ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
মসজিদে নববির জুমার খুতবা

মুমিনের জীবনব্যাপী ভালোবাসাময় ইবাদত

প্রকাশনার সময়: ০৯ মে ২০২৪, ০৯:১৪

আল্লাহর পরিপূর্ণ হিকমত ও অভিনব বিধান হিসেবে রমজান মাসের পরই আগমন ঘটেছে হজের মাসসমূহের। যাতে একজন মুসলিম এক ঈমানি মৌসুম থেকে আরেক ঈমানি মৌসুমে, এক আধ্যাত্মিক চারণভূমি থেকে আরেক আধ্যাত্মিক চারণভূমিতে স্থানান্তরিত হতে পারে। ঈমানি ছায়ায়, আধ্যাত্মিক আশ্রয়ে বিচরণ করতে পারে। এতে তার অন্তরে ঈমানের শিখা জ্বলতে থাকে, হূদয়ের অনুভূতিগুলো প্রজ্জ্বলিত হতে থাকে। তার রবের সঙ্গে সংযোগ, স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক নির্দিষ্ট স্থান-কালের আচার-অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং সময় ও অবস্থার পরিবর্তন সত্ত্বেও ঈমানের শিখা তার হূদয়ে সুদৃঢ় থাকে। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে প্রাপ্ত আসমানি বিধান ও অনুশাসনের মধ্যে এটি ঐশ্বরিক হিকমত। সুতরাং তিনি কতই না পবিত্র যিনি শরিয়ত প্রণয়ন করেছেন এবং তা বিধিবদ্ধ করেছেন, যিনি সৃষ্টি করেছেন এবং তা নিখুঁতভাবে উদ্ভাবন করেছেন।

নিশ্চয় এটা আমাদেরকে এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে যে, মুসলিম ব্যক্তির পুরো জীবনই আল্লাহর জন্য উৎসর্গ হবে। আল্লাহ বলেন, ‘বলুন, আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ— সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহরই জন্য। তাঁর কোনো শরিক নেই। আর আমাকে এরই নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে এবং আমি মুসলিমদের মধ্যে প্রথম।’ (সুরা আল-আনআম: ১৬২- ১৬৩)

নবী (সা.) যখন নামাজে দাঁড়াতেন, তখন বলতেন, ‘আমার চেহারা একনিষ্ঠ হয়ে সে সত্ত্বার দিকে অভিমুখী করলাম, যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। আমার সালাত, আমার ইবাদত ও কোরবানি এবং আমার হায়াত ও মউত বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর জন্য, যার কোনো শরিক নেই। আর আমি এ বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি মুসলিমদের একজন। হে আল্লাহ! আপনিই বাদশাহ, আপনি ব্যতীত ইলাহ নেই, আমার প্রতিপালক এবং আমি আপনার বান্দা। আমি নিজের ওপর জুলুম করেছি এবং আমার অপরাধ আমি স্বীকার করছি। অতএব, আমার সব গুনাহ মাফ করে দিন; কেননা আপনি ব্যতীত আর কেউই তো ক্ষমাকারী নেই। আমাকে উত্তম চরিত্রের দিকে পরিচালিত করুন; কেননা আপনি ব্যতীত কেউ উত্তম চরিত্রের দিকে পরিচালিত করতে পারে না। আমার থেকে মন্দ চরিত্রকে দূর করুন; কেননা মন্দ চরিত্রগুলো আপনি ব্যতীত কেউ আমার থেকে দূর করতে পারে না। আপনার সম্মুখে আমি হাজির! আনুগত্য আপনারই জন্য নিবেদিত! সকল কল্যাণ আপনারই হাতে, অকল্যাণ আপনার প্রতি সম্পৃক্ত নয়। আমি আপনার ওপর নির্ভরশীল এবং আপনার দিকেই রজ্জু হই। আপনি বরকতময়, আপনি মহামহিম, আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও তওবা করছি।’

এটি আল্লাহর ইবাদত ও দাসত্বের বিস্তৃত ধারণার দিকে আমাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করে এবং তা কেবল ইবাদতের রসম-রেওয়াজ, আনুগত্যের প্রতীকী আচার-অনুষ্ঠান ও স্থান-কালের সীমারেখার মাঝে আবদ্ধ নয়। বরং একজন মুসলিম দাসত্বের সীমানার মাঝেই চলতে থাকে, এর চারণভূমিতে বিচরণ করে ও বসবাস করে। ফলে সে আল্লাহর দাসত্ব ব্যতীত স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না, তাঁর নিকট ছাড়া আশ্রয় গ্রহণ করে না এবং তার হূদয় দাসত্বের ভূমি ব্যতীত কোথাও অবস্থান করে না।

নিশ্চয় একজন মুমিন বান্দা সারা জীবন আল্লাহর জন্যই বেঁচে থাকে; ফলে সে যখন ভালোবাসে তখন আল্লাহর জন্যই ভালোবাসে, যখন ঘৃণা করে তখন আল্লাহর জন্যই ঘৃণা করে, যখন দান করে তখন আল্লাহর জন্যই দান করে এবং যখন খরচ করা থেকে বিরত থাকে তখন আল্লাহর জন্যই বিরত থাকে। প্রতিটি বিষয় সম্পাদনে অথবা পরিহারে তার সৎ নিয়ত উপস্থিত থাকে; ফলে তখন তার ঈমান পূর্ণতা লাভ করে। রাসুলুল্লাহ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওয়াস্তে কাউকে ভালোবাসে, আর আল্লাহর ওয়াস্তে কারও সঙ্গে বিদ্বেষ পোষণ করে এবং আল্লাহর ওয়াস্তেই দান-খয়রাত করে, আবার আল্লাহর ওয়াস্তেই দান-খয়রাত থেকে বিরত থাকে; সে ঈমান পূর্ণ করেছে।’

মুমিন বান্দা তার আমলের মধ্য দিয়ে যে উদ্দেশ্য অর্জন করতে চায় তা হলো, নিজ সৃষ্টিকর্তার দাসত্বের বাস্তবায়ন, তাঁর নির্দেশ পালন, তাঁর মাওলার সন্তুষ্টি এবং তাঁর ইচ্ছার প্রতিফলন। এটি ঈমানের একটি উচ্চ মর্যাদা এবং দাসত্বের একটি উন্নত স্তর; যখন শুধু আল্লাহ তায়ালা-ই বান্দার চোখের মণি, তার হূদয়ের সান্ত্বনা, প্রসারিত দৃষ্টির উদ্দেশ্য, আশা-ভরসার শেষসীমা এবং তার সম্পাদিত আমলের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পরিণত হন। আর এটি যখন তাঁর ভালোবাসা হূদয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তাঁর বন্ধন মজবুত হয় এবং তাঁর ভালোবাসা আমার গ্রন্থির রক্তের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হয় ফলে আমি সব ব্যস্ততা ভুলে তাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

কেননা ভালোবাসার স্ফুলিঙ্গ যখন হূদয়ে প্রজ্জ্বলিত হয়, এর আগুন যখন শিখায়িত হয় এবং এর উত্তাপ যখন ছড়িয়ে যায়; তখন তাঁর নিদর্শন মহাব্বতকারীর ওপর দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। যার ওপর কামনা-বাসনা প্রাধান্য লাভ করেছে এবং কামনা-বাসনার পথে যে চরম পর্যায়ের বাড়াবাড়ি করেছে; তাঁর গল্পে আপনি এমন কিছু পাবেন যাতে বিস্ময় শেষ হয় না। আর তা হলো মূলত এক সৃষ্টির পক্ষ থেকে আরেক সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসার গল্প। তাহলে সৃষ্টির পক্ষ থেকে সৃষ্টিকর্তার প্রতি দাসত্বের খাঁটি ভালোবাসার চিত্রটি কেমন বিস্ময়কর হতে পারে? মহান আল্লাহ মুমিনদের প্রসঙ্গে বলেন, ‘আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, তারা তাদেরকে ভালোবাসে আল্লাহর ভালোবাসার মতোই; পক্ষান্তরে যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহকে সর্বাধিক ভালোবাসে।’ (সুরা আল-বাকারা: ১৬৫)

আল্লাহ তায়ালাই অধিক উপযুক্ত ও শ্রেষ্ঠতর; যার ভালোবাসায় অন্তরসমূহ স্পন্দিত হয় এবং যার ইবাদতে অঙ্গপ্রত্যঙ্গসমূহ আন্দোলিত হয়। আর মুমিনের অন্তরকে তাঁর মাহবুব আল্লাহর সন্তুষ্টির দিকে পরিচালিত করার জন্য আল্লাহর ভালোবাসা-ই যথেষ্ট। যেন তার নিকট একজন চালক রয়েছে যে তাকে অনুপ্রাণিত করছে...। কেননা আগ্রহ-ই দেহের মাঝে চালক হিসেবে যথেষ্ট।

আমরা যখন মাত্রই উল্লিখিত সালাতের শুরুতে রাসুল (সা.)-এর পঠিতব্য দোয়াটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করব। ‘হে আল্লাহ! আপনিই বাদশাহ, আপনি ব্যতীত ইলাহ নেই, আমার প্রতিপালক এবং আমি আপনার বান্দা। আমি নিজের ওপর জুলুম করেছি এবং আমার অপরাধ আমি স্বীকার করছি। অতএব, আমার সব গুনাহ মাফ করে দিন; কেননা আপনি ব্যতীত আর কেউই তো ক্ষমাকারী নেই। আমাকে উত্তম চরিত্রের দিকে পরিচালিত করুন; কেননা আপনি ব্যতীত কেউ উত্তম চরিত্রের দিকে পরিচালিত করতে পারে না। আমার থেকে মন্দ চরিত্রকে দূর করুন; কেননা মন্দ চরিত্রগুলো আপনি ব্যতীত কেউ আমার থেকে দূর করতে পারে না।’

তখন আমরা এতে পাব যে, তিনি সে মোনাজাতে, আল্লাহর প্রশংসা এবং ক্ষমা প্রার্থনার দোয়ার পরেই সর্বোত্তম চরিত্রের দিকে হেদায়েতের দোয়া করেছিলেন। আর এতে ইঙ্গিত রয়েছে, পূর্বে উল্লিখিত আল্লাহর দাসত্বের সীমারেখা বিস্তৃত হয়ে তা ইবাদতের রসম-রেওয়াজ এবং আনুগত্যের নিদর্শনকে অতিক্রম করে মাখলুকের সঙ্গে বান্দার সম্পর্ককে অন্তর্ভুক্ত করে। কেননা মাখলুকের সঙ্গে উত্তম আচরণ করা, তাদের হক আদায় করা, তাদের প্রতি অনুগ্রহ করা ইবাদত ও আনুগত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ।

হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আপনার ভালোবাসা ও খালেস দাসত্ব দান করুন এবং আপনার ইবাদতের তাওফিক দিন। আপনার ক্ষমা ও মার্জনার মাধ্যমে আমাদের ওপর অনুগ্রহ করুন। আপনি আমাদেরকে উত্তম চরিত্রের দিকে পরিচালিত করুন। আপনি ব্যতীত কেউ উত্তম চরিত্রের দিকে পরিচালিত করতে পারে না এবং মন্দ চরিত্র থেকে আমাদেরকে দূরে রাখুন। মন্দ চরিত্রগুলো আপনি ব্যতীত কেউ আমাদের থেকে দূর করতে পারে না।

দ্বিতীয় খুতবা

আল্লাহ তায়ালা যখন আমাদেরকে হজের কার্যাদির পাথেয় সংগ্রহ করতে আহ্বান করেছেন তখন শ্রেষ্ঠ পাথেয়র দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি মহাগ্রন্থে বলেন, ‘আর তোমরা পাথেয় সংগ্রহ কর। নিশ্চয় সবচেয়ে উত্তম পাথেয় হচ্ছে তাকওয়া। হে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ! তোমরা আমারই তাকওয়া অবলম্বন কর।’ (সুরা আল-বাকারা: ১৯৭)

এ আহ্বান জানিয়েছেন হজের সময় এবং তার মাসগুলোর বর্ণনা প্রদানের প্রেক্ষাপটে; যে মাসগুলো রমজান মাসের পরেই আগমন করে। আর আল্লাহ তায়ালা হজের আলোচনার পূর্বে সিয়ামের বিধান বর্ণনার সময় বলেন, ‘তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়াবান হতে পার।’ (সুরা আল-বাকারা: ১৮৩)

এ কথার প্রতি ইশারাস্বরূপ যে, তাকওয়া হলো যাত্রা পথের শুরু ও শেষ এবং মুমিনের বাহন। আল্লাহ তায়ালা আমাকে ও আপনাদেরকে তাকওয়া পাথেয় হিসেবে প্রদান করুন এবং তাঁর পছন্দনীয় ও সন্তোষজনক কাজ সম্পাদনের তাওফিক দান করুন।

হে মুমিন নর-নারী সম্প্রদায়! হজের মাসসমূহ শরিয়তসিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে গভীর দৃষ্টি প্রদানকারীর কাছে যে হেকমতগুলো সুস্পষ্ট হবে তার অন্যতম হলো- হজের নিদর্শনসমূহ ও তার কার্যাদি সম্পর্কে অন্তরে তাজিম ও শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হওয়া। যেমনিভাবে আল্লাহ তায়ালা হজের জন্য স্থানগত সম্মানিত এলাকা নির্ধারণ করেছেন তেমনিভাবে তার জন্য মর্যাদাপূর্ণ মৌসুম নির্ধারণ করেছেন; যেন মনের মাঝে হজের নিদর্শনের বিষয়ে শ্রদ্ধাবোধ ও হূদয়ে তার পবিত্রতা বদ্ধমূল হয়। এজন্য হজের কত মাস হারাম মাসসমূহের অন্তর্ভুক্ত। আর তা হলো, পুরো জিলকদ মাস এবং পুরো জিলহজ মাস কিংবা তার ১০ বা ১৩ দিন উলামাদের মতভেদের ওপর ভিত্তি করে।

সুতরাং এগুলো একই সঙ্গে হারাম (সম্মানিত) ও হজের মাস। আর এটা এ মহান ইবাদতের অধিক শ্রেষ্ঠত্বের কারণে এবং এর মর্যাদা অন্তরে গেঁথে দেয়ার জন্য। সুতরাং এর সম্মান ও পবিত্রতা নষ্ট করতে কেউ যেন দুঃসাহস না দেখায়।

৩ মে ২০২৪ মদিনা মুনাওয়ারার মসজিদে নববিতে দেয়া জুমার খুতবার

ভাষান্তর— হারুনুর রশিদ ত্রিশালী

নয়াশতাব্দী/ডিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ