ইসলামে দুই ধরনের হকের কথা আমরা জানি। হক্কুল্লাহ তথা আমঠাহর হক এবং হক্কুল ইবাদ তথা বান্দার হক। আল্লাহর হক যেমন— তাওহীদ, ইবাদত, কোরআন সুন্নাহর অনুসরণ, তাওবা-ইস্তিগফার ইত্যাদি। বান্দার হক যেমন— পারস্পরিক লেনদেন, আচার-ব্যবহার, ন্যায়বিচার, সমতা রক্ষা, পরিবার ও প্রতিবেশির অধিকার ইত্যাদি। কেউ আল্লাহর হক নষ্ট করলে সরাসরি আল্লাহতায়ালার কাছে ক্ষমা চাইতে হয়। পক্ষান্তরে কেউ বান্দার হক নষ্ট করলে প্রথমে যার হক নষ্ট করা হয়েছে তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। তারপর আল্লাহতায়ালার কাছে। বান্দার হক খুব স্পর্শকাতর একটি বিষয়। চোগলখোরী করাও বান্দার হক নষ্ট করার অন্তর্ভুক্ত। চোগলখোরী সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসে সতর্কবাণী এসেছে। ইসলামে চোগলখোরীকে গোনাহের কাজ এবং হারাম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
চোগলখোরীর পরিচয়
মানুষের মাঝে দ্বন্দ বিভেদ ছড়াতে কোনো কথা এক বৈঠক থেকে অপর বৈঠকে পাচার করা অথবা একজনের কথা অন্যজনের কাছে বলে বেড়ানোই হচ্ছে চোগলখোরী। ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমি কি তোমাদের জানাবো চোগলখোরী কী? চোগলখোরী হচ্ছে, ‘মানুষের মাঝে (বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে) কথা চালাচালি করা।’ (মুসলিম : ২৬০৬)
মানুষ কেন চোগলখোরী করে?
ব্যক্তিভেদে চোগলখোরীর বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। তবে অধিকাংশ সময় মানুষের এসব কথা চালাচালির কারণ থাকে— যার ব্যাপারে বদনাম রটানো হয় তার ক্ষতি করা, অন্যের কাছে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করা বা নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করা অথবা দুনিয়াবী সুযোগ-সুবিধা লাভ কিংবা ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করা।
চোগলখোরী একটি জঘন্য অপরাধ
চোগলখোরী খুবই নিন্দনীয় কাজ। কোরআন-হাদিসের বর্ণনানুযায়ী এটি হারাম। এর মাধ্যমে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে ফেতনা-ফাসাদ এবং অশান্তি সৃষ্টি হয়। ভ্রাতৃত্ব ও আত্মীয়তার বন্ধনে ফাটল ধরে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা চোগলখোরীর বিষয়টি তুলে ধরে তা থেকে বিরত থাকার এবং চোগলখোরের কথা বিশ্বাস না করার উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘আর অনুসরণ কোরো না তার; যে কথায় কথায় শপথ করে; যে লাঞ্ছিত। পেছনে নিন্দাকারী; যে একের কথা অপরের কাছে বলে বেড়ায়।’ (সুরা ক্বলাম : ১০-১১)।
হাদিসের বর্ণনায়ও এরা নিকৃষ্ট। পরকালে সবচেয়ে খারাপ লোকদের সঙ্গে তারা উঠবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন সবচেয়ে খারাপ লোকদের মধ্যে ওই ব্যক্তিকেও দেখতে পাবে— যে ছিল দু’মুখো; যে একজনের কাছে এক কথা অন্যজনের কাছে ভিন্ন কথা নিয়ে হাজির হতো।’ (মুসলিম : ৪৭)।
মানবজীবনে এর কুপ্রভাব
এটি এমন একটি অপরাধ যা চোগলখোরকে জাহান্নামী বানায়। ভ্রাতৃত্ব নষ্ট করে। সমাজে বিশৃঙ্খলা ও বিভক্তি সৃষ্টি করে। চোগলখোরী কপটতা, সংকীর্ণতা ও অন্তরের কদর্যতা প্রমাণ করে। অন্যের প্রতি খারাপ ধারণার জন্ম দেয়। কখনো কখনো অন্যের রিজিক থেকে বঞ্চিত হবার কারণও হয়। সময়ের অপচয় হয়। কবরে আযাবের কারণ হয়। বৃষ্টি বর্ষণের অন্তরায় হয়। সবশেষে চোগলখোরের দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ই বরবাদ হয়।
যার কাছে চোগলখোরী করা হবে তার করণীয়
তার কথা বিশ্বাস না করা এবং তাকে অনুসরণ না করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! যদি কোনো ফাসেক তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা যাচাই করে নাও। এ আশঙ্কায় যে, তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো কওমকে আক্রমণ করে বসবে, ফলে তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে।’ (সুরা হুজুরাত: ৬)। অন্যত্র আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘আর তুমি আনুগত্য কোরো না ওই ব্যক্তির যে অধিক কসমকারী, লাঞ্ছিত। পেছনে নিন্দাকারী ও যে চোগলখোরী করে বেড়ায়, ভালো কাজে বাধাদানকারী, সীমালঙ্ঘনকারী অপরাধী।’ (সুরা ক্বলম: ১০-১২)।
এ ধরনের কাজ থেকে তাকে বারণ করা, উপদেশ দেওয়া এবং তার এমন কাজের নিন্দা করা।
যার বিষয়ে কুৎসা রটানো হয় তার ব্যাপারে খারাপ ধারণা না রাখা।
শোনা কথার পরিপ্রেক্ষিতে গোয়েন্দাগিরী বা নজরদারী না করা। কারণ চোগলখোরের কথা বিশ্বাস করা চোগলখোরীর চেয়েও নিকৃষ্ট।
চোগলখোরের পরিণাম
চোগলখোরের পরিণাম ভয়াবহ। চোগলখোরী কবিরা গুনাহ। আর একটি কবিরাহ গুনাহ-ই জাহান্নামে যাবার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহর রাসুল (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘চোগলখোর ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বুখারি : ৬০৫৬; মুসলিম : ১০৫)। রাসুলুল্লাহ (সা.) একদিন মদিনার একটি খেজুর বাগান দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেখানে তিনি দুই ব্যক্তির আহাজারী শুনতে পেলেন। তখন তাদেরকে কবরে শাস্তি দেয়া হচ্ছিল। প্রিয়নবী (সা.) বললেন, ‘এ দু’জনকে বড় কোনো কারণে আজাব দেয়া হচ্ছে না। তাদের একজন পেশাব থেকে পবিত্রতা অর্জন করত না; আর অন্যজন চোগলখোরী করে বেড়াত।’ (বুখারী : ৬০৫৫; মুসলিম : ২৯২)। এ ধরনের কাজে কেবল ইতর ও নিকৃষ্ট প্রকৃতির মানুষই জড়িত হয়। যদি সে জানত যে, তার চোগলখোরী বা কুৎসা রটনার মাধ্যমে যে বিষ সমাজে ছড়াচ্ছে তা তার নিজের, আত্মীয়স্বজনের ও বন্ধুবান্ধবের কত ক্ষতি করছে, তাহলে সে চোগলখোরী ও কুৎসা রটানোর চেয়ে বোবা হয়ে জীবনযাপন করাকেই অধিক স্বাচ্ছন্দ্যময় ও তৃপ্তিদায়ক মনে করত।
এ জঘন্য পাপ থেকে বাঁচার উপায়
একজন মুসলমান চোগলখোরী থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে—
চোগলখোরীর শাস্তি ও কুপ্রভাব সম্পর্কে জানুন। রাগ সংবরণ করার চেষ্টা করুন। নিজের জিহ্বাকে হেফাজত করুন। প্রিয় নবীজী (সা.) বলেছেন— ‘যে চুপ থাকে সে নাজাত পায়।’
অন্যের দোষ খোঁজা বন্ধ করুন। অন্যের সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখুন।
অবসর সময়ে নেক কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন।
সৎসঙ্গ অবলম্বন করুন। নবী (সা.), সাহাবা, তাবেয়ী ও সৎলোকদের আচরণবিধি অনুসরণ করুন।
প্রতিটি কথা বলার আগে এই চিন্তা করুন— এ কথা বলার দ্বারা আমার আখেরাতে কী কী ফায়দা হতে পারে। সর্বদা মানুষের কল্যাণ কামনা করুন।
অবশেষে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে গুনাহ থেকে বাঁচার প্রার্থনা করতে থাকুন।
পরিশেষে...
চোগলখোরী করা হারাম এবং বড় গোনাহের কাজ। হাদিসের পরিভাষায়ও চোগলখোরী কবিরা গোনাহ এবং জান্নাতের অন্তরায়। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সব পর্যায়ে চোগলখোরী পরিহার করা প্রত্যেক মুসলমানের একান্ত কর্তব্য।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ