ঢাকা, শনিবার, ৪ জানুয়ারি ২০২৫, ২০ পৌষ ১৪৩১, ৩ রজব ১৪৪৬

হজযাত্রীদের জন্য জরুরি নির্দেশনা

প্রকাশনার সময়: ০৬ জুন ২০২৪, ০৯:৪১ | আপডেট: ০৬ জুন ২০২৪, ০৯:৪৫

প্রিয় হজযাত্রী, ওমরাকারী ও দর্শনার্থীরা, আপনারা সর্বোত্তম গন্তব্যে আগমন করেছেন এবং সর্বোত্তম লাভ অর্জন করেছেন; আপনাদের চলার পথ মঙ্গলময় হোক এবং আল্লাহর রহমত আপনাদের আচ্ছন্ন করে রাখুক। আপনাদেরকে অভিনন্দন পবিত্র দেশ, উজ্জ্বল ভূমি, সুরভিত পরিবেশ এবং পবিত্র স্থান মক্কা মুকাররমা ও মদিনা মুনাওয়ারা পরিদর্শনের জন্য।

এ দু’টি পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ শহর- যেগুলো পরিদর্শনে আত্মা সৌভাগ্যবান হয়, অন্তর আন্দোলিত হয়, এ জায়গায় অবস্থান করে হূদয় আনন্দের ঢেউয়ে ভেসে যায়, প্রফুল্লতায় উজ্জীবিত হয় এবং এর বরকতে আল্লাহর বান্দারা প্রভূত কল্যাণ ও মুনাফা অর্জন করে।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তিনটি মসজিদ; মসজিদুল হারাম, আমার এই মসজিদ এবং মসজিদুল আকসা ব্যতীত অন্য কোনো মসজিদের উদ্দেশে সফর করা যাবে না।’ (বুখারি ও মুসলিম) জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে জায়গার জন্য সফর করা যায়, তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ জায়গা হলো আমার এ মসজিদ এবং প্রাচীন ঘর বায়তুল্লাহ।’ (মুসনাদে আহমাদ)

হে সম্মানিত হজ, ওমরা ও জিয়ারতকারীরা, নিশ্চয় আপনারা সুবাসস্থলে, রহমত অবতরণস্থলে, বরকত নাজিলের স্থানে এবং কল্যাণের আধারে আছেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর ঘর জিয়ারতের মনস্থির করবে এবং হজের ইহরাম পরিধান করবে, অতঃপর কোনো ধরনের অশ্লীল, অন্যায় এবং পাপের কাজে লিপ্ত না হয়ে হজ সম্পাদন করবে; তার অতীতের পাপগুলো মোচন করে দেয়া হবে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ করল এবং অশ্লীল ও পাপাচার থেকে বিরত থাকল, সে ওই দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসবে যেদিন তার মা তাকে জন্ম দিয়েছে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে আরো বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘এক উমরা থেকে আরেক ওমরা উভয়ের মধ্যবর্তী সময়ের জন্য গুনাহের কাফফারা। আর আল্লাহর কাছে কবুল হজের প্রতিদান কেবলমাত্র জান্নাত।’ (বুখারি ও মুসলিম)

হে সম্মানিত হজ, উমরা ও জিয়ারতকারীরা! আপনারা হারামাইন শরিফাইনের পবিত্রতা রক্ষা করে চলুন, এ দু’ঘরের সম্মান বজায় রাখুন, এর মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রাখুন এবং যা ইবাদত-বন্দেগীতে ব্যাঘাত ঘটায় তা থেকে বিরত থাকুন। আর অন্যায় তর্ক থেকে বিরত থাকুন এবং পারস্পরিক বিরোধ, ঝগড়া, বিচ্ছিন্নতা, বিতর্ক, মতভেদ ও বিভেদ থেকে দূরে থাকুন। আপনারা হজকে বিরোধ, বিতর্ক, ঘৃণা ও শত্রুতার চারণক্ষেত্রে পরিণত করবেন না এবং তিরস্কার, গালাগাল, স্লোগান, পক্ষপাত ও দলাদলির স্থানেও পরিণত করবেন না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হজ হয় সুবিদিত মাসগুলোতে, তারপর যে কেউ এ মাসগুলোতে হজ করা স্থির করে সে হজের সময় স্ত্রী-সম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও কলহ-বিবাদ করবে না।’ (সুরা আল-বাকারা: ১৯৭)

হে হজে আগন্তুক ব্যক্তি! ইহরাম বাঁধা ও বায়তুল্লাহতে গমনের পূর্বেই হজের বিধান সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানার্জন করুন এবং আপনার অজানা বিষয়গুলা সম্পর্কে আলেমদের জিজ্ঞাসা করুন। অনেক হজ আদায়কারী রয়েছেন যারা হজের বিধান অবগত না হয়ে হজ শুরু করেন এবং সঠিকভাবে তা সম্পন্ন করেন না। ফলে হয়তো তারা হজের কোনো রুকন ছেড়ে দেন, কোনো শর্ত বাদ দেন অথবা কোনো ফরজ পালনে অবহেলা করেন বা কোনো নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হন এবং যা থেকে বিরত থাকা উচিৎ তা করে ফেলেন। অথচ আল্লাহ হজ ও উমরাকারীকে পরিপূর্ণভাবে এর কার্যাদি আদায় করতে আদেশ করে বলেন, ‘আর তোমরা হজ ও উমরা পূর্ণ কর আল্লাহর উদ্দেশ্যে।’ (সুরা আল-বাকারা: ১৯৬)

অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোনো অবহেলা না করে এবং ঘাটতি না রেখে হজ ও উমরার যাবতীয় বিধিবিধান পরিপূর্ণভাবে আদায় কর। সুতরাং আপনারা যখন হজ শুরু করবেন তা পরিপূর্ণ করবেন, যখন হজের কার্যাদি আরম্ভ করবেন তা সুন্দরভাবে শেষ করবেন এবং যখন সৎ আমলের সূচনা করবেন তা নিপুণভাবে সম্পন্ন করবেন।

আল্লাহর সম্মানিত ঘরের হজ আদায়কারী এবং মসজিদে নববীর জিয়ারতকারীগণ! নিশ্চয় এই পবিত্র ভূমি আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর ইবাদতের ওপর প্রতিষ্ঠিত, যিনি একক তাঁর কোনো শরীক নেই। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর স্মরণ করুন, যখন আমি ইবরাহীমের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম ঘরের স্থান, তখন বলেছিলাম, আমার সঙ্গে কোনো কিছু শরীক করবেন না।’ (সুরা আল-হজ্জ: ২৬)

সুতরাং আপনারা সনদযুক্ত আলোকিত সুন্নাহসমূহ আঁকড়ে ধরুন, বিদআত ও নব আবিস্কৃত বিষয়গুলোর ব্যাপারে সতর্ক হোন। মৃতদের কাছে মাথানত করবেন না, মৃত ধ্বংসাবশেষের কাছে আরোগ্য কামনা করবেন না, কবরের মাধ্যমে বরকত অন্বেষণ এবং আরোগ্য লাভের আশা করবেন না। কবরে খাদ্যদ্রব্য, শস্য দানা, অর্থকড়ি, তসবিহ দানা, পোশাক-পরিচ্ছদ নিক্ষেপ করবেন না। মৃতদের নিকট সাহায্য চাইবেন না, তাদের কাছে অভাব পূরণ করতে এবং বিপদ থেকে মুক্তি পেতে প্রার্থনা করবেন না। বরং এক আল্লাহ তায়ালার কাছে সব প্রয়োজন, আকাঙ্ক্ষা ও দাবী পেশ করুন। প্রতারক, রসিকতাকারী ও কুসংস্কারে বিশ্বাসী ব্যক্তির অনুসরণ করা থেকে সাবধান থাকুন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনিই আল্লাহ তোমাদের রব; আধিপত্য তাঁরই, আর তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা তো খেজুর আঁটির আবরণেরও অধিকারী নয়। তোমরা তাদেরকে ডাকলে তারা তোমাদের ডাক শুনবে না এবং শুনলেও তোমাদের ডাকে সাড়া দেবে না। আর তোমরা তাদেরকে যে শরীক করেছ তা তারা কিয়ামতের দিন অস্বীকার করবে। সর্বজ্ঞ আল্লাহর মতো কেউই আপনাকে অবহিত করতে পারে না।’ (সুরা ফাতির: ১৩-১৪)

প্রিয় হজযাত্রী, ওমরাকারী ও দর্শনার্থীরা, দেয়াল, দরজা ইত্যাদির মাঝে বরকত তালাশ করবেন না, মিম্বার বা মিহরাবকে বরকতের নিয়তে স্পর্শ করবেন না, গুহা, পাহাড়, শিলা বা পাথরের মাধ্যমেও বরকত চাইবেন না; কারণ জড় পদার্থ থেকে বরকত অনুসন্ধান করা যায় না। তবে হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করা ও চুম্বন করা শরীয়তসম্মত। আর রুকনে ইয়ামানিকে শুধু স্পর্শ করা শরীয়তসিদ্ধ; চুম্বন করা নয়। এই দু’টি ছাড়া বায়তুল্লাহর কোনো কিছু স্পর্শ করা বা চুম্বন করা শরীয়তসম্মত নয়।

রাসুলুল্লাহ (সা.) যা স্পর্শ করেছেন আমরা তা স্পর্শ করব এবং যে কাজ করা থেকে বিরত থেকেছেন আমরা তা থেকে বিরত থাকব। তবে যে কেউ চাইলে মুলতাজিমে- যা হাজরে আসওয়াদ এবং কাবার দরজার মাঝামাঝি অবস্থিত- এসে তাতে তার বুক, মুখ, হাত ও হাতের কব্জি রেখে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে এবং তার প্রয়োজনের কথা ব্যক্ত করতে পারে- ধাক্কাধাক্কি ও কাউকে কষ্ট না দিয়ে; কেননা তা কতিপয় সাহাবীর আমল থেকে প্রমাণিত।

প্রিয় হজযাত্রী, ওমরাকারী ও দর্শনার্থীরা, দুর্বল, নারী, বয়স্ক এবং দুস্থ ব্যক্তিদের প্রতি রহম করুন। তাদেরকে ধাক্কা দেবেন না, কষ্ট দেবেন না, তাদের জন্য পথ প্রশস্ত রাখুন, তাহলে আল্লাহ আপনাদের জন্য পথ প্রশস্ত রাখবেন। কোমল আচরণ করুন, ধীরে চলুন, নম্রতা অবলম্বন করুন, পরস্পরকে ক্ষমা করুন, ভিড় এড়িয়ে চলুন, ধীরস্থিরতা অবলম্বন করুন, ভয় অনুভব করুন, সহনশীলতা লালন করুন, পথ হারানো ব্যক্তিকে পথ দেখিয়ে দিন, দুর্বল ও অভাবীকে সহায়তা করুন, বেশী বেশী তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করুন, বিনয়তা, অক্ষমতা, অনুশোচনা, অভাব ও বশ্যতা প্রকাশ করুন। স্থানের মর্যাদা ও সময়ের মহত্ত্বের কথা স্মরণ করুন। তাহলে আল্লাহ তায়ালা আপনাদের দোয়া কবুল করবেন, সন্তুষ্টিচিত্তে ক্ষমা করবেন, হজ ও সাধনাকে কবুল করবেন, পাপরাশিকে ক্ষমা করবেন এবং আপনাদের হজকে মকবুল হজ হিসেবে গণ্য করবেন।

দ্বিতীয় খুতবা

হে মুসলমানগণ! আপনারা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করুন ও তাঁকে ভয় করুন। আপনারা তাঁরই আনুগত্য করুন, অবাধ্য হবেন না। তিনি বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাক।’ (সুরা আত-তাওবা: ১১৯)

হে মুসলিমগণ, আল্লাহর অনুগ্রহে হারামাইন শরিফাইনের খাদেম ও তার ক্রাউন প্রিন্সের নিকট থেকে এ দুই পবিত্র মসজিদ দুর্দান্ত, সর্বোচ্চ ও পর্যাপ্ত যত্ন ও পরিষেবা পেয়েছে। তাই হজযাত্রীদের নিরাপত্তা, শান্তি, স্বাস্থ্য ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য নানা প্রচেষ্টা, বাহিনী নিয়োগসহ ভিড় নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। সুস্পষ্ট সুশাসনের অধীনে, ব্যাপক নিরাপত্তা, চমকপ্রদ স্থিতিশীলতা, বিদ্যমান ন্যায়বিচার ও প্রচুর কল্যাণের আওতায় পবিত্র মক্কা ও মদিনার পুনর্গঠন ও উন্নয়ন সাধিত হয়েছে- যা পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে অতুলনীয়।

প্রতি বছর হজযাত্রীর সংখ্যা নির্ধারণ করা শরয়ী নীতি ও জনস্বার্থের দাবী; যাতে হজের সময় ভিড়ের ক্ষতিকারক প্রভাব, বিশৃঙ্খলা ও অনিয়ম রোধ করা যায়। সুতরাং হজ পারমিট সংগ্রহ করে হজ করতে হবে। যে ব্যক্তি সরকারী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে হজ পারমিট না পায়, সে অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত তার হজ বিলম্বের জন্য ওজরগ্রস্ত বিবেচিত হবে। কাজেই যারা নিয়ম ভঙ্গ করছেন, অবৈধ পথ অবলম্বন করছেন এবং বিনা ইহরামে মিকাত অতিক্রম করছেন- আপনারা কোন হজ করতে চান?! কিসের সওয়াবের আশা করেন?!

তাই এসব নিন্দনীয় ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী কাজ থেকে বিরত থাকুন এবং মিথ্যা ও তুচ্ছ অজুহাত ব্যবহার করা থেকে সাবধান থাকুন। বিবেক, চিন্তা ভাবনা ও অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখুন; তাহলে সরকারের এই সিদ্ধান্তের হিকমত, এর মহান উপকারিতা ও সুফল জানতে পারবেন।

হে আল্লাহ! হাজীদের হজ ও পরিশ্রমকে কবুল করুন, তাদের ইবাদতগুলোকে কবুল ও সংশোধন করুন, তাদের সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি করুন এবং তাদেরকে নিজ নিজ পরিবারের নিকট বিজয়ী বেশে সুস্থতার সঙ্গে ফিরিয়ে দিন।

হে বিশ্বজগতের প্রভু, হে আল্লাহ! ফিলিস্তিনে আমাদের ভাইদেরকে আগ্রাসী, অত্যাচারী ও সীমালঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে বিজয় দান করুন। হে আল্লাহ! আল-আকসা মসজিদকে দখলদার ইহুদীদের অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করুন, ফিলিস্তিনে আমাদের জনগণকে রক্ষা করুন, তাদের ক্ষত নিরাময় করুন, তাদের বিজয় ত্বরান্বিত করুন, তাদের পদস্খলন হ্রাস করুন, তাদের দুর্দশা দূর করুন, তাদের বন্দীদের মুক্ত করুন, তাদের অসুস্থদের সুস্থ করুন এবং তাদের মৃতদেরকে শহীদ হিসেবে গ্রহণ করুন, হে বিশ্বজগতের প্রতিপালক।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ