সন্তান অমূল্য সম্পদ। সন্তানকে নিয়ে পিতামাতা নানা স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু আফসোস, সন্তানকে ঘিরে অনেক মা-বাবার স্বপ্ন হয় স্থূল। অনেকেই জানেন না, সন্তানের জন্য কী স্বপ্ন দেখা উচিত। এজন্য শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগণের সিরাত ও জীবনচরিত অধ্যয়ন করা কর্তব্য। আজ আমরা আলোকপাত করব ইবরাহিম (আ.) সন্তানকে নিয়ে কী স্বপ্ন দেখতেন এবং স্বপ্নের পথে তাকে কীভাবে অগ্রসর করতেন।
ইবরাহিম (আ.) ছিলেন উচ্চমর্যাদাবান একজন নবী। বহুদিন হয়ে গেছে তাঁর কোনো সন্তান হচ্ছে না। ধীরে ধীরে এই দম্পতির সন্তান জন্মের স্বাভাবিক বয়স পার হয়ে যায়। ইবরাহিম (আ.)-এর বয়স ৯০ ছুঁইছুঁই আর তাঁর স্ত্রী হাজেরা (রা.)-এর বয়স ৮০ ছুঁইছুঁই।
এই জীবনসন্ধ্যায় দাঁড়িয়েও ইবরাহিম (আ.) সন্তান শূন্যতার হাহাকার উপেক্ষা করতে পারেননি। দয়াময় আল্লাহর দয়ার দুয়ারে কাতর হয়ে সন্তান প্রার্থনা করেন, ‘হে আমার রব! আমাকে নেক সন্তান দান করুন।’ (সুরা সাফফাত: ১০০)
এ দোয়াটি অনেক শিক্ষণীয়। এ দোয়া শিক্ষা দেয়, সন্তানদাতা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। সুতরাং শুধু তাঁর কাছেই সন্তান প্রার্থনা করা চাই, অন্য কারও কাছে নয়। অন্য কারও পক্ষে সন্তান দান করা অসম্ভব। তিনি নবী হোক, ওলি হোক কিংবা পির-বুজুুর্গ। তারা নিজেরাই তো আল্লাহর সৃষ্টি এবং মুখাপেক্ষী।
এ দোয়া আরও শিক্ষা দেয়, আল্লাহর কাছে সর্বদা নেক ও সৎ সন্তান প্রার্থনা করা চাই। তিনি যখনই সন্তান দান করেন যেন নেক সন্তান দান করেন, যে নিজে উভয় জগতে আলোকিত মানুষ হবে এবং অন্যের মাঝে আলো ছড়াবে, কল্যাণ বয়ে আনবে।
যত দিন যাচ্ছিল ইবরাহিম (আ.)-এর অন্তরে নেক সন্তানের আকাঙ্ক্ষা ততই তীব্র হচ্ছিল এবং আল্লাহর দয়ার দুয়ারে ততই দোয়া-কাতর হচ্ছিলেন। অবশেষে আল্লাহ তাঁর আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেন এবং তাঁকে একজন সহনশীল পুত্র সন্তান দান করেন। এই সন্তানের নাম রাখেন ইসমাঈল। এর অনেক বছর পরে আরেক পুত্র সন্তানের বাবা হন তিনি। তাঁর নাম রাখেন ইসহাক।
একজন অশীতিপর বৃদ্ধ সন্তানের মুখ দেখলে কত খুশি ও আনন্দিত হবে। সহজেই অনুমেয়। ইবরাহিম (আ.) শুধু আনন্দিতই হননি; সন্তানদাতা দয়াময় আল্লাহর শোকরে তাঁর হূদয়জগৎ ভরে যায়। তিনি শোকর আদায় করে বলেন, ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে বৃদ্ধ বয়সে ইসমাঈল ও ইসহাক দান করেছেন। নিশ্চয় আমার রব দোয়া শ্রবণকারী।’ (সুরা ইবরাহিম: ৩৯)
এ দোয়াার বার্তা হলো, সন্তানের নিয়ামত পেলে অহংকার ও উদাসীনতা সমীচীন নয়; বরং সন্তানদাতার শোকর আদায় করা চাই। এ দোয়ার আরও বার্তা হলো, আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও ভরসা রাখা চাই, তিনি দোয়া কবুল করতে পরিপূর্ণ সক্ষম এবং আমার দোয়া কবুল করবেন। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া উচিত নয়। ইবরাহিম (আ.) শামে বসবাস করতেন। ইসমাঈল (আ.)-এর জন্মের পর তিনি স্ত্রী ও সন্তানকে মক্কায় রেখে যান। মক্কায় তখন না জনবসতি ছিল, না জীবনযাপনের উপায়-উপকরণ ছিল। তারপরও তিনি সন্তানকে কেন এখানে রেখে গেলেন শুনুন কোরআনের ভাষায়, ‘হে আমাদের রব! আমি আমার কতক সন্তানকে আপনার সম্মানিত ঘরের কাছে শস্যহীন উপত্যকায় (এনে) বসবাস করিয়েছি। হে আমাদের রব! যাতে তারা নামাজ কায়েম করে। সুতরাং আপনি মানুষের অন্তর তাদের প্রতি অনুরাগী করে দিন এবং তাদেরকে ফলমূল থেকে রিজিক দান করুন, হয়তো তারা শোকর করবে।’ (সুরা ইবরাহিম: ৩৭)
জনবসতি ও জীবন-উপকরণহীন মরুদ্যান মক্কায় কলিজার টুকরোকে রেখে যাওয়ার কারণ হলো, এখানে পবিত্র বাইতুল্লাহ অবস্থিত। এর বরকতে সন্তান-সন্ততি নামাজি হবে। দ্বীনী পরিবেশে থাকবে। এ দোয়ার শিক্ষা হলো, সন্তান-সন্ততির জন্য যতটা সম্ভব সুন্দর পরিবেশের ব্যবস্থা করা চাই, যেখানে তারা নামাজ কায়েম করতে পারবে, দ্বীনের ওপর সুন্দরভাবে চলতে পারবে। আরেকটি শিক্ষা হলো, সন্তান-সন্ততির প্রয়োজনীয় রিজিকের জন্যও দোয়া করা চাই, যাতে তারা সম্মানজনক জীবনযাপন করতে পারে।
ইবরাহিম (আ.) সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে আরও অনেক দোয়া করেছেন। সেসবের একটি হলো, ‘হে আমার রব! এই শহরকে নিরাপদ করুন এবং আমাকে ও আমার সন্তান-সন্ততিকে মূর্তিপূজা থেকে দূরে রাখুন। হে আমার রব! ওরা বহু লোককে পথভ্রষ্ট করেছে।’ (সুরা ইবরাহিম: ৩৫-৩৬)
এ দোয়ার শিক্ষা হলো, সন্তানাদির জন্য নিরাপদ স্থানের দোয়া করা চাই, যেখানে তারা নিরাপদে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।
এ দোয়া আরও শিক্ষা দেয়, এ ব্যাপারে পূর্ণ সতর্ক থাকতে হবে, যেন সন্তান-সন্ততি কিছুতেই কুফর ও শিরকে লিপ্ত না হয়; বরং তাওহিদের দৃঢ় ও পরিপূর্ণ বিশ্বাসী হয়।
তিনি আরও দোয়া করেন, ‘হে আমার রব! আমাকে নামাজ কায়েমকারী বানান এবং আমার সন্তান-সন্ততির মধ্য থেকেও। হে আমাদের রব! আর আমার দোয়া কবুল করুন।’ (সুরা ইবরাহিম (১৪): ৪০) এ দোয়ার শিক্ষা হলো, নিজেও নামাজি হতে হবে, সন্তান-সন্ততি ও বংশধরের নামাজের ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে। এজন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে।
ইবরাহিম (আ.)-এর একমাত্র পুত্র ইসমাঈল (আ.) বেড়ে ওঠা শুরু করেন। যখন পিতার সঙ্গে ছোটাছুটি করার বয়সে উপনীত হয় তখন পিতা স্বপ্নে দেখেন, তিনি কলিজার টুকরোকে জবেহ করছেন। যদিও এটা স্বপ্ন ছিল; কিন্তু নবীগণের স্বপ্ন ওহী হয়ে থাকে; তাই ইবরাহিম (আ.) একে আল্লাহ তায়ালার আদেশ সাব্যস্ত করেন।
স্বপ্নের কথা তিনি একমাত্র পুত্রকে জানিয়ে বলেন, ‘হে আমরা বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি, তোমাকে জবেহ করছি। তাই তুমি চিন্তা করে দেখ, তোমার অভিমত কী? সে বলল, হে আমার পিতা! আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে তা করে ফেলুন। আপনি আমাকে আল্লাহ চাহেন তো অবশ্যই ধৈর্যশীল পাবেন। অতঃপর যখন তারা উভয়ে আদেশ মান্য করল এবং পিতা পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিল।’ (সুরা সাফফাত (৫৫): ১০২-১০৩)
ইবরাহিম (আ.) মনে মনে এমন সন্তানের কথাই ভাবতেন এবং আল্লাহর কাছেও এমন সন্তানই প্রার্থনা করতেন, যে আল্লাহর পূর্ণ অনুগত হবে, আল্লাহর জন্য জীবন দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না। আল্লাহ তায়ালা ঘুমের মধ্যে তাঁর পুত্রকে জবেহ করতে দেখিয়ে তাঁকে পরীক্ষা করেন, তিনি আসলে এমন সন্তান চান কিনা। ইবরাহিম (আ.) প্রমাণ করেছেন, তিনি হূদয়ের গভীর থেকেই এমন সন্তান চান এবং এর জন্য যা দরকার তা করতে তিনি প্রস্তুত। এমন সন্তান তৈরি করতে প্রয়োজন প্রজ্ঞা, কোমলতা, সচেতনতা, সহনশীলতা ও দোয়া-কাতরতা। এখানে আমরা দেখেছি, ইবরাহিম (আ.) বৃদ্ধ বয়সে লব্ধ সম্পদকে আল্লাহর পথে কোরবান করার জন্য কীভাবে প্রস্তুত করেছেন।
আল্লাহ ইবরাহিম (আ.)কে কাবাঘর নির্মাণের নির্দেশ দেন। তখন তিনি পুত্র ইসমাঈলকে বলেন, আল্লাহ আমাকে একটি কাজের আদেশ করেছেন। ইসমাঈল বলেন, আপনার রব আপনাকে যে আদেশ করেছেন তা পালন করুন। তিনি বললেন, তুমি কি আমাকে সহযোগিতা করবে? ইসমাঈল বললেন, জি, আপনাকে সহযোগিতা করব।
এরপর পিতা-পুত্র মিলে বাইতুল্লাহ নির্মাণ করেন। ইসমাঈল (আ.) পাথর জোগান দেন আর ইবরাহিম (আ.) নির্মাণ কাজ করেন। দেয়াল যখন উঁচু হয়ে গেল তখন ইসমাঈল (আ.) একটি পাথর আনলেন। ইবরাহিম (আ.) তার ওপর দাঁড়িয়ে নির্মাণ কাজ করেন আর ইসমাঈল (আ.) পাথর জোগান দেন। এ সময় তাঁরা বলছিলেন, ‘হে আমাদের রব! আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন। নিশ্চয় আপনিই সর্বশ্রোতা, পরিজ্ঞাতা। হে আমাদের রব! আর আমাদের আপনার পূর্ণ অনুগত বানান এবং আমাদের সন্তান-সন্ততির মধ্যেও আপনার অনুগত একটি জামাত বানান এবং আমাদের হজের নিয়মাবলি শিক্ষা দিন এবং আমাদের তওবা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনিই তওবা কবুলকারী, অতি মেহেরবান।’ (সুরা বাকারা: ১২৭-২৮)
এ দোয়ার একটি শিক্ষা হলো, সন্তানকে কল্যাণের কাজে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করা চাই, এতে অভ্যাস গড়ে উঠবে। এ দোয়ার আরেকটি শিক্ষা হলো, কেবল সন্তান নয়; বংশধরের জন্যও দোয়া করা উচিত, আল্লাহ যেন কিয়ামত পর্যন্ত তাদের মধ্যে সৎ ও যোগ্য লোক তৈরি করেন, যারা আল্লাহর পূর্ণ অনুগত হবে এবং তাওহিদ ও একত্ববাদে দৃঢ় বিশ্বাসী হবে।
সারকথা হলো, ইবরাহিম (আ.) নেক সন্তানের স্বপ্ন দেখতেন। আল্লাহর পূর্ণ অনুগত সন্তানের স্বপ্ন দেখতেন। তাওহিদের প্রতি দৃঢ় ও পরিপূর্ণ বিশ্বাসী সন্তানের স্বপ্ন দেখতেন। নামাজি সন্তানের স্বপ্ন দেখতেন। পিতামাতার অনুগত সন্তানের স্বপ্ন দেখতেন। স্বপ্ন দেখা সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে কাতর হয়ে দোয়া করতেন এবং স্বপ্নপথের যাত্রায় সন্তানকে সহযোগিতা করতেন।
নয়াশতাব্দী/ডিএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ