তাঁকে একটি মাসআলা জিজ্ঞাসা করা হলো, কিন্তু তিনি ভুল বললেন। আমি বললাম, আল্লাহ আপনাকে সঠিক বিষয়ের রাহনুমা করেন, বিষয়টি মনে হয় এমন নয়, সঠিক হলো এই। ক্ষণিক মাথা নিচু করে একদম চুপ হয়ে গেলেন। তারপর মাথা তুলে বললেন, ‘বৎস! তুমিই ঠিক বলেছ। কাজেই আমি নমনীয়তার সঙ্গে আমার মত থেকে ফিরে এলাম। তারপর বললেন- ‘হক ও সত্যের একজন সাধারণ অধীনস্ত হয়ে থাকা আমার কাছে অধিক প্রিয় মিথ্যা ও বাতিলের সরদার হওয়ার চেয়ে।’ (হিলইয়াতুল আউলিয়া: ৯/৬; তাহযীবুত তাহযীব: ৭/৭)
সুবহানাল্লাহ! তাকওয়ার ধন ছাড়া এসব কীভাবে সম্ভব! এটাই মুমিনের ভূষণ এবং তাকওয়ার নিদর্শন। হক স্পষ্ট হওয়ার পর ঘৃণাভরে বাতিলকে প্রত্যাখ্যান করে হকের পানে ছুটে আসা এক ঈমানি আদর্শ। ঐক্য এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে তোলার এটি একটি কার্যকরী উপাদান। সর্বোপরি এটি ঈমানের অঙ্গও বটে।
হাজারো প্রলোভন-প্ররোচনার সামনে মুমিন যেমন টলে যায় না, তেমনি শরিয়তের দলিলের আলোকে হক প্রমাণিত হয়ে যাওয়ার পর মুমিন মাথা পেতে তা বরণ করে নিতে কোনো সংকোচবোধ করে না। হক গ্রহণে বিলম্ব করে না এবং বাতিলকে ছুড়ে ফেলতে কুণ্ঠাবোধ করে না। কারণ মুমিনের দোস্তী হকের সঙ্গে, বাতিলের সঙ্গে নয়। তার বন্ধুত্ব ও অন্তরঙ্গতা সত্যের সঙ্গে, মিথ্যার সঙ্গে নয়।
অস্বীকার করব না- ‘ভুল’ মানব জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতা। কিন্তু মুমিনের গুণ হলো ভুল থেকে ফিরে আসা। ভুলের অনুসরণে মুমিন ক্ষণিকের জন্য পথ হারিয়ে বসতে পারে; কিন্তু ভুলকেই ‘পথ’ হিসেবে গ্রহণ করে না মুমিন। ভুল আর মুমিনের সম্পর্ক হলো অজ্ঞতার। ভুলকে ‘ভুল’ হিসেবে জানার সঙ্গে সঙ্গে মুমিন তা থেকে ফিরে আসে, সমর্পিত হয় হকের সামনে। এখন এ ভুল হতে পারে নিজের বা (আল্লাহর পানাহ) তার অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের; যার হাত ধরে সে পথ চলছে।
এক্ষেত্রে মুমিন অনুসরণ করে হকের; ব্যক্তির নয়। কারণ, সে তো ব্যক্তির হাত ধরেছিল হকের অনুসরণের জন্য, হক থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য নয়। তাই এক্ষেত্রে মুমিন স্মরণ রাখে নবীজির প্রিয় ফকীহ সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর এ উপদেশ— ‘সাবধান! কেউ যেন তার ঈমান অন্যের কাঁধে ন্যস্ত না করে যে, ও ঈমান আনলে এ-ও ঈমান আনে। ও কুফরি করলে এ-ও কুফরি করে। কারণ মন্দের ক্ষেত্রে কেউ আদর্শ নয়।’ (আলই’তিসাম, শাতিবী: ২/৩৫৯)
আসুন, সালাফ ও পূর্বসূরিদের জীবনচরিত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি। হককে বরণ করি এবং হকের সঙ্গে থাকি। বাতিল ও গোমরাহি পরিহার করি। সব ভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতা বর্জনের শপথ করি। কোরআন-সুন্নাহর ধারক বাহক হক্কানী আলেম-উলামা যা কিছু বাতিল বলে চিহ্নিত করে দেন- দ্বিধা-সংকোচ ছাড়া তা বর্জন করি, হককে গ্রহণ করি। কারণ হকের সঙ্গে মুমিনের কোনো দুশমনি নেই। হকই মুমিনের পথ, হকই পাথেয়।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ