আল্লাহ তায়ালা মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে বের করে আনার জন্য রাসুুলদেরকে প্রেরণ করেছেন। সুতরাং যে তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়েছে সে হেদায়েতের আলো পেয়েছে, আর যে সাড়া দেয়নি সে-ই অজ্ঞতার অন্ধকার এবং স্বীয় নফস ও এর পূর্ণতা থেকে উদাসীনতায় নিমজ্জিত রয়ে গেছে। বস্তুত দ্বীন ও আখিরাতের বিষয়ে উদাসীনতাই হচ্ছে সব অকল্যাণের উৎস এবং অন্তরের একটি বড় ব্যাধি। এর কারণে বান্দা ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ এবং এর নিয়ামতের আস্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়। আর গাফিলতির পথ ধরেই বান্দার মাঝে ত্রুটি প্রবেশ করে।
উদাসীনতা অন্তরের সবচেয়ে বড় ব্যাধি
মহান আল্লাহ আদম সন্তানদের কাছ থেকে এ মর্মে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন যে, তিনিই তাদের রব ও একমাত্র উপাস্য; যাতে তারা উদাসীনতার ওজর পেশ করতে না পারে। আর তারা যেন গাফিলতি বা উদাসীনতাকে হুজ্জত হিসেবে পেশ করতে না পারে সেজন্য তিনি কোরআন নাজিল করেছেন এবং স্বীয় রাসুলকে গাফেল বা উদাসীনদের অন্তর্ভুক্ত হতে নিষেধ করেছেন। এ মর্মে তিনি বলেন, ‘আর আপনি উদাসীনদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না।’ (সুরা আ’রাফ: ২০৫)
তাই নবী (সা.) তা থেকে রেহাই চেয়ে দোয়া করে বলতেন, ‘হে আল্লাহ, নিশ্চয়ই আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই অক্ষমতা, অলসতা, কৃপণতা, অতি বার্ধক্য, রুঢ়তা ও উদাসীনতা থেকে।’ (সহীহ ইবনে হিব্বান)
গাফিলতির কারণে মানুষের আফসোসে পতিত হওয়ার আগেই তাদেরকে সতর্ক করতে আল্লাহ তায়ালা রাসুলদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি সংবাদ দিয়েছেন যে, তাদের জবাবদিহিতার সময় অত্যাসন্ন, যাতে তারা তাদের উদাসীনতা থেকে জাগ্রত হয়ে ওঠে। আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের হিসেব-নিকেশের সময় আসন্ন, অথচ তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে রয়েছে।’ (সুরা আল-আম্বিয়া: ০১)
তিনি তাদের নিন্দা করেছেন যারা দুনিয়ার বাহ্যিক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করে, অথচ পরকাল সম্পর্কে উদাসীন থাকে। বস্তুত যে জাতি সতর্কীকরণ ও উপদেশ প্রদান ছেড়ে দেয়, তারাই উদাসীনতায় নিমজ্জিত হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যাতে তুমি সতর্ক করতে পার এমন এক জাতিকে, যাদের পিতৃ-পুরুষদেরকে সতর্ক করা হয়নি, যার ফলে ওরা উদাসীন।’ (সুরা ইয়াসীন: ০৬)
আল্লাহ তায়ালা এও সংবাদ দিয়েছেন, অধিকাংশ মানুষই তাঁর নিদর্শনাবলী সম্পর্কে উদাসীন। গাফিলতি বা উদাসীনতার অন্যতম কারণ হলো— দুনিয়ার মোহ ও এর প্রতি আকর্ষণ এবং দুনিয়ার মুহাব্বতকে পরকালের ওপর প্রাধান্য দেয়া। জনৈক বিদ্বান বলেছেন, ‘চিন্তা-ভাবনা না করে যে দুনিয়ার দিকে তাকায়; এমন অবহেলার পরিমাণ অনুপাতে তার অন্তরের আলো নিভে যায়।’
যেভাবে উদাসীনতা পেয়ে বসে
* কোরআন তিলাওয়াত ও আল্লাহর জিকির থেকে বিমুখ থাকা উদাসীনতা ও অন্তরের মৃত্যু অবধারিত করে। নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার রবের জিকির করে আর যে জিকির করে না তাদের উদাহরণ হলো জীবিত ও মৃতের ন্যায়।’ (সহীহ বুখারি ও মুসলিম)
* অবহেলা ও অলসতাবশত একাধিক জুমা পরিত্যাগ করার পরিণতি হলো, তা উদাসীনতাকে আবশ্যক করে। আর উদাসীন বা গাফেলদের সঙ্গ গ্রহণ এ পথকে খুলে দেয়; অথচ মহান আল্লাহ তাদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে তাদের অনুসরণ করতে ও তাদের থেকে গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আর তুমি তার আনুগত্য করো না, যার হূদয়কে আমি আমার স্মরণে অমনোযোগী করে দিয়েছি।’ (সুরা আল-কাহাফ: ২৮)
* আত্ম প্রবঞ্চনায় ডুবে যাওয়ার একটি দিক হলো, ব্যক্তি কোনো ভুল করা সত্ত্বেও ইহসান পায়; ফলে সে মনে করে যে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। আবার অনেক সময় তার শারীরিক ও আর্থিক নিরাপত্তা দেখে মনে করে এতে কোনো শাস্তি নেই। সে অনুধাবন করতে পারে না যে, তার উদাসীনতায় পতিত হওয়াটাই তার জন্য একটি বড় শাস্তি।
উদাসীনতা থেকে নিরাপত্তা লাভ একটি জটিল বিষয়; অনেক সময় তা মুত্তাকী বান্দাকেও পেয়ে বসে, কিন্তু সে দ্রুতই সতর্ক হয় এবং আল্লাহকে স্মরণ করে তওবা করে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে, তাদেরকে শয়তান যখন কুমন্ত্রণা দেয় তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাদের চোখ খুলে যায়।’ (সুরা আল-আ’রাফ: ২০১)
উদাসীনতা থেকে মুক্তির আমলসমূহ
* উদাসীনতা থেকে সজাগ হওয়া কল্যাণ লাভের প্রথম চাবি; আর তা আল্লাহ ও তদীয় রাসুলের আদেশ পালনের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। উদাসীনতা থেকে সজাগ করে এমন একটি বিষয় হলো আল্লাহর কিতাবের তিলাওয়াত; আল্লাহ বলেন, ‘এগুলো মানুষের জন্য স্পষ্ট বর্ণনা এবং মুত্তাকীদের জন্য হেদায়াত ও উপদেশ।’ (সুরা আলে-ইমরান: ১৩৮)
* পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের হেফাজত করা উদাসীনতা থেকে মুক্তি দেয়। নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এ ফরজ সালাতসমূহের সংরক্ষণ করবে, তাকে গাফেল-উদাসীনদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে না।’ (সহীহ ইবনে খুযাইমা)
* অল্প কিছু পরিমাণ আয়াতের মাধ্যমে কিয়ামুল্লাইল করাও গাফিলতি থেকে মুক্তি দেয়। নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রাতের সালাতে ১০টি আয়াত তিলাওয়াত করবে, তার নাম গাফেলদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হবে না।’ (সুনানে আবু দাউদ)
* কোরআন ও সুন্নাহর হালাকাসমূহ এবং ইলমী মজলিসগুলো অন্তর থেকে গাফিলতিকে দূর করে। ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘জিকিরের মজলিসগুলো হলো ফেরেশতাদের মজলিস, পক্ষান্তরে অনর্থক গল্প ও উদাসীনতার মজলিস হলো শয়তানের মজলিস। সুতরাং একজন মানুষ যেন সেটাই চয়ন করে এ দুটোর মধ্যে যেটা তার অধিক প্রিয় ও তার জন্য অধিক উপযুক্ত। কেননা সে ওদের সঙ্গেই দুনিয়া ও আখিরাতে থাকবে।’
* উদাসীনতা বান্দা ও তার রবের মাঝে পর্দাস্বরূপ। আর আল্লাহর জিকির সে পর্দাকে দূরীভূত করে ও শয়তানকে বিতাড়িত করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আপনি আপনার রবকে নিজ মনে স্মরণ করুন সবিনয়ে, সশঙ্কচিত্তে ও অনুচ্চস্বরে, সকালে ও সন্ধ্যায়। আর উদাসীনদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না।’ (সুরা আল-আ’রাফ: ২০৫)
* যেসব সময়ে মানুষরা উদাসীন থাকে সে সময়ে ইবাদত পালন করা গাফিলতি থেকে মুক্তি দেয়; আর তওবা হলো অন্তরের পবিত্রতা ও গাফিলতি থেকে মুক্তির মাধ্যম। নবী (সা.) বলেছেন, ‘বান্দা যখন কোনো গুনাহ করে তখন তার হূদয়ে একটি কালো দাগ পড়ে। পরে যখন সে গুনাহ থেকে বিরত হয় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে ও তওবা করে তখন তার হূদয় উজ্জ্বল হয়ে যায়।’ (সুনানে তিরমিজি) অর্থাৎ তার থেকে সে কালো দাগ মিটিয়ে দেয়া হয়। আর মৃত্যু হলো নীরব উপদেশ, আর অধিক পরিমাণে মৃত্যুর স্মরণে রয়েছে অন্তরের বিশুদ্ধতা ও গাফিলতি থেকে মুক্তি।
ব্যক্তির ওপর উদাসীনতার কুফল
শয়তান বান্দার গাফিলতির অপেক্ষা করে ও তার সঙ্গে অবস্থান করতে থাকে, যতক্ষণ না এটা অন্তরকে আচ্ছাদিত করে ও অন্ধ করে দেয়। অবশেষে তার উদাসীন অন্তর শয়তানের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ থেকে গাফেল থাকে, তাকে তার দূরদৃষ্টি বিলুপ্তি করার মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হয়। ফলে সে আল্লাহ ও তাঁর আয়াতসমূহকে চিনতে পারে না এবং হক থেকে বাতিলকে পৃথক করতে পারে না।
আর যখন গাফিলতি চরম আকার ধারণ করে; তখন ওই ব্যক্তি কোনো কিছু হূদয়াঙ্গম করতে, দেখতে, শুনতে ও অনুধাবন করতে পারে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের হূদয় আছে কিন্তু তা দ্বারা তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চোখ আছে তা দ্বারা তারা দেখে না এবং তাদের কান আছে তা দ্বারা তারা শুনে না; তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো, বরং তার চেয়েও বেশি বিভ্রান্ত। তারাই হচ্ছে গাফেল।’ (সুরা আল-আ’রাফ: ১৭৯)
আর গাফিলতিই আল্লাহ কর্তৃক বান্দাকে শাস্তি প্রদান ও ধ্বংস করার কারণ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কাজেই আমি তাদের থেকে প্রতিশোধ নিয়েছি এবং তাদেরকে অতল সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছি। কারণ তারা আমার নিদর্শনকে অস্বীকার করত এবং এ সম্বন্ধে তারা ছিল গাফেল।’ (সুরা আল-আ’রাফ: ১৩৬)
আল্লাহ তায়ালা গাফেলদেরকে জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শন করেছেন, আর কিয়ামতের দিন যখন তাদের অন্তরের পর্দা খুলে যাবে, তখন তারা যা অস্বীকার করত তা স্বচক্ষে অবলোকন করবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই তুমি এদিন সম্বন্ধে উদাসীন ছিলে, অতঃপর আমি তোমার সামনে থেকে পর্দা উন্মোচন করেছি। সুতরাং আজ তোমার দৃষ্টি প্রখর।’ (সুরা ক্বফ: ২২) সেদিন তারা তাদের গাফিলতির কথা স্বীকার করবে ও অনুতপ্ত হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর অমোঘ প্রতিশ্রুত সময় নিকটবর্তী হবে, আকস্মাৎ কাফেরদের চক্ষু স্থির হয়ে যাবে, তারা বলবে, হায়, দুর্ভোগ আমাদের! আমরা তো ছিলাম এ বিষয়ে উদাসীন।’ (সুরা আল-আম্বিয়া: ৯৭) আর যখন তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে তখন তারা তাদের গাফিলতির কারণে পুনরায় অনুশোচনা প্রকাশ করবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হায়, দুর্ভোগ আমাদের! আমরা তো ছিলাম এ বিষয়ে উদাসীন; বরং আমরা তো ছিলাম জালেম।’ (সুরা আল-আম্বিয়া: ৯৭)
অতঃপর হে মুসলিমগণ! ব্যক্তি নিজে গাফেল থাকলেও তার ব্যাপারে আল্লাহ গাফেল নন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তারা যা করে সে সম্বন্ধে আপনার রব গাফেল নন।’ (সুরা আল-আনআম: ১৩২)
আর সব ক্ষতির সমন্বয়ক হলো উদাসীনতা ও প্রবৃত্তি; কেননা আল্লাহ ও পরকালের বিষয়ে উদাসীনতা কল্যাণের দ্বার রুদ্ধ করে দেয়, আর প্রবৃত্তি অকল্যাণের পথ খুলে দেয়। বান্দার অন্তর আল্লাহর পথ থেকে যত দূরে থাকে, নানা আপদ তার দিকে ততই ঘনিয়ে আসে। পক্ষান্তরে সে যতই আল্লাহর নিকটবর্তী হয়, অকল্যাণ ও আপদ তত দূরে সরে যায়। আল্লাহ থেকে দূরে থাকার কয়েকটি স্তর রয়েছে; যার একটি অপরটির চেয়ে মারাত্মক হয়ে থাকে। বস্তুত গাফিলতি থেকে উত্তরণ ছাড়া অবাধ্যতা-পাপের ফেতনা থেকে রেহাই নেই।
দ্বিতীয় খুতবা
হে মুসলমানগণ, উদাসীনতা, প্রবৃত্তি ও ক্রোধের মাধ্যমে শয়তান বান্দার মাঝে প্রবেশ করে এবং গাফিলতি ও পাপের কারণে অন্তরে জং ধরে। আর ইস্তিগফার ও জিকিরের মাধ্যমে তাতে উজ্জ্বলতা আসে। অন্তরের বিশুদ্ধতার একটি আলামত হলো— তা সর্বদা বান্দাকে আল্লাহর দিকে ধাবিত করতে থাকে, অবশেষে সে আল্লাহ অভিমুখী হয় ও তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে।
যে ব্যক্তি নিজের নফসের ব্যাপারে গাফেল থাকে; তার সময় বিনষ্ট হয় ও আফসোস-পরিতাপ চরম আকার ধারণ করে। কাজেই আপনারা যা অবশিষ্ট আছে তা দ্বারা যা ছুটে গেছে তা পূরণ করুন। বস্তুত যে ব্যক্তি অবশিষ্টাংশকে সংশোধন করে, তার যা গত হয়ে গেছে তা তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। সে ব্যক্তিই বিচক্ষণ যে নিজের নফসের হিসেব ও পর্যালোচনা করে, গন্তব্যকে ত্রুটিমুক্ত করে, ভুল শুধরে নেয় এবং দিনের বেলায় যা করেছে তা রাতের বেলায় নিরীক্ষণ করে। ইবনে হিব্বান (রহ.) বলেন, ‘জ্ঞানীদের মধ্যে সর্বোত্তম মর্যাদাবান সেই ব্যক্তি, যে তাদের মধ্যে সর্বদা স্বীয় নফসের পর্যালোচনা করে।’
২৬ জুলাই ২০২৪ পবিত্র মদিনার মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার ভাষান্তর— হারুনুর রশীদ ত্রিশালী।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ