ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পবিত্র আশুরা দিবসে করণীয় ও বর্জনীয়

প্রকাশনার সময়: ১৬ জুলাই ২০২৪, ১৬:৫০

মহররম মাস। আরবি ১২ মাসের প্রথম মাস। অনেক ঘটনা ও ফজিলতের সম্পৃক্ততা রয়েছে এ মাসের সঙ্গে। আরবি মাসগুলোর মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ মাস এটি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ যেদিন আসমান-জমিন সৃষ্টি করেছেন সেদিন থেকেই মাসসমূহের গণনা আল্লাহর নিকট তাঁর বিধান মতে ১২টি। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এটাই সহজ সরল দ্বীন। অতএব, তোমরা এ দিনগুলোতে নিজের ওপর জুলুম করো না।’ (সুরা তাওবা: ৩৬)

হাদীসে এ মাসকে শাহরুল্লাহ তথা আল্লাহর মাস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম (সা.) ইরশাদ বলেন, ‘রমজানের পর সবচেয়ে উত্তম রোজা হলো ‘আল্লাহর মাস’ মহররমের রোজা। আর ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো রাতের নামাজ (অর্থাৎ তাহাজ্জুদের নামাজ)।’ (মুসলিম: ১১৬৩)

আরো ইরশাদ হয়েছে- (রমজানের পর) শ্রেষ্ঠ মাস হচ্ছে আল্লাহর মাস, যাকে তোমরা মহররম বলে থাকো।’ (নাসাঈ: ৪২১৬) প্রকৃতপক্ষে সব মাসই তো আল্লাহর মাস। তথাপি এ মাসকে বিশেষভাবে ‘আল্লাহর মাস’ বলে ব্যক্ত করার মাঝে রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য। যেমন পৃথিবীর সব মসজিদই আল্লাহর ঘর। কিন্তু কাবা শরীফকে বিশেষভাবে বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর বলার হেকমত কী? কারণ এর রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। তেমনি বছরের অন্যান্য মাস অপেক্ষা মহররমের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। মহররমকে ঘিরেও রয়েছে শরীয়তের সুন্দর সুন্দর বিধান ও আমল।

আশুরার ফজিলত ও প্রেক্ষাপট

মহররমের ১০ তারিখকে আশুরার দিন বলা হয়। মহররম মাসের সবচেয়ে মহিমান্বিত দিন হচ্ছে আশুরার দিন। হাদীসে আশুরার দিনের অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়াও ইসলামপূর্ব আরব জাহেলী সমাজে এবং আহলে কিতাব— ইহুদী-নাসারাদের মাঝেও ছিল এ দিনের বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা।

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) বলেন, (জাহেলী সমাজে) লোকেরা রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বে আশুরার দিন রোজা রাখত। এ দিন কাবায় গেলাফ জড়ানো হতো। এরপর যখন রমজানের রোজা ফরজ হলো, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, যে এদিন রোজা রাখতে চায় সে রাখুক। যে না চায় না রাখুক।’ (বুখারী: ১৫৯২)

এরপর যখন রাসুলে কারীম (সা.) হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারায় চলে আসেন দেখেন, মদীনার আহলে কিতাব ইহুদীরাও এ দিনে রোজা রাখছে। এদিনকে তারা বিশেষভাবে উদযাপন করছে। নবীজি (সা.) তাদের জিজ্ঞাসা করলেন- এদিনে তোমরা কী জন্য রোজা রাখছ? তারা বলল- ‘এটি একটি মর্যাদাপূর্ণ দিবস। আল্লাহ তায়ালা এদিনে মূসা ও তাঁর কওমকে (ফেরাউনের কবল থেকে) মুক্তি দিয়েছেন এবং ফেরাউনকে তার দলবলসহ (দরিয়ায়) নিমজ্জিত করেছেন। এরপর মূসা (আ.) এদিনে শুকরিয়াস্বরূপ রোজা রাখতেন। তাই আমরাও রোজা রাখি।’

নবীজি (সা.) এ কথা শুনে বললেন, মূসা (আ.)-এর অনুসরণে আমরা তোমাদের চেয়ে অধিক হকদার। এরপর নবীজি নিজেও রোজা রাখলেন এবং অন্যদের রোজা রাখতে বললেন।’ (মুসলিম: ১১৩০; বুখারী: ১১২৫)

উপরোল্লিখিত হাদীসগুলো থেকে বোঝা যায়— জাহেলী সমাজে এ দিনের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। নবীজিও এদিন রোজা রাখতেন। হিজরতের পরও এদিন রোজা রেখেছেন। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বে এ দিনের রোজা ফরজ ছিল। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর এদিন রোজা রাখা এখন মুস্তাহাব।

আশুরার দিনের বিশেষ আমল কী?

এদিনের মূল ইবাদত হচ্ছে রোজা রাখা। পূর্ববর্তী হাদীসগুলো থেকে যা আমরা বুঝতে পেরেছি। এদিনের রোজার ফজিলতের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন— ‘আশুরার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর নিকট প্রত্যাশা রাখি, তিনি পূর্বের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ (মুসলিম: ১১৬২)

ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)কে আশুরার দিনের চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে অন্য কোনো দিন রোজা রাখতে দেখিনি এবং রমজান মাস অপেক্ষা অন্য কোনো মাসে এত গুরুত্ব দিয়ে রোজা রাখতে দেখিনি।’ (বুখারী: ২০০৬; মুসলিম: ১১৩২)

অতএব, আশুরার দিন আমরা রোজা রাখব এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করব।

আশুরার রোজা কয়টি? ইতোমধ্যেই আমরা জেনেছি, মহররমের ১০ তারিখ আশুরার দিন। তাই আমরা ১০ তারিখ রোজা রাখব। তবে উত্তম হলো, ১০ মহররমের আগে বা পরে তথা ৯ বা ১১ তারিখে এক দিন অতিরিক্ত রোজা রাখা। অর্থাৎ মোট দু’টি রোজা রাখা। যাতে ইহুদীদের সাদৃশ্য অবলম্বন না হয়। যেমনটি নিম্নোক্ত হাদীস থেকে বোঝা যায়— আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন আশুরার রোজা রাখছিলেন এবং অন্যদেরকে রোজা রাখতে বলেছিলেন তখন সাহাবীগণ বললেন- ইয়া রাসুলুল্লাহ! এদিনকে তো ইহুদী-নাসারারা সম্মান করে? তখন নবীজি বললেন, ‘তাহলে আগামী বছর আমরা ৯ তারিখেও রোজা রাখব- ইনশাআল্লাহ। কিন্তু সেই আগামী বছর আসার পূর্বেই নবীজির ইন্তেকাল হয়ে যায়।’ (মুসলিম: ১১৩৪)

‘নয় তারিখ রোজা রাখব’ মানে ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ তারিখ মিলিয়ে রাখব। অন্য এক হাদীসে আছে, ‘তোমরা আশুরার রোজা রাখ এবং ইহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে আশুরার আগে বা পরে আরো এক দিন রোজা রাখ।’ (মুসনাদে আহমদ: ১/২৪১)

আশুরাকে ঘিরে ভিত্তিহীন কথা

আশুরা নিয়ে সমাজে প্রচলিত অনেক ধারণা, রীতি-রেওয়াজ ও কার্যাবলী রয়েছে; যেগুলো সম্পূর্ণ ইসলামের ইতিহাস ও বিধানের বিপরীত। এসব কুসংস্কারের অন্যতম কয়েকটি হলো—

# আশুরা উপলক্ষে নিজের শরীরে আঘাত করে রক্ত বের করা।

# কারবালার ইতিহাসের স্মরণে রণ প্রস্তুতির মহড়া প্রদর্শন করা।

# বিভিন্ন অঞ্চলে মেলার আয়োজন করা। ইসলাম এসব মেলাকে সমর্থন করে না।

# মহররম মাসে জারি গানের আসর জমানো।

# মহররম মাসকে কুলক্ষুণে মনে করে বিয়ে থেকে বিরত থাকা।

# আশুরার দিন অতিরিক্ত খরচ করাকে ফজিলতপূর্ণ মনে করা।

প্রচলিত এসব কার্যাবলীর প্রভাব অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। এগুলো থেকে বেঁচে থাকতে হবে। আর এসব থেকে মুক্তির উত্তম পথ হলো— সত্য ইতিহাস আঁকড়ে ধরা, সত্য ইতিহাস জানা। এ জানার কোনো বিকল্প নেই।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ