মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

মক্কা থেকে আবুবকর (রা.)-এর হিজরত

প্রকাশনার সময়: ৩১ জুলাই ২০২৪, ২৩:১৬

এক সময় হাবশায় হিজরতকারী সাহাবিরা জানতে পারেন, মক্কার লোকরা ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং মক্কা মুসলমানদের জন্য নিরাপদ। একথা শুনে সাহাবিরা মক্কার উদ্দেশে রওনা দেন। কিন্তু পথিমধ্যে জানতে পারেন, কুরাইশদের ইসলাম গ্রহণের খবর মিথ্যা। তখন তারা আত্মগোপন করেন বা কারো আশ্রয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন। আবুবকর (রা.) হাবশায় হিজরতের উদ্দেশে বেরিয়ে যান। কিন্তু বারকুল গিমাদে ইবনু দাগিনা তাকে আশ্রয় দিতে চাইলে তিনি ফিরে আসেন।

আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আমার মাতা-পিতাকে কখনো ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন পালন করতে দেখিনি এবং এমন কোনো দিন কাটেনি যেদিন সকালে কিংবা সন্ধ্যায় রাসুল (সা.) আমাদের বাড়িতে আসেননি। যখন মুসলমানরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়লেন, তখন আবুবকর (রা.) হিজরত করে আবিসিনিয়ায় (বর্তমান ইথিওপিয়া) যাওয়ার উদ্দেশে বের হলেন। অবশেষে বারকুল গিমাদ (মক্কার পেছনে পাঁচ রাতের দূরত্বে সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত; কারো মতে ইয়ামনের একটি শহর) নামক স্থানে পৌঁছালে ইবনু দাগিনার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। সে ছিল তাঁর গোত্রের নেতা।

সে বলল, হে আবুবকর! কোথায় যাচ্ছেন? উত্তরে আবুবকর (রা.) বললেন, আমার জাতি আমাকে বের করে দিয়েছে। তাই আমি মনে করছি, পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াব এবং আমার প্রতিপালকের ইবাদত করব। ইবনু দাগিনা বলল, হে আবুবকর! আপনার মতো ব্যক্তি চলে যেতে পারে না এবং বহিষ্কৃতও হতে পারে না। আপনি তো নিঃস্বদের জন্য উপার্জন করে দেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, অক্ষমদের বোঝা নিজে বহন করেন, মেহমানের সমাদর করেন এবং সত্য পথের পথিকদের বিপদাপদে সাহায্য করেন। সুতরাং আমি আপনাকে আশ্রয় দিচ্ছি, আপনাকে যাবতীয় সহযোগিতার অঙ্গীকার করছি। আপনি ফিরে যান এবং নিজ শহরে আপনার রবের ইবাদত করুন। আবুবকর (রা.) ফিরে আসলেন। তাঁর সঙ্গে ইবনু দাগিনাও আসল।

ইবনু দাগিনা বিকেল বেলা কুরাইশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে গেল এবং তাদেরকে বলল, আবুবকরের মতো লোক দেশ থেকে বের হতে পারে না এবং তাকে বের করে দেয়া যায় না। আপনারা কি এমন ব্যক্তিকে বের করবেন, যিনি নিঃস্বদের জন্য উপার্জন করেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, অক্ষমের বোঝা নিজে বহন করেন, মেহমানের আপ্যায়ন করেন এবং ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার কারণে বিপদ এলে সাহায্য করেন?

ইবনু দাগিনার আশ্রয় দান কুরাইশরা মেনে নিল এবং তারা ইবনু দাগিনাকে বলল, তুমি আবুবকরকে বলে দাও, তিনি যেন তাঁর রবের ইবাদত তাঁর ঘরে করেন। সালাত সেখানেই আদায় করেন এবং ইচ্ছামাফিক কোরআন তিলাওয়াত করেন। এর দ্বারা যেন আমাদের কষ্ট না দেন। আর এসব ব্যাপার (ইবাদত) যেন প্রকাশ্যে না করেন। কেননা আমরা আমাদের মেয়েদের ও ছেলেদের (ইসলাম গ্রহণ করার) ফিতনায় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছি।

ইবনু দাগিনা এসব কথা আবুবকর (রা.)কে বলে দিলেন। সে মতে কিছুদিন আবুবকর (রা.) নিজের ঘরে তাঁর রবের ইবাদত করতে লাগলেন। সালাত প্রকাশ্যে আদায় করতেন না এবং ঘরেই কোরআন তিলাওয়াত করতেন। এরপর আবুবকর (রা.) তাঁর ঘরের বারান্দায় একটি মসজিদ তৈরি করে নিলেন। এতে তিনি সালাত আদায় ও কোরআন তিলাওয়াত করতে লাগলেন। এতে তাঁর কাছে মুশরিকা মহিলা ও যুবকরা ভিড় জমাতে লাগল। তারা আবুবকর (রা.)-এর এ কাজে বিস্ময়বোধ করত এবং তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকত। আবুবকর (রা.) ছিলেন একজন ক্রন্দনকারী ব্যক্তি, তিনি যখন কোরআন তিলাওয়াত করতেন তখন অশ্রুসংবরণ করতে পারতেন না।

ব্যাপারটি মুশরিকদের নেতৃস্থানীয় কুরাইশদের ভীত করে তুলল এবং তারা ইবনু দাগিনাকে ডেকে পাঠাল। সে এলে তারা তাকে বলল, তোমার আশ্রয় প্রদানের কারণে আমরাও আবুবকরকে আশ্রয় দিয়েছিলাম এ শর্তে যে, তিনি তাঁর রবের ইবাদত তাঁর ঘরের মধ্যে করবেন। কিন্তু সে শর্ত তিনি ভঙ্গ করেছেন এবং নিজ গৃহের পাশে একটি মসজিদ তৈরি করে প্রকাশ্যে সালাত ও তিলাওয়াত শুরু করেছেন। আমাদের ভয় হচ্ছে, আমাদের নারী ও শিশুরা ফিতনায় পড়ে যাবে। কাজেই তুমি তাঁকে নিষেধ করে দাও। তিনি তাঁর রবের ইবাদত তাঁর গৃহের ভিতর সীমাবদ্ধ রাখতে চাইলে তিনি তা করতে পারেন। আর যদি তিনি তা অমান্য করে প্রকাশ্যে তা করতে চান তবে তাঁকে তোমার আশ্রয় প্রদান ও দায়-দায়িত্ব ফিরিয়ে দিতে বল। আমরা তোমার আশ্রয় দানের ব্যাপারে বিশ্বাসঘাতকতা করা অত্যন্ত অপছন্দ করি। আবার আবুবকরকেও এভাবে প্রকাশ্যে ইবাদত করতে দিতে পারি না।

আয়েশা (রা.) বলেন, ইবনু দাগিনা এসে আবুবকর (রা.)কে বলল, আপনি অবশ্যই জানেন যে, কী শর্তে আমি আপনার জন্য ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিলাম। আপনি হয়তো তাতে সীমিত থাকবেন অন্যথা আমার জিম্মাদারি আমাকে ফেরত দেবেন। আমি এ কথা মোটেই পছন্দ করি না যে, আমার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ এবং আমার আশ্রয়প্রাপ্ত ব্যক্তির প্রতি আমার বিশ্বাসঘাতকতার অপবাদ আরববাসীর কাছে প্রকাশিত হোক। আবুবকর (রা.) তাকে বললেন, আমি তোমার আশ্রয় তোমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি। আমি আমার আল্লাহর আশ্রয়ের ওপর সন্তুষ্ট আছি।

এ সময় নবী করীম (সা.) মক্কায় ছিলেন। রাসুল (সা.) মুসলমানদের বললেন, আমাকে তোমাদের হিজরতের স্থান (স্বপ্নে) দেখানো হয়েছে। সে স্থানে খেজুর বাগান রয়েছে এবং তা দু’টি পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত। এরপর যারা হিজরত করতে চাইলেন, তারা মদিনার দিকে হিজরত করলেন। আর যারা হিজরত করে আবিসিনিয়ায় চলে গিয়েছিলেন, তাদেরও অধিকাংশ সেখান থেকে মদিনায় চলে এলেন। আবুবকর (রা.)ও মদিনায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। তখন রাসুল (সা.) তাঁকে বললেন, তুমি অপেক্ষা কর। আশা করছি আমাকেও অনুমতি দেয়া হবে। আবুবকর (রা.) বললেন, আমার পিতা আপনার জন্য কোরবান হোক! আপনিও কি হিজরতের আশা করছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন আবুবকর (রা.) রাসুল (সা.)-এর সঙ্গ পাওয়ার জন্য নিজেকে হিজরত থেকে বিরত রাখলেন এবং তাঁর কাছে যে দু’টি উট ছিল সে দু’টিকে চার মাস পর্যন্ত বাবলা গাছের পাতা খাওয়াতে থাকলেন।

আয়েশা (রা.) বলেন, ইতোমধ্যে একদিন আমরা ঠিক দুপুরবেলায় আবুবকর (রা.)-এর ঘরে উপবিষ্ট ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে আবুবকরকে খবর দিল যে, রাসুল (সা.) মস্তক আবৃত অবস্থায় আসছেন। সেটা এমন সময় ছিল যখন তিনি পূর্বে কখনো আমাদের এখানে আসেননি। আবুবকর (রা.) তাঁর আসার কথা শুনে বললেন, আমার মাতাপিতা তাঁর প্রতি কোরবান হোক। আল্লাহর কসম, তিনি এ সময় নিশ্চয়ই কোনো গুরুত্বপূর্ণ কারণেই আসছেন। রাসুল (সা.) পৌঁছে ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। তাঁকে অনুমতি দেয়া হলো। ঘরে প্রবেশ করে তিনি আবুবকরকে বললেন, এখানে অন্য যারা আছে তাদের বের করে দাও। আবুবকর (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমার পিতামাতা আপনার প্রতি কোরবান হোক! এখানে তো আপনারই পরিবার।

তখন তিনি বললেন, আমাকেও হিজরতের অনুমতি দেয়া হয়েছে। আবুবকর (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমার পিতামাতা আপনার জন্য কোরবান হোক! আমি আপনার সফরসঙ্গী হতে ইচ্ছুক। রাসুল (সা.) বললেন, ঠিক আছে। আবুবকর (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমার পিতামাতা কোরবান হোক! আমার এ দু’টি উট থেকে আপনি যে কোনোটি নিন। রাসুল (সা.) বললেন, তবে মূল্যের বিনিময়ে।

আয়েশা (রা.) বলেন, আমরা তাঁদের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা অতি দ্রুত সম্পন্ন করলাম এবং একটি থলের মধ্যে তাঁদের খাদ্যসামগ্রী গুছিয়ে দিলাম। আমার বোন আসমা বিনতে আবুবকর (রা.) তার কোমরবন্ধের কিছু অংশ কেটে থলের মুখ বেঁধে দিলেন। এ কারণেই তাঁকে ‘জাতুন নেতাক’ (কোমর বন্ধওয়ালী) বলা হতো। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ও আবুবকর (রা.) ছাওর পর্বতের একটি গুহায় আশ্রয় নিলেন। তাঁরা সেখানে তিন রাত অবস্থান করলেন। আবদুল্লাহ ইবনু আবুবকর (রা.) তাঁদের পাশেই রাত যাপন করতেন।

তিনি ছিলেন একজন তীক্ষ বুদ্ধিসম্পন্ন তরুণ। তিনি শেষ রাতে ওখান থেকে বেরিয়ে মক্কায় রাত যাপনকারী কুরাইশদের সঙ্গে মিলিত হতেন এবং তাঁদের দু’জনের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র করা হতো তা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন ও স্মরণ রাখতেন। যখন আঁধার ঘনিয়ে আসত তখন তিনি সংবাদ নিয়ে তাঁদের কাছে যেতেন। আবুবকর (রা.)-এর গোলাম আমির বিন ফুহায়রাহ তাঁদের কাছেই দুধালো ছাগলের পাল চরিয়ে বেড়াত।

রাতের কিছু সময় চলে যাওয়ার পর সে ছাগলের পাল নিয়ে তাঁদের কাছে যেত এবং তাঁরা দু’জন দুধ পান করে আরামে রাত যাপন করতেন। তাঁরা বকরীর দুধ দোহন করে সঙ্গে সঙ্গেই পান করতেন। তারপর শেষ রাতে আমির বিন ফুহায়রাহ ছাগলগুলো হাঁকিয়ে নিয়ে যেত। এ তিন রাতের প্রতি রাতে সে এমনই করল। রাসুল (সা.) ও আবুবকর (রা.) বানী আবদ ইবনু আদি গোত্রের এক ব্যক্তিকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ‘খির্রীত’ (পথপ্রদর্শক) নিযুক্ত করেছিলেন। দক্ষ পথপ্রদর্শককে ‘খির্রীত’ বলা হয়। আদি গোত্রের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল। সে ছিল কাফের কুরাইশের ধর্মাবলম্বী। তাঁরা উভয়ে তাকে বিশ্বস্ত মনে করে তাঁদের উট দু’টি তার হাতে দিয়ে দিলেন এবং তৃতীয় রাতের পরে সকালে উট দু’টি ছাওর গুহার কাছে নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করলেন।

আর সে যথাসময়ে তা পৌঁছিয়ে দিল। আর আমির বিন ফুহায়রাহ ও পথপ্রদর্শক তাঁদের উভয়ের সঙ্গে চলল। প্রদর্শক তাঁদের নিয়ে উপকূলের পথ ধরে চলতে লাগল। অবশেষে তারা মদিনায় পৌঁছালেন। (বুখারি: ২২৯৭,৩৯০৫; আহমাদ: ২৫৬৬৭; ইবনু হিববান: ৬২৭৭)।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ