নিশ্চয় আল্লাহর অনুগ্রহমূলক দান রয়েছে- তা গ্রহণে অগ্রসর হোন, কল্যাণময় মৌসুম রয়েছে- তা অন্বেষণ করুন এবং ফজিলতপূর্ণ বহু সময় রয়েছে- তাতে মনোনিবেশ করুন; ইতোমধ্যে এগুলো আপনাদের মাঝে আগমন করেছে- আপনারা তা সাদরে গ্রহণ করুন ও কাজে লাগান।
জেনে রাখুন, আপনারা এখন অবস্থান করছেন বছরের সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ সময় জিলহজের প্রথম দশকে; এ দিনগুলোতে আল্লাহ তায়ালা এমন সব ইবাদতের সমাহার ঘটিয়েছেন যা অন্য কোনো মৌসুমে পাওয়া যায় না। সালাত, সিয়াম, হজ, সদকা ইত্যাদি আমলগুলোকে এ মৌসুমে সন্নিবেশিত করেছেন। এ দিনগুলোর শপথ করে আল্লাহ তায়ালা কোরআনুল কারীমে বলেন, ‘শপথ ফজরের। শপথ দশ রাতের।’ (সুরা আল-ফজর: ১-২)
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, ‘এ দিনগুলোর তুলনায় এমন কোনো দিন নেই যাতে কোনো সৎ আমল আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়। অর্থাৎ জিলহজের প্রথম ১০ দিন- লোকেরা বলল, আল্লাহর পথে জিহাদও নয় কি? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়, তবে কোনো ব্যক্তি যদি তার জানমালসহ জিহাদ করতে বের হয়ে যায় এবং এর কোনো কিছুই নিয়ে আর ফিরে না আসে।’ (বুখারি) জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘দুনিয়ার সবচেয়ে উত্তম দিন হচ্ছে জিলহজের প্রথম দশ দিন।’ (মুসনাদে বাযযার)
আল্লাহর বান্দাগণ! নিশ্চয় আল্লাহ আপনাদের জন্য কিছু কল্যাণময় মৌসুম নির্ধারণ করেছেন, কাজেই আপনারা তা মূল্যায়ন করুন। তিনি কিছু সৎকাজের সৌরভময় মুহূর্ত দিয়েছেন, আপনারা সেদিকে অগ্রসর হোন। এ দিনগুলো সুনির্দিষ্ট যা ফজিলত ও বরকতে ভরপুর। মুমিনের উচিৎ তা মূল্যায়নে অগ্রগামী হওয়া এবং সময়গুলোকে বিনষ্ট না করা।
কাজেই আপনারা সময় ফুরানোর আগেই সৎ আমল পালনে দ্রুত অগ্রসর হোন এবং জবাবদিহিতার সম্মুখীন হওয়ার আগে আত্মপর্যালোচনা করুন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা উত্তম কাজের যা কিছু নিজেদের জন্য পেশ করবে আল্লাহর কাছে তা পাবে।’ (সুরা আল-বাকারা: ১১০) তিনি আরো বলেন, ‘আর তোমরা তীব্র গতিতে চল নিজেদের রবের ক্ষমার দিকে এবং সে জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমানসমূহ ও জমীনের সমান, যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য। যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করে, যারা ক্রোধ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল; আর আল্লাহ মুহসিনদেরকে ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৩৩-১৩৪)
আল্লাহর বান্দাগণ! একটি শ্রেষ্ঠ ও সুন্নাতে মুআক্কাদার (হানাফী মাজহাব মতে ওয়াজিব) পর্যায়ভুক্ত ইবাদত হলো কোরবানী করা। কোরবানী বলতে যেসব চতুষ্পদ জন্তু কোরবানীর ঈদের দিনে জবাই করা হয়; এতে রয়েছে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন এবং নিজের ও পরিবারের প্রতি উদারতা প্রদর্শন। এটা আনন্দ ও খুশী উদযাপনের বাহ্যিক নিদর্শন; নবী (সা.) এর প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং নিজেও গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই তিনি নিজের ও পরিবারের পক্ষ থেকে কোরবানী করতেন।
যে ব্যক্তি কোরবানী করার মনস্থির করে, সে যেন জিলহজের এ দশক শুরু হলে চুল, চামড়া ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে। উম্মে সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির নিকট কোরবানীর পশু আছে সে যেন জিলহজের নতুন চাঁদ দেখার পর থেকে কোরবানী করা পর্যন্ত তার চুল ও নখ না কাটে।’ (মুসলিম)
হে মুসলমানগণ! জিলহজের প্রথম দশ দিন তাসবীহ পাঠ ও আল্লাহর জিকির আজকার করার গুরুত্বপূর্ণ সময়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যাতে তারা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে।’ (সুরা আল-হজ্জ: ২৮) ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, ‘এ দশ দিনের আমলের চেয়ে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় ও মহান কোনো আমল নেই। কাজেই তোমরা এ সময়ে বেশী বেশী তাসবীহ- সুবহানাল্লাহ, তাহলীল- লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ, তাকবীর- আল্লাহু আকবার এবং তাহমীদ আলহামদুলিল্লাহ পাঠ কর।’ (মুসনাদে আহমাদ)
সুতরাং হে আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা বেশী বেশী তাসবীহ, তাহমীদ, তাহলীল ও তাকবীর পাঠ করুন। আপনারা আল্লাহকে স্মরণ করুন, তিনিও আপনাদেরকে স্মরণ করবেন এবং তাঁর শুকরিয়া আদায় করুন, তাহলে তিনি আরো বাড়িয়ে দেবেন। ‘নিশ্চয় আল্লাহর স্মরণই তো শ্রেষ্ঠ। আর তোমরা যা কর আল্লাহ তা সম্যক অবহিত।’
দ্বিতীয় খুতবা
হে মানবসকল! নিশ্চয় হারামাইন শরীফাইন হলো পৃথিবীর বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম স্থান; যেখানে পৃথিবীর সব স্থান থেকে হাজী, ওমরা পালনকারী ও জিয়ারতকারীগণ আল্লাহর ইবাদত পালন এবং হজ সম্পাদনের জন্য আগমন করেন। হাজীদের খেদমত করা একটি বড় নিয়ামত। আল্লাহ তায়ালা এ বরকতময় দেশ রাজকীয় সৌদি আরবের ওপর এ নিয়ামত দান করেছেন। এর শাসকদেরকে পবিত্র বায়তুল্লাহর খাদেম নামে অভিহিত করা হয়। এটি একটি উপযুক্ত মহান মর্যাদা। আল্লাহ তায়ালার আহ্বানে সাড়া দিয়ে এ বরকতময় দেশ পবিত্র বায়তুল্লাহর হাজীদের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে, তিনি বলেন, ‘আর স্মরণ করুন, যখন আমি কাবাঘরকে মানব জাতির মিলনকেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল করেছিলাম এবং বলেছিলাম, তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থানরূপে গ্রহণ করো।’ (সুরা আল-বাকারা: ১২৫)
বর্তমান সময়ে এই পবিত্র স্থানে যে পরিমাণ হাজী, ওমরা পালনকারী এবং জিয়ারতকারীকে ধারণ করছে যুগ যুগ ধরে ইতিহাসে এ পরিমাণ ধারণ করেনি। এর সঙ্গে তাদের প্রদান করা হচ্ছে নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, অন্যান্য সেবাসমূহ, হজ ও ইবাদত পালনে সহযোগিতা এবং শিক্ষণীয় ও দিকনির্দেশনামূলক প্রোগ্রাম, সফর ও হজের উদ্দেশ্যে তাদের দেশ থেকে ভ্রমণ-প্রক্রিয়া সহজীকরণ; যেন তারা তাদের ইবাদত সহজভাবে ও প্রশান্তির সঙ্গে আদায় করতে পারে।
এ বরকতময় দেশের ওপর আল্লাহ যে শান্তি, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি দান করেছেন, এজন্য আমরা তাঁর প্রশংসা করছি এবং এ দেশের শাসকগণের জন্য দোয়া করছি- তারা হারামাইন শরীফাইন ও তাতে আগমনকারী হজ, ওমরা ও জিয়ারত পালনকারীদের প্রতি যে খেদমতের আঞ্জাম দিচ্ছেন সেজন্য। আল্লাহ তায়ালা খাদেমুল হারামাইন শরীফাইন ও তার নায়েবকে এ মহান প্রচেষ্টার জন্য এবং হারামাইনের খেদমত ও তাতে আগমনকারীদের প্রতি সেবা প্রদানের জন্য উত্তম বিনিময় দান করুন।
সব দায়িত্বশীল এবং এ প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণকারী নিরাপত্তাকর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী ও সব সেক্টরের কর্মীদেরকে আল্লাহ তায়ালা উত্তম বিনিময় দান করুন। সৌভাগ্যবান তারা যারা মক্কা মুকাররমা ও মসজিদে নববীর উপত্যকায় এ সাফল্য বাস্তবায়নে নিরলস প্রচেষ্টা করেছে। তাদের জন্য হাজীদের খেদমত করার মর্যাদা লাভ অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয়।
বায়তুল্লাহর হজযাত্রীগণ! হজ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বার; যা আল্লাহ তায়ালা শরীয়তসম্মত করেছেন এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত স্থান ও কালকে মর্যাদাসম্পন্ন করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হজ হয় নির্ধারিত মাসগুলোতে। অতঃপর কেউ যদি এ মাসগুলোতে হজ করার সংকল্প করে, তাহলে সে হজের সময়ে স্ত্রী-সহবাস, অন্যায় আচরণ ও ঝগড়া-বিবাদ করবে না। আর তোমরা উত্তম কাজ থেকে যা-ই কর আল্লাহ তা জানেন। আর তোমরা পাথেয় সংগ্রহ কর। নিশ্চয় সবচেয়ে উত্তম পাথেয় হচ্ছে তাকওয়া। হে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ! তোমরা আমারই তাকওয়া অবলম্বন কর।’ (সুরা আল-বাকারা: ১৯৭)
আল্লাহর বান্দাগণ! হজ হচ্ছে ইসলামের অন্যতম মহান নিদর্শন। এ নামেই আল্লাহ তায়ালা সুরা আল-হজ্জ নাজিল করেছেন ও তাতে অনেকগুলো আয়াত নাজিল করেছেন। অতএব, হে বাইতুল্লাহর হজ সম্পাদনকারীগণ! আপনাদেরকে অভিনন্দন; আল্লাহ তায়ালা আপনাদেরকে তাঁর বিশেষ ফরজ ইবাদত পালনের সুযোগ দিয়েছেন ও তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয়ার তৌফিক দিয়েছেন। ‘বলুন, এটা আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়ায়। অতএব তোমরা এটাতে খুশী হও। তোমরা যা পুঞ্জীভূত করে রাখ তার চেয়ে এটা উত্তম।’ (সুরা ইউনূস: ৫৮)
আপনাদেরকে অভিনন্দন; কেননা আল্লাহ তায়ালা আপনাদের প্রতি অনুগ্রহ করে হজকে আপনাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন এবং আপনাদেরকে ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই নিদর্শন পালনের জন্য মনোনীত করেছেন। আপনাদেরকে স্বাগতম; আপনারা অচিরেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ভূখণ্ড বায়তুল্লাহিল হারামে এবং হজের কার্যাদি সম্পাদনের জন্য পবিত্র স্থান ও নিদর্শনাবলীতে আগমন করবেন।
আপনাদেরকে স্বাগতম; আপনারা অচিরেই আরাফার ময়দানে ফিরবেন। সেদিন আল্লাহ তায়ালা আপনাদেরকে নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলবেন, “দেখ, আমার বান্দারা দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে এলোমেলো চুলে ও ধুলোমলিন হয়ে আমার কাছে এসেছে। আমি তোমাদেরকে সাক্ষী রেখে বলছি, নিশ্চয় আমি তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম।” (আল-ফাওয়ায়েদ)
আপনাদেরকে স্বাগতম; আপনারা এমন একটি ইবাদতের মুখোমুখি যা দ্বারা গুনাহগুলো মিটিয়ে ফেলা হয়, ভুল-ত্রুটি মাফ করা হয়, সম্মান বৃদ্ধি করা হয় এবং দোয়া কবুল করা হয়।
বায়তুল্লায় হজ সম্পাদনেচ্ছুকগণ! আপনারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করুন; হজের যাবতীয় কার্যাদি ও ইবাদত পালনে পূর্ণ মনোযোগী হোন। অহেতুক কথা, কাজ ও আল্লাহর অবাধ্যতা ইত্যাদি যেগুলো আপনাদের মূল্যবান সময়কে নষ্ট করে, তা থেকে বিরত থাকুন। কাজেই হজের সময়ে স্ত্রী-সহবাস, অন্যায় আচরণ ও ঝগড়া-বিবাদ করা যাবে না। প্রত্যেক আমলে নিয়ত বিশুদ্ধ রাখার প্রচেষ্টা করুন, সুন্নাত গ্রহণ ও বিদআত বর্জনে আন্তরিক হোন। কেননা আল্লাহ যা তাঁর নবীর মাধ্যমে শরীয়তসম্মত করেছেন এবং যা শরয়ী মানহায মোতাবেক, একমাত্র সে অনুযায়ীই আল্লাহর ইবাদত করা হবে। কাজেই যে ব্যক্তি এমন আমল করল যার স্বপক্ষে আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর নির্দেশনা নেই, তা পরিত্যাজ্য হবে। তাছাড়া মহান আল্লাহ সে আমল কবুল করেন না যাতে অণু পরিমাণ শিরক থাকে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আমি অংশীদার স্থাপনকারীদের শিরক থেকে মুক্ত। যদি কেউ কোনো আমল করে, আর তাতে আমি ছাড়া অন্য কাউকে শরীক করে, তবে আমি তাকে এবং তার শিরকী কাজকে প্রত্যাখ্যান করি।’ (মুসলিম) অতএব আপনারা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করুন এবং কাউকে তাঁর সঙ্গে শরীক স্থাপন করবেন না। বায়তুল্লাহর হজযাত্রীগণ! আপনারা নিয়ম ও নির্দেশনা মেনে চলুন যা আপনাদের প্রতি আরো ভালো সেবা প্রদানে সহায়ক হবে, কার্যক্রম পরিচালনায় সহজ হবে। আপনারা নিজেদের প্রতি যত্নশীল হোন, নিয়ম ভঙ্গ করা থেকে বিরত থাকুন এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত দিকনির্দেশনা মেনে চলুন। আল্লাহ তায়ালা আপনাদেরকে হেফাজতে রাখুন এবং সর্বদায় আপনারা তাঁর তত্ত্বাবধান ও হেফাজতে থাকুন। আল্লাহ তায়ালা আপনাদের ইবাদতকে কবুল করুন এবং নিজ পরিবারের কাছে বিজয়ী বেশে নিরাপদে ফিরিয়ে নিন।
৭ জুন ২০২৪ মদিনার মসজিদে
নববীতে দেয়া জুমার খুতবার
অনুবাদ হারুনুর রশীদ ত্রিশালী
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ