ঢাকা, সোমবার, ১ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১, ২৪ জিলহজ ১৪৪৫

পরিবেশ সংরক্ষণে ইসলাম

প্রকাশনার সময়: ২৫ জুন ২০২৪, ২১:৫৫

ইসলামকে বলা হয় স্বভাবগত বা প্রকৃতির ধর্ম। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ মূলত সামাজিক জীব। মানুষকে ঘিরেই পরিবেশ-প্রকৃতি ও সমাজের সৃষ্টি। আর পরিবার, পরিবেশ ও সমাজ নিয়ে ইসলামের পরিবেশগত চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারীমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের জন্য নিদর্শন একটি মৃতভূমি। আমি একে সঞ্জীবিত করি এবং তা থেকে উৎপন্ন করি শস্য, তারা তা ভক্ষণ করে। আমি তাতে উৎপন্ন করি খেজুর এবং প্রবাহিত করি ঝর্ণাধারা, যাতে তারা ফল খায়।’ (সুরা ইয়াসিন: ৩৩)

পরিবেশের বাহ্যিক আরেকটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হচ্ছে আলো। কোরআনে কারীমে আলো-আঁধার, দিন-রাত সম্পর্কে অনেক আয়াত রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা কি অনুধাবন করে না যে, আমি রাত সৃষ্টি করেছি তাদের বিশ্রামের জন্য এবং দিনকে করেছি আলোকিত। এতে মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা নামল: ৮৬)

পরিবেশ সুস্থ, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখতে রয়েছে ইসলামের তাকিদ। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের ধ্বংস নিজেরা ডেকে এনো না।’ (সুরা বাকারা: ১৯৫) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুণ সমুদ্র ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে।’ (সুরা আর-রুম: ৪১)

পরিবেশ দূষণ থেকে বাঁচতে হলে পরিচ্ছন্নতা অপরিহার্য। কোরআনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা সম্পর্কে অনেকবার বলা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং যারা পবিত্র থাকে তাদেরও।’ (সুরা বাকারা: ২২২)

আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা এবং জীব জগতের অস্তিত্ব রক্ষায় বৃক্ষ সৃষ্টি করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি বিস্তৃত করেছি ভূমিকে ও তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং উৎপন্ন করেছি নয়নাভিরাম বিবিধ উদ্ভিদরাজি। এটি আল্লাহর অনুরাগী বান্দাদের জন্য জ্ঞান ও উপদেশস্বরূপ।’ (সুরা কাফ: ৭-৮)

সমগ্র সৃষ্টি জগতের কল্যাণের জন্য আল্লাহপাক পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি করেছেন। ভূমিকম্প কিংবা অন্য কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যাতে মানুষকে নিয়ে এ পৃথিবী নড়াচড়া করতে না পারে। সেজন্য আল্লাহ তায়ালা পাহাড়সমূহকে পেরেকের মতো গেড়ে দিয়েছেন বলে ইরশাদ করেছেন, এবং তিনি পৃথিবীতে সুদৃঢ় পর্বত স্থাপন করেছেন যাতে পৃথিবী তোমাদের নিয়ে আন্দোলিত না হয়।’ (সুরা আন-নাহল: ১৫)

আমরা জানি, গাছ মানুষ ও পরিবেশের অকৃত্রিম বন্ধু। সবুজ গাছপালার ওপরই নির্ভর করে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর টিকে থাকা। এই গাছ ইচ্ছে হলেই কাটা যাবে না। কারণ ‘গাছের প্রাণ আছে’- এটা হাদীসের বাণী। হাদীসে রাসুল (সা.) থেকে জানা যায়, এক লোক যখন অকারণে একটি গাছের ডাল ভাঙে তখন নবী করীম (সা.) সে লোকটির চুল মৃদুভাবে টান দিয়ে বলেন, তুমি যেমন শরীরে আঘাত পেলে ব্যথা পাও, গাছের পাতা বা ডাল ছিঁড়লে গাছও তেমন ব্যথা পায়।

পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য গাছ লাগানোর শিক্ষা আমরা মহানবী (সা.)-এর হাদীস থেকে পাই। তিনি বলেছেন, ‘যদি তুমি মনে করো আগামীকাল কিয়ামত হবে, তবু আজ একটি গাছ লাগাও।’

সুন্দর ও শৃঙ্খলাপূর্ণ সামাজিক পরিবেশ গঠনে খালবিল, পুকুর-ডোবা, রাস্তাঘাট পরিষ্কার থাকা অপরিহার্য। মানুষের প্রতি নবী (সা.) বলেছেন, ‘ঈমানের ৭৩টি শাখা, তন্মধ্যে সর্বোত্তমটি হলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আর সর্বনিম্নটি হলো, রাস্তা থেকে ক্ষতিকারক বস্তু দূরীভূত করা।’

জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) পানিতে প্রস্রাব করতে নিষেধ করেছেন। মোয়াজ বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা লানত পাওয়ার তিনটি কাজ অর্থাৎ পানির ঘাট, রাস্তার মাঝে এবং বৃক্ষের ছায়াতলে মলত্যাগ থেকে বিরত থাক।’

বায়ু দূষিত হয়ে এক জনের রোগ অন্যজনের কাছে স্থানান্তর হয়। আমরা অনেক সময় হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় মুখ ঢাকি না। এতে করে নির্গত ময়লা ও জীবাণু দ্বারা অন্যের ক্ষতি হতে পারে। আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, ‘রাসুল (সা) যখন হাঁচি দিতেন, তখন তিনি মুখ ঢেকে নিতেন।’

অগ্নিকাণ্ডের ফলে পুড়ে যায় দালানকোঠা, ঘরবাড়ি, দোকানপাট অনেক কিছু। সেখান থেকে নির্গত ধোঁয়া পরিবেশ দূষিত করে। অগ্নিকাণ্ডে এমন সব পদার্থ পুড়ে বাতাসে মিশে যা স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য হানিকর। ধূমপানের মাধ্যমেও বায়ু তথা পরিবেশ দূষিত হয়। পোড়া তামাকের গন্ধ পরিবেশের জন্য কতখানি ক্ষতিকর তা নিয়ে বিজ্ঞানীরাও শঙ্কিত।

বস্তুত এই পৃথিবী নামক ছোট গ্রহে জীবের বেঁচে থাকার জন্য সব উপাদান দিয়ে আল্লাহ তায়ালা পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের নানাবিধ অত্যাচারে পৃথিবীর পরিবেশ দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ফলে জীবের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার পরিবেশ হারাচ্ছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

পরিবেশ সংকট উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। ইসলাম উন্নয়নের ক্ষেত্রে বস্তুগত ও আত্মিক উন্নয়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করে। পরিবেশ সুরক্ষায় গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে ইসলামের শিক্ষা ও মূল্যবোধ বহুলাংশে সহায়ক। আমাদের বাড়িঘর কিংবা শিক্ষাঙ্গনের আশেপাশে এবং রাস্তাগুলো কি অপরিষ্কার ও নোংরা হয়ে আছে, ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে আছে এখানে-ওখানে, আমরা কি চাইলে রাসুল (সা.)-এর সত্যিকারের উম্মত হিসেবে নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে এসব পরিষ্কার করতে পারি না?

আমাদের চারপাশে তাকালে দেখা যায়, নিছক অসতর্কতা ও বেখেয়ালে এখানে-ওখানে পানের পিক, কলার খোসা, বাদামের খোসা আর মুড়ির ঠোঙ্গা ফেলে ময়লা করছি নিজেদের পরিবেশ। এতে শুধু আমাদের চারপাশ নোংরা হচ্ছে না, কলুষিত হচ্ছে আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যও।

প্রযুক্তি আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে এর চেয়েও অনেক বেশী। প্রযুক্তি বিপ্লবের এ সময়ে অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে দিন দিন আমরা গাছপালা ও অরণ্য হারাচ্ছি। ফলে একদিকে পরিবেশে কার্বন-ডাই অক্সাইড বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে দেখা দিচ্ছে খাদ্য সংকটও। যা আমাদের ঠেলে দিচ্ছে ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দিকে। এভাবে দূষিত পরিবেশ ও বদলে যাওয়া বিরূপ জলবায়ু হয়ে উঠছে আমাদের প্রধান শত্রু। দূষণে দূষণে আজ উত্তপ্ত পৃথিবী, অতিষ্ঠ বিশ্ববাসী।

আমি অনেকের মুখে এমন কথাও শুনেছি, ধুর এসব গবেষণা ও ভাবনা দিয়ে কিছুই হবে না। আল্লাহর দুনিয়া আল্লাহ-ই বাঁচিয়ে রাখবেন। এ নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথার কিছু নেই। ওই দায়িত্ব আমাদের না।’ আহা বেচারা! একটু সজাগ হয়ে দেখুন, কোরআন কিন্তু অন্য কথা বলছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহপাক কোনো জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তনের সূচনা না করে।’ (সুরা রাদ: ১১)

এ সুজলা সুফলা সবুজ পরিবেশ আল্লাহ পাকের দান। আমাদের জন্যই তিনি এসব সৃজন করেছেন এবং এসবের শুকরিয়া আদায় করতে বলেছেন। তাই আমাদের সবার দায়িত্ব যার যার অবস্থানে থেকে পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা পালন করা।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ