হূদয়ে প্রশান্তি ও প্রফুল্ল বয়ে আনে এমন একটি উপলক্ষ হলো বিয়ে; যেখানে এক জন যুবক একটি দৃঢ় চুক্তি ও শরয়ী বন্ধনের মাধ্যমে একটি মেয়েকে বিয়ে করে পরিবার গঠন ও একটি ভিত্তিমূল স্থাপন করার জন্য, যা সমাজের বন্ধনকে শক্তিশালী করে এবং জাতির স্তম্ভকে সুদৃঢ় করে। তাদের উভয়কে এ পথে ধাবিত করে সুখী জীবনের প্রত্যাশা, সুধারণা ও আকাঙ্ক্ষা; যেখানে উত্তম সন্তান প্রশান্ত পরিবেশে বেড়ে উঠবে, যা ভালোবাসা ও দয়ায় পরিপূর্ণ। স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের অধিকার ও কর্তব্য এবং দায়িত্ববোধের সীমারেখাকে হূদয়াঙ্গম করা তাদের সুখ দীর্ঘস্থায়ী করে ও এর স্থায়িত্বকে গভীরে নিয়ে যায়। আর এটা বিয়ের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
বিয়ে একটি উপভোগ্য বিষয় ও মহৎ ইবাদত তাদের জন্য যারা এর ফজিলত লাভ করতে চায়। আর এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই যে গৃহ ঈমানে আলোকিত, দ্বীনের ছায়ায় আবৃত, আনুগত্যের আলোয় উজ্জ্বল এবং শরীয়তের প্রতি পূর্ণ অনুগত; সে গৃহই উত্তম ফল উৎপন্ন করে- কিছু সময় পরে হলেও। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা একে অপরের বংশধর। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা আলে ইমরান: ৩৪)
বিবাহিত দম্পতি— ছেলে ও মেয়ের ঘরে কিভাবে বরকত আসে তা ইসলাম আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করেছে। আর যখন পরিবারে বরকত নেমে আসে; তখন কল্যাণ ধারাবাহিকভাবে আগমন করতে থাকে এবং শয়তান পলায়ন করে। বস্তুত ব্যক্তির ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে বরকত আসে কোরআন তিলাওয়াত, আল্লাহর জিকির ও সালাত আদায়ের মাধ্যমে। পরিবারে প্রশান্তি আনার জন্য হাদীসের নির্দেশিত আমলগুলো সংক্ষেপে নিম্নরূপ—
# রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি তার ঘরে প্রবেশের সময় ও খাবার গ্রহণের সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করে, তখন শয়তান হতাশ হয়ে (তার সঙ্গীদের) বলে, তোমাদের এখানে রাত যাপনও নেই, খাওয়াও নেই।’ (মুসলিম)
# নবী (সা.) আরো বলেছেন, ‘তোমরা সুরা বাকারা তিলাওয়াত করবে। কেননা তা তিলাওয়াতে বরকত রয়েছে, আর তা বর্জন আফসোসের কারণ আর বাতিলরা এর মোকাবিলা করতে পারে না।’ (মুসলিম)
# তিনি আরো বলেন, ‘তোমাদের সালাতের কিছু অংশ তোমাদের ঘরের জন্যও নির্ধারিত রাখবে এবং ঘরগুলোকে কবরে পরিণত করবে না।’ (মুসনাদে আহমাদ) আল্লাহ বলেন, ‘যখন তোমরা কোনো ঘরে প্রবেশ করবে তখন তোমরা পরস্পরের প্রতি সালাম করবে অভিবাদনস্বরূপ যা আল্লাহর কাছ থেকে কল্যাণময় ও পবিত্র।’ (সুরা আন-নূর: ৬১)
# কোরআনুল কারীম একটি কোরআনিক নীতি অঙ্কন করেছে যা আচরণ ও শিষ্টাচারকে উন্নত করে, আত্মাগুলোকে পরস্পরের নিকটবর্তী করে এবং ভালোবাসার বন্ধনকে শক্তিশালী করে; তা হলো সম্মানজনক সহাবস্থান। যেন তা জীবনের রীতি ও দাম্পত্য জীবনের পারস্পরিক আচরণের নীতি হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে সৎভাবে সহাবস্থান করবে।’ (সুরা আন-নিসা: ১৯)
অর্থাৎ প্রত্যেকেই যেন একে অপরের সঙ্গে সৎভাবে জীবনযাপন করে। মূলত সুন্দর সহাবস্থান হলো নরম কথা বলা, উত্তম কাজ করা, কোমল আচরণ করা, ব্যয়ের ক্ষেত্রে প্রশস্ততা অবলম্বন করা, সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল থাকা, নম্র হওয়া, একে অপরকে আনন্দিত করা, ক্ষমা ও উদারতা প্রদর্শন করা, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা, ক্রোধ সংবরণ করা, তর্ক না করা এবং রূঢ়তার ওপর সংশোধনকে প্রাধান্য দেয়া।
সম্মানজনক সহাবস্থানের মধ্যে আরো রয়েছে— গোপনীয়তা রক্ষা করা, ছোটখাটো সমস্যাগুলো গোপন রাখা যা প্রকাশ বা নজরদারী করা অনুচিত, গোয়েন্দাগিরি থেকে দূরে থাকা এবং এগুলোর সব পথ বন্ধ করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা একে অন্যের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না।’ (সুরা আল-হুজুরাত: ১২) অর্থাৎ আল্লাহ যা গোপন রেখেছেন তা প্রকাশ করো না; দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান, অপ্রকাশ্য বিষয় অনুসরণ ও গোপনীয় বিষয় উদঘাটনের মাধ্যমে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মানুষের অন্তর বা পেট চিরে দেখার জন্য আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়নি।’ (বুখারী ও মুসলিম)
# মন্দ ধারণা দাম্পত্য জীবনের মারাত্মক সমস্যা, যা প্রমাণবিহীন অপবাদ আরোপের দিকে নিয়ে যায়। এমনকি সন্দেহ ও কুধারণা ভালোবাসা ও ঘৃণার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। উন্নত আচরণের অন্তর্ভুক্ত হলো— উপেক্ষার কৌশল রপ্ত করা, ছোটখাটো বিষয়গুলোতে অতিরিক্ত মনোযোগ না দেয়া এবং তুচ্ছ বিষয়সমূহ ও ভুল- ত্রুটির অনুসন্ধান এড়িয়ে যাওয়া।
# বৈবাহিক জীবন কিছু চ্যালেঞ্জ ও মতানৈক্যের মুখোমুখি হয়, যা তার স্বচ্ছতাকে কলুষিত করে। কিন্তু বিবেকবান স্বামী-স্ত্রী সমস্যা নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসেন, সমস্যাগুলোকে সমাধান করেন, পরিবারের স্থিতি ও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন এবং ব্যক্তিস্বার্থ থেকে মুক্ত হয়ে কাজ করেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, জেদ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা শয়তানের কুমন্ত্রণা; যা পারিবারিক কাঠামোকে ধ্বংস করে।
# কোনো মানুষই দোষ ও অপূর্ণতা থেকে মুক্ত নয়। যদি স্বামী-স্ত্রী হিকমতের সঙ্গে আচরণ করে, তাহলে তারা ত্রুটিগুলো সংশোধন করে নিতে পারে; সুন্দর পদ্ধতি, ভালো কথা ও উন্নত আচরণের মাধ্যমে। স্পষ্টভাবে না বলে বা আঘাত না করে প্রশংসাসূচক শব্দ ব্যবহার ও ভালোবাসার অনুভূতি জাগিয়ে আকার-ইঙ্গিতের মাধ্যমে সংশোধন প্রচেষ্টা করা তা গ্রহণ করার জন্য অধিক উপযুক্ত।
# দাম্পত্য জীবনকে বিপন্ন করে তুলতে পারে সোশ্যাল মিডিয়ায় যা দেখা যায় তার সঙ্গে গঠন, আকৃতি ও ব্যবহারকে তুলনা করা। ফলে স্বামীর চোখে তার স্ত্রী তুচ্ছ হয়ে যায় এবং স্ত্রীর হূদয়ে তার স্বামী মূল্যহীন হয়ে ওঠে। তাই এ মাধ্যমগুলো ব্যবহারের সময় আল্লাহকে ভয় করা উচিৎ এবং এগুলোর পদস্খলন থেকে মুক্ত থাকা উচিৎ।
# আল্লাহ যা দিয়েছেন তাতে স্বামী-স্ত্রীর সন্তুষ্ট ও কৃতজ্ঞ থাকা জরুরী; নিয়ামতের শুকরিয়া আদায়ও পারিবারিক কাঠামো রক্ষার স্বার্থে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যদি তাদেরকে অপছন্দ করো তবে এমন হতে পারে যে, আল্লাহ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন তোমরা তাকেই অপছন্দ করছ।’ (সুরা আন-নিসা: ১৯) এ উপদেশ মহিলাদের জন্যও প্রযোজ্য।
# জেনে রাখুন! একটি ছোট্ট উপহার ও আনন্দদায়ক সারপ্রাইজ প্রদান জীবনের উষ্ণতাকে নবায়ন করে, ঝিমিয়ে পড়া আবেগকে আন্দোলিত করে, ভালোবাসা ও প্রেমের অর্থ পুনরুজ্জীবিত করে এবং ঘুমন্ত প্রীতিকে জাগিয়ে তোলে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা উপহার বিনিময় করো, তাহলে পারস্পরিক সম্প্রীতি লাভ করবে।’ (ইমাম বুখারীর আদাবুল মুফরাদ ও মুসনাদে আবু ইয়ালা)
# হাসিমুখ হূদয় ও মনকে মুগ্ধ ও প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে উপহারের মতোই কাজ করে। স্বামী-স্ত্রীর উচিৎ এটিকে অবহেলা না করা; কেননা তা হূদয়ের তালা খুলে দেয়, ঘৃণা-বিদ্বেষ দূর করে, উপরন্তু এটি একটি সদকা। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে তোমার ভাইয়ের সামনে উপস্থিত হওয়া তোমার জন্য সদকাস্বরূপ।’ (সহীহ ইবনে হিব্বান)
১২ জুলাই ২০২৪ মদিনার মসজিদে নববীতে প্রদত্ত জুমার খুতবার অনুবাদ করেছেন হারুনুর রশীদ ত্রিশালী।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ