ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

হজে মনীষীদের আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ

প্রকাশনার সময়: ১২ জুন ২০২৪, ০৮:৩৯

হজ তো অনেকেই করে, কিন্তু সবার হজ প্রেমময় হয় না। সবার হজ মাবরুর হয় না। হজ সবাইকে নিষ্পাপ বানায়। হজের মতো হজ হলেই কেবল সব ফজিলত প্রাপ্তি ঘটে। সেই হজ কেমন? এটা আপনি বুঝবেন ইসলামের পুণ্যবান পূর্বসূরীদের হজের বিবরণ পড়লে। পড়ে দেখুন—

ইহরাম বাঁধা: ঈমান ও ইয়াকীনে পূর্ণ হূদয়ের অনুভূতি

১. আলী ইবনুল হুসাইন যখন ইহরামের কাপড় পরে বাহনে উঠে বসলেন তখন ভয়ে তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি কাঁপছিলেন। ভয়ের আতিশয্যে তালবিয়া পর্যন্ত পড়তে পারছিলেন না। জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার কী হলো, তিনি বললেন- ’আমার ভয় হচ্ছে, আমি লাব্বাইক (হে আল্লাহ! আমি হাজির) বললাম আর এর উত্তরে বলা হলো, লা লাব্বাইক ওয়া লা সা’দাইক (তুমি হাজির নও, তুমি ভাগ্যবান নও)’।

আবার তালবিয়া পাঠের চেষ্টা করলেন; কিন্তু এবার উট থেকে পড়ে বেহুঁশ হয়ে গেলেন। শরীরে প্রচণ্ড আঘাত পেলেন। পুরো হজজুড়ে তাঁর মধ্যে এ ভয় কাজ করে। -তারীখে দিমাশক ৪১/৩৭৮; সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৪/৩৯২; তারীখুল ইসলাম, যাহাবী ২/১১৪৪

২. মালিক বিন দিনার (রহ.) ইহরামের কাপড় পরে তালবিয়া পড়তে চাইলেন, কিন্তু ভয়ে তিনি উট থেকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে আবারো তালবিয়া পড়তে চাইলেন, এবারও পড়ে জ্ঞান হারালেন। বলা হলো কী হলো আপনার?

তিনিও বললেন- ‘আমার ভয় হচ্ছে, আমি লাব্বাইক বললাম, আর এর উত্তরে বলা হলো, লা সা’দাইক (তুমি ভাগ্যবান নও)।’ -তারীখে দিমাশক ৫৬/৪১২; তারীখুল ইসলাম, যাহাবী ৬/২৪৮

৩. কাজী শুরাইহ (রহ.)-এর ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে- কাজী শুরাইহ (রহ.) যখন ইহরাম বাঁধতেন তখন এত চুপচাপ, চিন্তামগ্ন ও আল্লাহমুখী থাকতেন যে, তাঁকে বধির সাপের মতো মনে হতো; যেন আশপাশের কোনো কিছু শুনতে পান না। -আততবাকাতুল কুবরা, ইবনে সা’দ ৬/১৯০; সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৪/১৪০

আরাফার মাঠে অবস্থান

কান্না ও রোনাজারির চিত্র

১. হাকীম ইবনে হিযাম (রা.) এক শত পশু ও এক শত গোলাম সাথে নিয়ে আরাফার মাঠে অবস্থান করতেন। তিনি (পশুগুলোকে আল্লাহর রাস্তায় জবাই করে দিতেন আর) গোলামগুলোকে আযাদ করে দিতেন। তাঁর অবস্থা দেখে মানুষ দোয়া ও কান্নায় লুটিয়ে পড়ত আর বলত- ‘হে আমাদের রব! সে (হাকীম ইবনে হিযাম) আপনার গোলাম হয়েও তাঁর গোলামদের মুক্ত করে দিয়েছে। আমরা আপনার গোলাম, আপনি আমাদের জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দিন।’ -সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৩/৫০; লাতায়িফুল মাআরিফ ১/২৮৪

২. ফুযাইল ইবনে ইয়ায (রহ.) আরাফার মাঠে স্বামীহারা অসহায় মহিলোার ন্যায় ডুকরে কাঁদছিলেন। মানুষ দোয়া-মুনাজাত করছিল। ফুযাইল (রহ.) কান্নাকাটি করেই যাচ্ছিলেন। আরাফা থেকে প্রস্থানের সময় হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কান্নার প্রাবল্যে দোয়া-মুনাজাত পর্যন্ত করতে পারছিলেন না। -সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৭/৪০০; লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা ৬৩০

আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলী (রহ.) বলেন- বকর আলমুযানী ও মুতাররিফ ইবনে আব্দুল্লাহ আরাফায় অবস্থান করছিলেন। তাদের একজন বলছিলেন, হে আল্লাহ! মেহেরবানি করে আমার কারণে আরাফায় অবস্থানকারীদের ক্ষমার বারিধারা থেকে বঞ্চিত করবেন না।

অপরজন বললেন, কত না মহিমান্বিত স্থান। সকলের ক্ষমাপ্রাপ্তির জন্য কত আশাব্যঞ্জক পরিবেশ, যদি আমি এখানে না থাকতাম!! -লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা ৬৩০

আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাতের ইয়াকীন ও বিশ্বাস

১. আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বলেন, আরাফার দিন সন্ধ্যায় আমি সুফিয়ান ছাওরী (রহ.)-এর কাছে এলাম। তিনি উবু হয়ে বসা ছিলেন। তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল। আমাকে দেখে ফিরে তাকালেন। আমি বললাম- এ মাজমায় সবচেয়ে হতভাগা কে?

তিনি বললেন- যে ধারণা করে, আল্লাহ তাআলা আজকের দিনেও তাকে ক্ষমা করবেন না। -হুসনুয যান্নি বিল্লাহ, ইবনে আবিদ্দুনইয়া, পৃ. ৯২; লাতায়িফুল মাআরিফ ১/২৮৭

২. ফুযাইল ইবনে ইয়ায (রহ.) আরাফার দিন সন্ধ্যায় মানুষের কান্নাকাটি ও রোনাজারীর দৃশ্য দেখে বললেন, তোমাদের কি মনে হয়, এ লোকসব যদি কোনো ব্যক্তির কাছে গিয়ে দানিক (এক দিরহামের ছয় ভাগের এক ভাগ) পরিমাণ কোনো বস্তু চায়, তবে কি সে তাদের তাড়িয়ে দেবে?

তারা বলল, না (এত ক্ষুদ্র জিনিস থেকে এ বড় জমায়েতকে) তাড়িয়ে দেবে না। তিনি বললেন- আল্লাহর শপথ, দানিক পরিমাণ বস্তু তাদের দানের চেয়েও আল্লাহ তাআলার কাছে তাদের ক্ষমা করে দেয়া আরও ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ বিষয়। (অতএব এটি কীভাবে বিশ্বাস কর যে, আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন না।) -আলমাজমু, নববী ৬/১১৬; লাতায়িফুল মাআরিফ ১/২৮৭

আলী ইবনুল মুওয়াফফাক (রহ.) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে- আলী ইবনুল মুওয়াফফাক জীবনে মোট ষাটটি হজ করেন। তিনি বলেন- ষাটতম হজের পর আমি বসে নিজের অবস্থা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিলাম। চিন্তা করছিলাম, অধিক পরিমাণে আল্লাহর ঘরে আসা তো হলো, কিন্তু জানি না এ আসা কবুল হয়েছে কিনা? এরপর ঘুমিয়ে গেলাম। স্বপ্নে দেখলাম, কেউ একজন আমাকে বলছে, আরে! তুমি তো তোমার ঘরে কেবল তাকেই দাওয়াত কর, যাকে তুমি পছন্দ কর-ভালোবাস।

(আল্লাহতায়ালা যেহেতু তোমাকে তার ঘরে আসতে দিয়েছেন, তাই তিনি তোমার হজও কবুল করেছেন ইনশাআল্লাহ) এরপর আমি সজাগ হলাম। লোকটির পরিচয় বা অন্য কিছুই আমি আর বলতে পারি না। -তারীখে বাগদাদ ১৩/৫৯৮; লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা ১৬২

আল্লাহর ঘরে এসে অন্যের কাছে চাইব?!

হযরত ওমর (রা.)-এর দৌহিত্র সালিম ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) তাওয়াফ করছিলেন। এ সময় তাঁর পাশে মাতাফে তৎকালীন শাসক হিশাম ইবনে আব্দুল মালেক অবস্থান করছিলেন। ওমর (রা.)-এর নাতির দিকে চোখ পড়তেই হিশাম তাঁর দিকে ছুটে এলেন এবং তাঁর হাত ধরে বললেন, হে সালিম, তোমার কোনো প্রয়োজন থাকলে বল। সালিম (রহ.) সাথে সাথে বলে উঠলেন- (হে আমিরুল মুমীনিন!) আল্লাহর ঘরে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে চাইতে লজ্জা হয়। -তারীখে দিমাশক ২০/৬৪; সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৪/৪৬৬

অন্য বর্ণনায় এসেছে সালিম (রহ.) এক ব্যক্তিকে আরাফার মাঠে মানুষের কাছে ভিক্ষা করতে দেখে বললেন- হে অথর্ব! আজকের দিনেও তুমি আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে চাইছ? -তারীখে দিমাশক ৪৮/৪০১; আততামহীদ ১/১২৯; আলআযকার, নববী ২/৪০০

বারবার হজের তামান্না

সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (রহ.)-এর ভাতিজা হাসান বিন ইমরান বলেন, আমি ১৯৭ হিজরীতে চাচাজানের সাথে তাঁর সর্বশেষ হজের সফরে ছিলাম। আমরা যখন মুযদালিফায় অবস্থান করছিলাম, চাচাজান নামায পড়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বললেন- এ মুবারক জায়গায় উপস্থিতির সত্তর বছর পূর্ণ হলো। প্রতি বছরই আল্লাহর কাছে এই দোয়া করি, আল্লাহ এটাই যেন আমার এখানে উপস্থিতির শেষ বছর না হয়। এবার আমার এ কথা বলতে সংকোচ হচ্ছে।

তিনি এভাবেই ফিরে যান এবং এ বছরই ১৯৮ হিজরীতে মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। -আততবাকাতুল কুবরা, ইবনে সা’দ ৬/৪১; সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৮/৪৬৫; তারীখুল ইসলাম, যাহাবী ৪/১১০

হজ অবস্থায় বা হজের পরপরই মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা

১. খাইছামা ইবনে আব্দুর রহমান বলেন- তাঁরা (সাহাবী-তাবেয়ীগণ) আকাঙ্ক্ষা করতেন যে, কোনো ভালো আমল যেমন হজ, ওমরা বা জিহাদ অবস্থায় যেন তাদের মৃত্যু হয়। -হিলোইয়াতুল আউলিয়া ৪/১১৫

২. মুহাম্মাদ ইবনে ইউছুফ, হাকাম ইবনে বুরদার কাছে এ কথা লিখে পাঠালেন- হে আমার ভাই! আল্লাহকে ভয় কর, যার পাকড়াও বড় কঠিন। ...যদি সম্ভব হয় হজের মাধ্যমেই তোমার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাবে, তাহলে তাই করবে। কারণ হজকারীর ব্যাপারে ন্যূনতম যে ফযীলত বর্ণিত হয়েছে তা হলো, হজকারী নবজাতকের মতো নিষ্পাপ হয়ে বাড়িতে ফেরেন। -হিলোইয়াতুল আউলিয়া ৮/২৩২

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ