ঢাকা, রবিবার, ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১, ১১ রজব ১৪৪৬

যে পাঁচ পাপে নেমে আসে জাতীয় বিপদ

জুমার বয়ান থেকে
প্রকাশনার সময়: ০৩ মে ২০২৪, ০৭:২৩

আমরা এমন এক সময় অতিবাহিত করছি, যখন দেশে চলছে হিট এলার্ট। তাপমাত্রা স্মরণকালের সব রেকর্ড ভেঙে তা ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্তও কোনো কোনো জেলায়। গরমের তীব্রতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে হিটস্ট্রোকে মানুষ মারা যাচ্ছে। মাঠে-ঘাটে, ক্ষেত-খামারে মানুষ কাজ করছে অতি কষ্টে। মানুষের পাশাপাশি আল্লাহ তায়ালার অনেক নিষ্পাপ মাখলুকও ভোগ করছে অবর্ণনীয় কষ্ট। এই যে প্রকৃতির রুদ্ররূপ তা আমাদের নিজেদের হাতের কামাই।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের কারণে জলে স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, যাতে তিনি তাদেরকে তাদের কোনো কোনো কাজের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা (অসৎ পথ হতে) ফিরে আসে।’ (সুরা রুম: ৪১)

মানুষ যখন আল্লাহর আদেশ-নিষেধ অগ্রাহ্য করে বিভিন্ন গুনাহ বা অপকর্মে লিপ্ত হয় তখন আল্লাহ তায়ালা মানুষকে ছোট ছোট শাস্তি দেন। যাতে মানুষ নিজের ভুল বুঝতে পেরে তওবা করে। ফিরে আসে আল্লাহর দিকে। আল্লাহর দয়া যে আমাদের দয়ার নবীর দোয়া কবুল করেছিলেন। তিনি আল্লাহর কাছে আবেদন করেছিলেন, যেন তাঁর আদরের উম্মতকে যত গুনাহই করুক, পূর্ববর্তী পাপাচারী জাতিগুলোর মতো সমূলে বিনাশ না করে দেয়া হয়।

এমন কিছু পাপ আছে, যা ব্যক্তি থেকে সমাজে সংক্রমিত হয়, তখন তারা কোনো নসিহতকারীর নসিহত বা সতর্ককারীর সতর্কবার্তায় কর্ণপাত করে না। তখন আল্লাহ তাদেরকে কিছু শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে। নবীজির দোয়াটি না থাকলে এসব পাপে তাদেরকে জাতি হিসেবে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হতো। একটি বিখ্যাত হাদিসে নবীজি (সা.) জাতীয় পাঁচটি পাপের কথা বলেছেন, যার শাস্তিও আল্লাহ দান করেন জাতীয়ভাবে।

ইবনে মাজা, আত-তারগীব, তাবরানি ও সিলসিলা সহিহায় বর্ণিত হাদিসে এসেছে, ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলেন, হে মুহাজির দল! পাঁচটি কর্ম এমন রয়েছে যাতে তোমরা লিপ্ত হয়ে পড়লে (উপযুক্ত শাস্তি তোমাদেরকে গ্রাস করবে)। আমি আল্লাহর নিকট পানাহ চাই, যাতে তোমরা তা প্রত্যক্ষ না কর।

১. যখনই কোনো জাতির মধ্যে অশ্লীলতা (ব্যভিচার) প্রকাশ্যভাবে ব্যাপক হবে, তখনই সেই জাতির মধ্যে প্লেগ এবং এমন মহামারি ব্যাপক হবে যা তাদের পূর্বপুরুষদের মাঝে ছিল না। ২. যে জাতিই মাপ ও ওজনে কম দেবে, সে জাতিই দুর্ভিক্ষ, কঠিন খাদ্য-সংকট এবং শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারের শিকার হবে।

৩. যে জাতিই তার মালের জাকাত দেয়া বন্ধ করবে, সে জাতির জন্যই আকাশ থেকে বৃষ্টি বন্ধ করে দেয়া হবে। যদি অন্যান্য প্রাণিকুল না থাকত, তাহলে তাদের জন্য আদৌ বৃষ্টি হতো না। ৪. যে জাতি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে, সে জাতির উপরেই তাদের বিজাতীয় শত্রু দলকে ক্ষমতাসীন করা হবে; যারা তাদের মালিকানাভুক্ত বহু ধন-সম্পদ নিজেদের কুক্ষিগত করবে। ৫. আর যে জাতির শাসকগোষ্ঠী যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহর কিতাব (বিধান) অনুযায়ী দেশ শাসন করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি তাদের মাঝে গৃহদ্বন্দ্ব অবস্থায় রাখবেন।’ (বর্ণনা সহিহ)

১. অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা

‘যখনই কোনো জাতির মধ্যে অশ্লীলতা (ব্যভিচার) প্রকাশ্যভাবে ব্যাপক হবে।’ অর্থাৎ কোনো জাতির মধ্যে যখন অশ্লীলতা, নগ্নতা ও বেহায়াপনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এমন প্রকাশ্য রূপ লাভ করে যে তা আর গুনাহ মনে হয় না। বরং তাদের কাছে তা ফ্যাশন ও উন্নতি বলে মনে হয়।

নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, অবাধ যৌনাচার, বিকৃত যৌনাচার, হোলি উৎসব এবং নানারকম মেলামেশার পার্টি, লিভ-টুগেদার, বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড সংস্কৃতির মাধ্যমে বেলেল্লাপনা ও অশ্লীলতা এখন জাতীয় রূপ লাভ করছে। এসব তো আমাদের অস্তিত্বের জন্য রীতিমতো ভয়ঙ্কর হুমকি। এমন হলে আল্লাহ তায়ালা সেই জাতির মধ্যে জাতীয়ভাবে মহামারি-অতিমারি চাপিয়ে দেন। যেমন, কোভিড-১৯ নামক মহামারি আমরা দেখেছি কী মারাত্মক রূপ ধারণ করেছিল পৃথিবীব্যাপী।

দ্বিতীয় শাস্তি— তাদের মধ্যে এমন এমন রোগের বিস্তার ঘটবে যা আগের যুগের কোনো জাতির মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। যেমন, এইডস নামক জীনবঘাতি রোগ আমরা দেখছি। যা অবাধ যৌনতার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। আফসোস বর্তমানে মুসলিম দেশগুলোতেও ইসলাম নির্দেশিত বৈধ বিয়েকে করা হচ্ছে কঠিন আর অবাধ যৌনতা বা জেনাকে করা হচ্ছে উদ্বুদ্ধ। তরুণ-তরুণীদের বিয়ে ফরজ হয়ে যাওয়ার পরেও সমাজ-রাষ্ট্র তাদের বিয়েতে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। অথচ বিয়ে বহির্ভূত হারাম সম্পর্ক ও যৌনতাকে নানাভাবে প্রমোট করা হচ্ছে।

২. ওজনে কম দেয়া

ওজনে কম দেয়া যখন কোনো জাতির মধ্যে ব্যাপকতা লাভ করে। তখন (ক.) আল্লাহ তাদেরকে দুর্ভিক্ষে পতিত করেন। (খ.) খাদ্যসংকট তৈরি করে দেন কিংবা নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে দেন। (গ.) শাসক কর্তৃক তাদের ওপর জুলুম চাপিয়ে দেন তথা শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারের শিকার বানান তাদের।

সমসাময়িককালে ওজনে ফাঁকি আমাদের মাঝে এমনভাবে ব্যাপকতা পেয়েছে যে, দুধ বিক্রেতা ওজনে ফাঁকি দিচ্ছে মাছওয়ালাকে, মাছওয়ালা ফাঁকি দিচ্ছে সবজি বিক্রেতাকে, সবজি বিক্রেতা ফাঁকি দিচ্ছে মাছওয়ালাকে, মুদি দোকানি ফাঁকি দিচ্ছে দুধওয়ালাকে এভাবে চক্র আকার ধারণ করেছে ওজনে ফাঁকি দেয়া। শুধু কি তাই, চাকরিজীবীরাও এর বাহিরে নয়। তারা তাদের কর্ম ঘণ্টায় ফাঁকিবাজি করছে। এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে ফাঁকিবাজি ও প্রতারণা বিস্তার লাভ করেনি। সবখানে ফাঁকিবাজি। পুরো জাতি যেন প্রতারক ও ফাঁকিবাজে পরিণত হয়েছে।

৩. জাকাত না দেয়া

যখন কোনো জাতি জাকাত আদায়ে গড়িমসি করে, টালবাহানায় লিপ্ত হয়। তখন আল্লাহ তায়ালা আসমান থেকে রহমতের ফোঁটা বন্ধ করে দেন। অর্থাৎ সেই জাতিকে বৃষ্টি থেকে বঞ্চিত করা হয়।

জাকাত দিতে মানুষ কত যে টালবাহানা করে! টিভিতে দর্শকদের একেকটি প্রশ্ন শুনে অবাক হই। জাকাত না দেয়ার কত ফন্দিফিকির চারপাশে! অনেকে বলে ব্যবহার্য স্বর্ণের জাকাত দিতে হয় না। অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে একজন মহিলা এলে তার হাতের স্বর্ণের বালা দেখে বললেন, তুমি এটার জাকাত দিয়েছ? বলল না, রাসুল (সা.) বললেন, কিয়ামতের দিন তোমার হাতে আগুনের বালা পোড়ানো হবে। তখন মহিলাটি সেই বালা আল্লাহর রাস্তায় দান করে দিলেন। (মুসলিম)

এই ঢাকা মহানগরীতে কয়েক লাখ কোটিপতি আছেন, কয়েক কোটি লাখপতি ও কোটিপতি আছেন, তাদের চারভাগের একভাগ লোকও ঠিকমতো জাকাত দেয় না। জাকাত বোর্ডগুলো গবেষণা করে দেখিয়েছে, মাত্র তিন বছর যদি ঠিকমতো জাকাত তোলা হয় কেন্দ্রীয়ভাবে আর তা বিতরণ করা হয় যথাযথভাবে, তাহলে দেশে দারিদ্র্যের হার শূন্যের কোটায় চলে আসবে।

আজ আমরা বৃষ্টি প্রার্থনা করেও বৃষ্টি পাচ্ছি না, জাকাত আদায় না করার কারণে।

আমাদের বিচিত্র পাপ ও অনাচারের কারণে। নাস্তিকরা বলে, তাহলে আবার অনেক জায়গায় বৃষ্টি হয় কেন? রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা পুরোপুরি বৃষ্টি বন্ধ করেন না। কারণ পৃথিবীতে এমন অনেক মাখলুক আছে যারা নিষ্পাপ। তাই তাদের প্রতি দয়ার্দ্র হয়ে কোথাও বৃষ্টি দেন।

৪. আল্লাহ ও রাসুল (সা.) এর সঙ্গে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করা

আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করলে আল্লাহ তায়ালা সেই জাতির ওপর বিজাতীয়দের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে দেন। কালেমার প্রথম অংশ— ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।’ (আল্লাহ ছাড়া হক কোনো মাবুদ নেই)। আর প্রতিদিন আমরা প্রতি রাকাতে সুরা ফাতিহায় প্রতিশ্রুতি দেই— ‘ইয়্যা কানাবুদু ওয়া ইয়্যাকানাস্তাইন।’ (আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি, কেবল তোমারই কাছে সাহায্য চাই)। (সুরা ফাতিহা: ৪)

আমরা রুহের জগতে ওয়াদা করেছি। কালেমার মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছি— কাউকে তাঁর সঙ্গে শরিক করব না। তিনিই মাবুদ। তিনিই বিচারক। তিনি জীবনদাতা, রিজিকদাতা, আইনদাতা। তিনিই সব। তাঁর কাছে ছাড়া কারও কাছে চাইব না। অথচ বিভিন্ন ধরনের মুর্তি বানিয়ে বৈশাখে মঙ্গল কামনা করা হচ্ছে। আবার ব্যাঙের বিয়ে দিয়ে বৃষ্টি কামনা করছে। প্রকারান্তরে সবই শিরক। এটা আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদা ভঙ্গের শামিল।

‘মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ (মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসুল)। আমাদের জন্য একমাত্র অনুসরণীয় ব্যক্তি হচ্ছেন রাসুল মুহাম্মাদ (সা.)। রাসুল (সা.) কর্তৃক আনিত দ্বীনকে তাঁর সুন্নাহ অনুযায়ী পালন না করে নিজেদের মতো করে পালন করা। তাঁর আনিত দ্বীনকে অগ্রাহ্য করা। এসবই রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করার অন্তর্ভুক্ত।

রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নামাজ হচ্ছে কাফের আর মুমিনের মধ্যে পার্থক্য।’ ‘মুমিন-কাফেরের পার্থক্য নামাজের চুক্তি।’ (মুসলিম) অথচ এ জাতির ৫০% মুসলমানও নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে না। এটা আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ওয়াদার খেলাফ। এমনভাবে আমরা দ্বীনের প্রতিটি আদেশ-নিষেধ অমান্য করে ওই চুক্তির খেলাফ করছি।

৫. কোরআন দিয়ে বিচার-ফয়সালা না করা

কোনো ভূখণ্ডে মুসলিম শাসকরা যদি কোরআন দিয়ে বিচার-ফয়সালা না করে। সেই জাতিকে আল্লাহ তায়ালা বিভক্ত করে দেন। তাদের ঐক্য বিনষ্ট করে দেন। তাদের অন্তরগুলো ছিন্নভিন্ন করে দেন। ফলে তারা এক হতে পারে না। এর বাস্তবতা আমাদের চোখের সামনে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ ধরনা দেয় আমেরিকার আর কেউ ভারতের কাছে।

জাতীয় সংকটেও দলগুলো এক হতে পারে না। আইন-আদালত, বিচার-প্রশাসন থেকে নিয়ে ব্যক্তি-পরিবার-রাষ্ট্রের কোথাও আমরা আল্লাহর রজ্জু তথা কুরআনকে নিজেদের জন্য আদর্শ বানাতে পারিনি। তাইতো আমরা শতধা বিভক্ত। আমরা এক পা এগুলে দশ পা পিছিয়ে আসি।

পরিশেষে বলি, আমরা জাতি হিসেবে উপরের সবগুলো পাপ থেকে ইস্তিগফার করব। বৃষ্টির জন্য তাওবা, দান-সদকা ও বৃষ্টিপ্রার্থনার নামাজ আদায় করব। আশা করা যায় আল্লাহ আমাদের মুক্তি দেবেন। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

২৬ এপ্রিল টঙ্গীর আন-নুর জামে

মসজিদে কৃত জুমাপূর্ব বয়ানের

অনুলিখন— মুহা. আব্দুল খালেক আশিক.

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ