ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নবীর মুখে কোরআন শুনে উতবার মুগ্ধতা!

প্রকাশনার সময়: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০৮:৫৭

এটা সে সময়ের ঘটনা, যখন কাফেরদের শত বাধা-বিপত্তি ও জুলুম-নির্যাতনের পরেও মক্কায় ক্রমশ ইসলাম ধর্ম ছড়িয়ে পড়ছিল। ওমর (রা.), হামজা (রা.) সহ আরো অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেছেন। ইসলামের ক্রমবর্ধমান উন্নতিতে কাফেররা চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছিল। সে সময় কুরাইশদের এক প্রবীণ নেতা ছিল উতবা ইবনে রবীআ। তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কারণে সবাই তাকে মান্য করত।

একদিন উতবা সাথি-সঙ্গীদের নিয়ে কাবা চত্বরে বসেছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.)ও তখন কাছাকাছি এক জায়গায় বসে ছিলেন। উতবা তার সাথিদেরকে বলল, আমি কি গিয়ে মুহাম্মাদের (সা.) সঙ্গে একটু কথা বলব? তাঁকে কিছু লোভনীয় প্রস্তাব দেব, হয়তো সে কোনো একটা প্রস্তাব গ্রহণ করবে। আমরা তাঁকে সেটা দেব। তাহলে সে এখন যা বলছে, তা থেকে নিবৃত্ত হবে। আমাদের ধর্মের বিরুদ্ধে আর কিছু বলবে না।

সবাই বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আবুল ওয়ালীদ (উতবার উপনাম), আপনি গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলুন। তারা ভেবেছিল, উতবা নিশ্চয়ই নিজের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে নবীজির ওহীর প্রতিউত্তর করতে পারবে। তাই তারা তাকে নবীজির কাছে যেতে বিশেষভাবে অনুরোধও করল।

উতবা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বলল, ভাতিজা! আমাদের মধ্যে তোমার অনেক মান-মর্যাদা রয়েছে। তুমি উচ্চ বংশের। আমরা সবাই তোমাকে খুব সম্মান করি। কিন্তু তুমি আমাদেরকে একটা সংকটে ফেলে দিয়েছ। তুমি যে বিষয়ের দাওয়াত দিচ্ছ, তা জাতিকে বিভক্ত করে ফেলেছে। তুমি আমাদের ঐক্য নষ্ট করেছ। তুমি আমাদের ধর্ম, উপাস্য ও পূর্বপুরুষদের অমান্য কর এবং তাদের বিরুদ্ধে কথা বল। তুমি আরবের মধ্যে আমাদের বদনাম করেছ, অন্যরা বলাবলি করছে, কুরাইশ গোত্রে একজন জাদুকর বা গণকের আবির্ভাব হয়েছে। শোনো, আমি তোমাকে কয়েকটি প্রস্তাব দিচ্ছি, তুমি এগুলোর মধ্যে যে কোনোটা বেছে নিতে পার, বিনিময়ে তুমি এ জাতীয় কথা আর বলবে না।

নবীজী বললেন, আপনি কী বলতে চান বলুন, আমি শুনছি। উতবা বলল, ভাতিজা, তুমি যদি এ দাওয়াতের মাধ্যমে ধন-সম্পদ কামাতে চাও, তাহলে আমরা সবাই মিলে তোমাকে ধন-সম্পদ দিয়ে সবচেয়ে ধনী বানিয়ে দেব। যদি শাসন ক্ষমতা চাও, তাহলে আমরা তোমাকে সরদার হিসেবে গ্রহণ করব এবং তোমার সব কথা মেনে চলব। যদি তুমি রাজত্ব চাও, তাহলে তোমাকে রাজত্বও দেব। আর যদি এটা তোমার ওপর জিনের আসর হয়ে থাকে, যার চিকিৎসা তুমি করাতে পারছ না, তাহলে আমরা তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। উতবার কথা রাসুলুল্লাহ (সা.) চুপ করে শুনলেন, তারপর বললেন, আপনার কথা কি শেষ হয়েছে? সে বলল, হ্যাঁ। নবীজী বললেন, এবার তাহলে আমার কথা শুনুন। সে বলল, অবশ্যই শুনব।

রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজের পক্ষ থেকে কিছু না বলে, সুরা হা-মীম-সেজদা (সুরা ফুসসিলাত) তিলাওয়াত শুরু করলেন। নবীজী সুরাটির সেজদার আয়াত পর্যন্ত তিলাওয়াত করে সেজদা আদায় করলেন। উতবা চুপ করে পুরোটা শুনল। তিলাওয়াত শেষ হলে নবীজী বললেন, আবুল ওয়ালীদ! আপনি যা শোনার শুনলেন, এখন আপনার যা ইচ্ছা করতে পারেন।

এক বর্ণনা অনুযায়ী রাসুলুল্লাহ (সা.) সুরাটির প্রথম ১৩ আয়াত তিলাওয়াত করলেন। তখন উতবা বলে ওঠল, আমার প্রতি দয়া করুন, আর পাঠ করবেন না। এরপর নবীজীর কাছ থেকে উঠে উতবা নিজের লোকদের কাছে গেল। উতবাকে দেখে তার সাথিরা পরস্পর বলাবলি করতে লাগল, আবুল ওয়ালীদের চেহারা তো বিবর্ণ হয়ে গেছে। উতবা তাদের কাছে গেলে তারা বলল, কী খবর বলুন!

উতবা বলল, তোমাদের যা যা বলার ছিল, আমি তাঁকে সবই বলেছি। তারা জিজ্ঞেস করল, সে কী উত্তর দিয়েছে? উতবা বলল, সে কী বলেছে, আমি তা বুঝি নাই। শুধু এতটুকু বুঝেছি যে, সে বলেছে- ‘তারপরও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বলে দাও, আমি তোমাদেরকে সতর্ক করেছি তেমনি বজ্র সম্পর্কে, যেমন বজ্র অবতীর্ণ হয়েছিল আদ ও ছামূদ (জাতি)র ওপর।’ (সুরা মুমিন (৪১): ১৩)

আমি তার মুখে এমন কিছু শুনেছি, যা জীবনে কখনো শুনিনি। কসম করে বলছি, সেটা জাদু নয়, কবিতা নয়, শয়তান থেকে অর্জিত কিছুও নয়। তারা বলল, আবুল ওয়ালীদ, আপনি কী বলছেন!? সে আপনার ভাষায়ই আপনার সাথে কথা বলেছে, তাও আপনি কিছু বুঝতে পারেননি? উতবা বলল, আমি বজ্র সম্পর্কিত সতর্কবাণী ছাড়া আর কিছুই বুঝতে পারিনি।

তারপর সে সবার উদ্দেশ্যে বলল, হে কুরাইশের লোকজন! তোমরা আমার কথা মেনে নাও। আমার মত হলো, তোমরা তাঁর বিরুদ্ধে যেও না। তাঁর ওপর নির্যাতন করো না। তাঁকে তাঁর কাজ করতে দাও। কারণ তাঁর এ কাজের বিশেষ একটা প্রভাব প্রকাশ পাবেই। তোমরা অপেক্ষা করে অন্যান্য আরবদের আচরণ দেখ। যদি তারা তোমাদের সাহায্য ছাড়াই তাঁকে পরাজিত করে ফেলে, তাহলে তোমাদের উদ্দেশ্য তো পূরণ হয়েই গেল। আর সে যদি সবার ওপরে বিজয়ী হয়ে যায়, তাহলে তাঁর রাজত্ব তো তোমাদেরই রাজত্ব। তাঁর সম্মান-মর্যাদা তো তোমাদেরই সম্মান-মর্যাদা। তখন তোমরা তাঁর সাফল্যের অংশীদার হবে।

উতবার কথা শুনে অন্যরা বলল, আবুল ওয়ালীদ! মুহাম্মাদ তো আপনাকে কথা দিয়ে জাদু করে ফেলেছে। উতবা বলল, আমি আমার মতামত বললাম। এবার তোমাদের যা ইচ্ছে কর।

অন্য বর্ণনা অনুযায়ী রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ থেকে উঠে উতবা নিজের ঘরে গিয়ে আত্মগোপনে থাকল। সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা বন্ধ করে দিল। তখন আবু জেহেল অন্যান্য কুরাইশ লোকদেরকে বলল, উতবা তো মনে হচ্ছে মুহাম্মাদের ধর্ম গ্রহণ করে নিয়েছে। তার কাছ থেকে সে যা খেয়েছে, তা তাকে মোহিত করে ফেলেছে। চলো তার কাছে যাই। সবাই উতবার কাছে গেল।

আবু জেহেল তাকে বলল, উতবা! তুমি নিশ্চয়ই মুহাম্মাদের ধর্ম গ্রহণ করে নিয়েছ আর তাঁর খাবার তোমাকে বিমোহিত করে ফেলেছে। তোমার যদি কোনো প্রয়োজন থাকে, তাহলে আমরা তোমাকে এত ধন-সম্পদ দেব যে, মুহাম্মাদের খাদ্য তোমাকে গ্রহণ করতে হবে না। উতবা রেগে গেল এবং ‘মুহাম্মাদের (সা.) সঙ্গে আর কখনো কথা বলবে না’- বলে কসম করল। তারপর বলল, তোমরা জানো, আমি কুরাইশের একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি। আমি তাকে কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলাম, এর জবাবে সে আমাকে যা শোনাল, তা কোনো কবিতা নয়, জাদু নয়, জিনদের থেকে প্রাপ্ত কিছুও নয়।

এরপর সে একটি সুরা পড়ল এবং এ আয়াত পর্যন্ত পড়ল— ‘তারপরও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বলে দাও, আমি তোমাদেরকে সতর্ক করেছি তেমনি বজ্র সম্পর্কে, যেমন বজ্র অবতীর্ণ হয়েছিল আদ ও ছামূদ (জাতি)র ওপর।’ (সুরা মুমিন (৪১): ১৩)

তখন আমি তাকে দয়া করে থেমে যেতে বললাম। তোমরা তো জানোই, মুহাম্মাদ কখনো মিথ্যা বলে না। তাই আমি তোমাদের ওপর আজাব আসার ভয় করছি।

(তথ্যসূত্র: সীরাতে ইবনে হিশাম ১/২৬১-২৬২; ১/২৯৩-২৯৪; ২/১৩০-১৩২; মুসনাদে আবু ইয়া’লা, হাদিস ১৮১৮; সুরা হা-মীম সেজদার তাফসীর- তাফসীরে তবারী, তাফসীরে কুরতুবী, তাফসীরে বাগাবী, তাফসীরে ইবনে কাসীর)

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ