আমাদের সমাজে পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে এবং যে বীভৎস রূপ ধারণ করেছে তা আদালতে দায়েরকৃত মামলা-মোকদ্দমার পরিসংখ্যান দ্বারা কিছুটা অনুমান করা যায়। তবে বাস্তবিকপক্ষে ঝগড়া-বিবাদের সংখ্যা এর চেয়েও অনেক বেশি। আদালতের ব্যয় নির্বাহ অনেকের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে অনেক বিবাদ আদালত পর্যন্ত পৌঁছে না। কিন্তু বিবাদের আগুন ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে। একে অপরকে কষ্ট দেয়া ও হেয় প্রতিপন্ন করার সর্বাত্মক চেষ্টাও চলতে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ শত্রুতার আগুন বংশপরিক্রমার কয়েক ধাপ পর্যন্ত গড়াতে থাকে।
এসব ঝগড়া-বিবাদের কারণ খতিয়ে দেখলে অর্থকড়ি ও জায়গা-জমিই মূল কারণ হিসেবে দেখা যাবে। টাকা-পয়সা ও জমির বিবাদ রক্তের সম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্বের ঘনিষ্ট বন্ধনকেও মুহূর্তের মধ্যে শেষ করে দেয়। বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব চোখের পলকে শত্রুতায় পরিণত হয়।
এ অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে একটি প্রধান কারণ হলো পারস্পরিক মালিকানা অস্বচ্ছ থাকা, লেনদেন পরিষ্কার না রাখা। ইসলামের এক সোনালি শিক্ষা হলো, ‘ভ্রাতৃত্বের আবহে বসবাস করো। আর অপরিচিতের ন্যায় লেনদেন করো।’ অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবনে পরস্পরের সঙ্গে এমন আচরণ করো যেমনটি এক ভাইয়ের অপর ভাইয়ের সঙ্গে করা উচিত। ভদ্রতা, উদারতা, সহনশীলতা ও হূদ্যতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাও। আচার-আচরণে ত্যাগ স্বীকার করে অপরকে প্রাধান্য দাও। কিন্তু পারস্পরিক সুসম্পর্ক থাকলেও টাকা-পয়সার লেনদেন, জায়গা-জমির আদান প্রদান ও অংশীদারিত্বের কারবার এমনভাবে সম্পাদন করো যেমন দুজন অপরিচিত ব্যক্তি সম্পাদন করে থাকে। অর্থাৎ লেনদেন ও কায়-কারবারের প্রতিটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া উচিত। কারবারের কোনো দিকই যেন অস্পষ্ট না থাকে সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ রাখা উচিত।
পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সুমধুর সম্পর্ক থাকাকালে যদি ইসলামের এ মূল্যবান শিক্ষার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয় তাহলে পরবর্তীতে উদ্ভূত অনেক ফেতনা-ফাসাদের পথ এখানেই বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের সমাজে এ মূল্যবান শিক্ষার প্রতি মোটেও গুরুত্ব দেয়া হয় না। উপরন্তু কেউ এ স্বচ্ছতার প্রস্তাব দিলে তা পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ঐক্যের পরিপন্থি বলে মনে করা হয়। প্রস্তাবকারীকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়, যার ফল পরবর্তীতে সবাইকে ভোগ করতে হয়।
কোরআন মাজিদের সর্বাধিক দীর্ঘ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মুসলিম জাতিকে হেদায়েত দান করেছেন যে, যখন তোমরা বাকিতে লেনদেন করবে তখন তা লিখে রাখবে। সাধারণ বাকি লেনদেনকেই যখন লিখে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তখন যৌথ কারবারের মতো জটিল বিষয়টিতে কার প্রাপ্য কী হবে তা লিখে রাখার গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়। এ নির্দেশ এজন্যই দেয়া হয়েছে, যাতে পরবর্তীতে ঝগড়া-বিবাদ ও মতবিরোধ সৃষ্টি না হয়। আর হলেও তা ন্যায়নীতির সঙ্গে সমাধান করা যায়।
আমরা একটি উদাহরণ দিই। আমাদের সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্যও এককভাবে গৃহ নির্মাণ বড় কঠিন বিষয়। তাই সাধারণত গৃহ ক্রয় বা নির্মাণ পরিবারের একাধিক সদস্য মিলে যৌথভাবেই হয়ে থাকে। বাবা বাড়ি নির্মাণ করলে ছেলেরাও সামর্থ্য অনুপাতে নিজেদের অর্থ দিয়ে থাকে। সাধারণত তা কোনো বিষয় চূড়ান্ত করা ছাড়াই হয়ে থাকে। (কী পরিমাণ দেয়া হচ্ছে তার হিসাবও রাখা হয় না) তা কি ছেলের পক্ষ থেকে বাবার জন্য হাদিয়া-সহযোগিতা, না ঋণ, নাকি বাড়ির মালিকানায় অংশগ্রহণ কিছুই স্বচ্ছ থাকে না। অথচ হাদিয়া বা দান হলে বাড়ির মালিকানায় সে অংশীদার হবে না এবং এ টাকা সে কখনো ফেরত পাবে না। ঋণ হলে বাড়ির একক মালিকানা পিতার হবে আর ছেলের প্রদত্ত অর্থ পিতার দায়িত্বে ঋণস্বরূপ থাকবে। আর যদি বাড়ির মালিকানায় অংশীদার হওয়ার জন্য টাকা দেয়া হয় তাহলে অর্থের পরিমাণ অনুযায়ী বাড়ির মালিকানা লাভ করবে। বাড়ির মূল্য বৃদ্ধি ঘটলে তার প্রাপ্য মালিকানারও মূল্য বৃদ্ধি পাবে। মোটকথা প্রত্যেক অবস্থার ফলাফল ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু যেহেতু অর্থ দেয়ার সময় কোনো বিষয় চূড়ান্ত করা হয়নি, প্রদত্ত টাকার হিসাবও রাখা হয়নি, তাই পরবর্তীতে কোনো বিরোধ দেখা দিলে বিশেষ করে এ অবস্থায় বাবার মৃত্যু হলে উত্তরাধিকার সম্পদ বণ্টনে অবর্ণনীয় জটিলতার সৃষ্টি হয়। যারা গৃহ নির্মাণে অর্থ ব্যয় করেছে তাদের সঙ্গে অন্যদের সীমাহীন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। কখনো এ বিবাদে পুরো বংশ জড়িয়ে যায়।
যদি ইসলামের সোনালি শিক্ষা অনুসরণ করে গৃহ নির্মাণের পূর্বেই এ বিষয়টি চূড়ান্ত করা হতো আর তা লিখিত আকারে সংরক্ষণ করা হতো তাহলে পারিবারিক এ দ্বন্দ্ব-কলহের সুযোগ সৃষ্টি হতো না।
আরেকটি উদাহরণ— পরিবারের কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে শরিয়তের নির্দেশ হলো অনতিবিলম্বে তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি উত্তরাধিকারদের মাঝে বণ্টন করে দিতে হবে। কিন্তু আমাদের সমাজে শরিয়তের এ নির্দেশ পালনে চরম অবহেলা-উদাসীনতা বিরাজমান। কোথাও তো হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করে যে যা পায় তার ওপরই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। আবার কোথাও এমন মন্দ নিয়ত না থাকলেও অজ্ঞতা ও অবহেলার কারণে সম্পত্তি বণ্টন করা হয় না। যদি মৃত ব্যক্তির কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য থাকে তাহলে জীবদ্দশায় যে সন্তান তার দেখাশুনা বা সহযোগিতা করত সেই তা দেখাশোনা করতে থাকে। কিন্তু এ বিষয়টি পরিষ্কার করা হয় না যে, এখন ব্যবসার মালিকানা কার, আর তা কী পরিমাণ। উত্তরাধিকারীদের অংশ কী হারে পরিশোধ করা হবে। ব্যবসায় যে ভাই শ্রম দিচ্ছে সে এর বিনিময়ে কী পাবে; বরং কেউ যদি সম্পত্তি বণ্টনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাহলে তার এ প্রস্তাবকে সমাজে ঘৃণিত ও দোষনীয় মনে করা হয়। বলা হয় মৃত ব্যক্তির কাফনও এখনো পুরাতন হয়নি জীবিতরা সম্পদ ভাগ বাটোয়ারার ধান্ধায় পড়ে গেছে।
অথচ এ বণ্টন শরিয়তের নির্দেশ, স্বচ্ছ মালিকানার দাবিও বটে। কিন্তু এদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। আর এ অবহেলার ফলাফলই কিছুদিন পর প্রকাশ পেতে থাকে। সময় অতিবাহিত হলে পরস্পরের নিজ প্রাপ্য ও অধিকারের কথা স্মরণ হয়। অসন্তোষ ও ক্ষোভ জন্মাতে থাকে। সময়ের ব্যবধানে পরিত্যক্ত সম্পত্তির মূল্য বৃদ্ধিতে বড় ধরনের তারতম্য ঘটে গেলে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহও বড় আকার ধারণ করে। সে দ্বন্দ্ব-কলহের উপযুক্ত কোনো সমাধানও খুঁজে পাওয়া যায় না। তখন এ বিবাদ হাটে ঘাটে প্রসার লাভ করে। এমনকি কখনো আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
যদি শরিয়তের নির্দেশ অনুযায়ী যথাসময়ে সম্পদ বণ্টন হয়ে যেত তাহলে সবার সন্তুষ্টিতে সব বিষয় মীমাংসা হয়ে যেত। সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পেত।
উপরোক্ত আলোচনায় সমাজে প্রচলিত শুধু দুটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হলো। অন্যথায় সমাজে বিস্তৃত ঝগড়া-বিবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হলে দেখা যাবে মালিকানার অস্বচ্ছতা ও লেনদেনের অপরিচ্ছন্নতা মহামারির আকার ধারণ করে আছে, যার ফলে সৃষ্ট হচ্ছে অসংখ্য অগণিত ফেতনা-ফাসাদ, দ্বন্দ্ব-কলহ। লেনদেন ছোট হোক বা বড় তা পরিষ্কার হওয়া উচিত। তার শর্তসমূহ স্বচ্ছ ও অস্পষ্টতামুক্ত হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে কোনো সংকোচ, লজ্জা, উদারতা বা লৌকিকতা কোনো কিছুই প্রতিবন্ধক না হওয়া উচিত। এভাবে লেনদেনের শর্তসমূহ পরিষ্কার করে পারস্পরিক যত সদাচার করা যায় ততই ভালো। নিজে ত্যাগ স্বীকার করে অন্যকে প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা করাই কাম্য। বলাবাহুল্য, এটিই উদ্দেশ্য হলো শরিয়তের এ নীতির- ‘ভ্রাতৃত্বের আবহে বসবাস করো আর অপরিচিতের ন্যায় লেনদেন করো।’
উর্দু থেকে অনুবাদ: মাওলানা শাববীর আহমদ
নয়াশতাব্দী/ডিএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ