ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অবৈধ উপার্জনকারীর ইবাদত বৃথা

প্রকাশনার সময়: ১১ জুলাই ২০২৪, ২০:১২

আল্লাহ তো শিরক ব্যতীত সব গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন বলেছেন। তাহলে, এই যে এতসব চোর-বাটপার মানুষের এত এত টাকা লোপাট করছে, চুরি করে নিজেদের সাম্রাজ্য গড়ে তুলছে, স্রেফ তাওবা করলেই কি আল্লাহ এদেরও ক্ষমা করে দেবেন?

শিরক ব্যতীত অন্য সব গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন এ কথা সত্য। তবে, তার আগে আমাদের জানতে হবে ‘হক’ তথা ‘অধিকার’ কত প্রকার ও কী কী। ইসলামে দুই ধরনের হকের কথা বলা হয়েছে। প্রথমটা হাক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক। যেমন— কোনো প্রকার শিরকের সংস্রব ব্যতীত আল্লাহর ওপর বিশুদ্ধ ঈমান রাখা, সালাত আদায় করা, সিয়াম রাখা, জাকাত প্রদান করা ইত্যাদি। মোদ্দাকথা— ব্যক্তিক আমলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবই আল্লাহর হকের সঙ্গে সম্পর্কিত।

এখন কেউ যদি নিয়মিত সালাত আদায় না করে, জাকাত প্রদানে গরমিল করে, কেউ যদি যথাযথ কারণ ছাড়া সিয়াম ছেড়ে দেয় এবং তা পুরা না করে— এসব কাজে আল্লাহর হক লঙ্ঘিত হয়। তো, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যেহেতু মেহেরবান, পরম করুণাময় এবং অসীম দয়ালু, ইচ্ছা হলে তিনি তাঁর এসব কম আমলি বান্দা বা আমল পরিত্যাগকারী বান্দাদের মাফ করে দিতে পারেন যদি তারা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক না করা অবস্থায় মারা যায়।

দ্বিতীয় যে প্রকার হকের কথা ইসলাম বলে সেটা হলো— হাক্কুল ইবাদ তথা বান্দার হক। বান্দার হক সম্পূর্ণরূপে বান্দার সঙ্গে সম্পর্কিত। যেমন— লোক ঠকানো, মানুষের ওপর জুলুম করা, কারো সম্পত্তি জবরদখল করা, কাউকে হত্যা করা, অন্যায়ভাবে কাউকে দমিয়ে রাখাসহ যতো প্রকারে মানুষকে বিপর্যস্ত করা যায় তার সবটাই হাক্কুল ইবাদ তথা বান্দার হকের সঙ্গে সম্পর্কিত।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা নিজের হকের ব্যাপারে ছাড় দিয়ে, আমল পরিত্যাগকারীকে ক্ষমা করে দিলেও, যে লোক বান্দার হক নয়ছয় করে, যে লোক দুনিয়ায় মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়, তাকে ততক্ষণ ক্ষমা করবেন না যতক্ষণ না ওই বান্দা তাকে ক্ষমা না করছে। অর্থাৎ যার ওপর জুলুম করা হয়, যাকে ঠকানো হয়, যার সম্পত্তি জবরদখল করা হয়, যাকে হত্যা করা হয়, সে যদি উক্ত লোককে ক্ষমা না করে, আল্লাহও তাকে ক্ষমা করবেন না।

আল্লাহর রাস্তায় শহিদ হওয়ার চাইতে বড় মর্যাদার বিষয় আর কিছু নেই। সহিহ মুসলিমের একটা হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ঋণ ব্যতীত শহিদদের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ (মুসলিম: ১৮৮৬) ইমাম নববী (রহ.) এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেছেন— এখানে ঋণ বলতে বান্দার যাবতীয় হক তথা অধিকারের বিষয়েই বলা হয়েছে।আল্লাহর রাস্তায় যারা শহিদ হয় তাদের মর্যাদা যে কত তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। আল্লাহর রাসুল বলেছেন— কেউ যদি কোনো বান্দার হক বিনষ্ট করে আল্লাহর রাস্তায় শহীদও হয়, তার সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হলেও, বান্দার হকের বিষয়টা ক্ষমা করা হয় না। শহীদদের বিষয়টাই যদি এমন হয়, সেখানে এসব চোর বাটপারেরা কোন ছাড়?

এই যে চোর বাটপারেরা আমাদের এত এত টাকা লোপাট করে বড়লোক হয়, সাম্রাজ্য গড়ে তুলে, এরা কেউ তো আমাদের ক্ষমা পায় না। একদিন তারা মরেও যায়। এদের সঙ্গে আখিরাতে আল্লাহ কি রকম আচরণ করবে, তাই তো? নিম্নোক্ত হাদিসে সেটার উত্তর মিলতে পারে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে নিঃস্ব ওই ব্যক্তি যে দুনিয়া থেকে সালাত, সিয়াম, জাকাত ইত্যাদি আদায় করে আসবে, তার সঙ্গে ওই লোকেরাও আসবে যাদের কাউকে সে (দুনিয়ার জীবনে) গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ কুক্ষিগত করেছে, কাউকে হ/ত্যা করেছে বা প্রহার করেছে। তখন ওইসব পাওনাদারকে উক্ত ব্যক্তির নেকী থেকে পরিশোধ করে দেওয়া হবে। এভাবে পরিশোধ করতে করতে যখন তার সব আমল শেষ হয়ে যায়, তখন পাওনাদারের গুনাহগুলো এনে তার ওপর চাপানো হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (মুসলিম : ২৫৮১)।

অর্থাৎ, আজকে যারা মানুষের সম্পদ জবরদখল করছে, যারা অন্যায়ভাবে মানুষকে হেনস্তা করছে, বিপদে ফেলছে, অত্যাচার নির্যাতন করছে, মানুষকে বিনা অপরাধে শাস্তি দিচ্ছে, অপবাদ দিচ্ছে, মানুষের টাকা মেরে খাচ্ছে এবং একই সঙ্গে তারা প্রতিবছর হজ করছে, বছরে তিন-চারটা ওমরাহ করছে, নামাজ পড়তে পড়তে কপালে দাগ ফেলে দিচ্ছে, বাজারের সবচেয়ে বড় গরু দিয়ে কোরবানী দিচ্ছে, এলাকায় গড়ে তুলছে বিশাল বিশাল মসজিদ, মাদ্রাসা।

এতিমখানায় দান করছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, কিয়ামতের মাঠে আল্লাহতায়ালা এ কাজগুলোর সওয়াব তাকে দেওয়ার বদলে সেসব মানুষের আমলনামায় তুলে দেবেন যাদের হক দুনিয়ায় সে লঙ্ঘন করেছে। এভাবে দিতে দিতে দেখা যাবে তার আমলের সব সওয়াব ফুরিয়ে গেছে, পাওনাদের দেওয়ার মতো আর কিছু নেই। তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পাওনাদার, অর্থাৎ যাদের সঙ্গে সে অন্যায় করেছে তাদের গুনাহগুলো এনে তার আমলনামায় তুলে দেবেন। তারপর তার পাপের বোঝা পূর্ণ করে তাকে নিক্ষিপ্ত করবেন লেলিহান আগুনের জাহান্নামে। মানুষের হক বিনষ্ট করে যারা খুব দানবীর সাজে সমাজে, যারা সমুদ্রের পাড়ে তোশক বিছিয়ে, গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে কপাল ঠেকিয়ে সালাত আদায় করে, বড় গরু দিয়ে কোরবানী করে, বাইতুল্লাহর গিলাফ ধরে ছবি তুলে দুনিয়াকে জানান দেন যে তারা খুব ওলি-আউলিয়া হয়ে গেছেন, তাদের জন্য এ হাদিসটা অশনিসংকেত। সুতরাং, সাধু সাবধান।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ