সময়ের বৈচিত্র্য ও ঋতুর পরিবর্তন আল্লাহ তায়ালার অনন্য নিয়ামত। প্রতিটি ঋতুর আলাদা আলাদা সুযোগ সুবিধা আছে। শীত-গরম পুরো বছরের প্রধান দু’টি ঋতু। বেশ কয়েকদিন ধরেই সারা দেশজুড়ে চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে জনজীবনে নেমে এসেছে হাঁসফাঁস অবস্থা। এই গরমে যেসব আমল করে একজন মুমিন নিজের সওয়াবের পাল্লা খুব সহজেই ভারি করতে পারে।
ইস্তিস্কার নামাজ আদায়: রোদ-বৃষ্টি আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে নয়, তাই কখনো অনাবৃষ্টি ও তীব্র তাপপ্রবাহে জনজীবন সংকটময় হলে, শরিয়ত যেই নামাজের নির্দেশ দেয়, তার নাম সালাতুল ইস্তিস্কা বা বৃষ্টির নামাজ। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে বৃষ্টির প্রার্থনায় বিশেষ এই নামাজ পড়া মুস্তাহাব।
ইস্তিস্কা নামাজের পদ্ধতি: ইস্তিস্কা বা বৃষ্টি প্রার্থনার এই নামাজের বিশেষ পদ্ধতির কথা ফিকহ ও ফতোয়ার কিতাবে এসেছে। খোলা ময়দানে আজান-ইকামত ছাড়া উঁচু স্বরে কেরাতে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতে হয়। নামাজের পর ইমাম খুতবা দেবেন। খুতবায় বেশি বেশি ইস্তিগফার ও কোরআন তিলাওয়াত করবেন। এরপর দু’হাত উঠিয়ে মিনতির সঙ্গে দোয়া করবেন এবং হাদিসে বর্ণিত দোয়াগুলো বেশি বেশি পড়বেন। মুসল্লিরাও তখন কায়মনোবাক্যে তাঁর সঙ্গে শরিক হয়ে দোয়া পড়বেন।
বৃষ্টির নামাজে বিনয়-নম্রতার সঙ্গে গমন করা সুন্নত। একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই যে বান্দার সব প্রয়োজন পূরণ করেন— এই বিশ্বাস অন্তরে জাগ্রত রাখতে হবে। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) খুবই সাদামাটাভাবে, বিনয়-নম্রতা ও আকুতিসহ বাড়ি থেকে বের হয়ে নামাজের মাঠে উপস্থিত হয়েছেন।’ (আবু দাউদ: ১১৬৫)
বৃষ্টির নামাজের দোয়া: বৃষ্টির নামাজ আদায়ের সময় নিচের দোয়াটি পাঠ করা খুবই কল্যাণকর। এ দোয়াটি স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) বৃষ্টির জন্য পাঠ করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, লোকজন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে অনাবৃষ্টির কষ্টের কথা বললে তিনি ঈদগাহে সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে এই দোয়া করেন। এরপর আল্লাহর হুকুমে বৃষ্টি বর্ষণ হতে শুরু করে। বৃষ্টি থেকে পরিত্রাণ পেতে মানুষের ছোটাছুটি দেখে নবীজি (সা.) হেসে ফেলেন।
দোয়াটি হলো— উচ্চারণ: ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। আর-রাহমানির রাহিম। মালিকি ইয়াউমিদ্দিন। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ইয়াফয়ালু মা-ইউরিদ। আল্লাহুম্মা আনতাল্লাহু লা-ইলাহা ইল্লা আনতাল গানিয়্যু ওয়া নাহলুল ফুকারাউ। আনজিল আলাইনাল গাইছা ওয়াজআল মা আনজালতা লানা কুওয়্যাতান ওয়া বালাগান ইলা হিন।’
অর্থ: ‘সব প্রশংসা পৃথিবীর প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তিনি পরম করুণাময়, দয়ালু ও বিচার দিবসের মালিক। আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তিনি যা-ইচ্ছা তাই করেন। হে আল্লাহ! তুমিই একমাত্র মাবুদ, তুমি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তুমি ধনী, আমরা গরিব। আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করো এবং আমাদের জন্য যা অবতীর্ণ করো, তা আমাদের জন্য শক্তিময় ও কল্যাণ দান করো।’ (আবু দাউদ: ১১৭৩)
তওবা করা: তীব্র তাপদাহ ও অনাবৃষ্টির যেসব কারণ আছে, তার অন্যতম একটি সমাজে গুনাহ বেড়ে যাওয়া। তাই প্রত্যেক মানুষের উচিত খাঁটি দিলে আল্লাহ তায়ালার কাছে তওবা করা। আর তওবা আল্লাহ তায়ালার কাছে অত্যন্ত পছন্দনীয় একটি আমল। যার দ্বারা আল্লাহ তায়ালা বান্দার যাবতীয় সব গুনাহ মাফ করে থাকেন। তওবা আল্লাহ তায়ালার কাছে কতটা প্রিয় আমরা তা চিন্তাও করতে পারব না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বান্দার তওবার কারণে সেই লোকটির চেয়েও বেশি খুশি হন, যে লোকটি মরুভূমিতে তার (একমাত্র বাহন) উট হারিয়ে পেলে যে পরিমাণ খুশি হয়, তার চেয়ে বেশি খুশি আল্লাহ তায়ালা হন।’ (বুখারি: ৬৩০৯)
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘তবে কেউ তওবা করলে, ঈমান আনলে এবং সৎকর্ম করলে, আল্লাহ এরূপ লোকদের পাপরাশি পুণ্য দিয়ে পরিবর্তিত করে দেবেন। আল্লাহ তায়ালা অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা ফুরকান: ৭০) একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘গুনাহ থেকে তওবাকারী তো ওই ব্যক্তির মতো যার কোনো গুনাহ নেই।’ (ইবনে মাজাহ: ৪৩৯) অপর একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘মানুষ মাত্রই গুনাহগার (অপরাধী)। আর গুনাহগারদের মধ্যে তওবাকারীরাই উত্তম।’ (ইবনে মাজাহ: ৪২৫১)
উপরন্তু যে বান্দা খাঁটি দিলে আল্লাহ তায়ালার কাছে তওবা করবে এর বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তাকে মাফ করে দেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘এবং তিনিই নিজ বান্দাদের তওবা কবুল করেন ও গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেন। আর তোমরা যা কিছু করো তা তিনি জানেন।’ (সুরা শুরা: ২২)
ইস্তিগফার করা: যাবতীয় বালা-মুসিবত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মুক্তির যেসব মাধ্যম আছে, তার অন্যতম একটি হলো বেশি বেশি ইস্তিগফার করা। আর ইস্তিগফার মানে হচ্ছে, কৃত গুনাহের ওপর লজ্জিত হওয়া। আমরা যেহেতু উঠতে, বসতে, সব সময় গুনাহ করে থাকি, সেহেতু আমাদের জন্য উঠতে, বসতে, সব সময় অধিক পরিমাণে ইস্তিগফার তথা কৃত গুনাহের ওপর অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে মাওলা পাকের কাছে ফিরে যাওয়া জরুরি। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘হে মুমিনরা! তোমরা সবাই আল্লাহর সমীপে তওবা করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।’ (সুরা নূর: ৩১) অপর এক আয়াতে বর্ণিত হয়েছে- ‘আমি তাদেরকে বলেছি, নিজ প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল।’ (সুরা নূহ: ১০) অপর এক আয়াতে বর্ণিত হয়েছে- ‘আমি তাদেরকে বলেছি, নিজ প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল। তিনি আকাশ থেকে তোমাদের ওপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে উন্নতি দান করেন ও তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেন উদ্যান। আর তোমাদের জন্য নদ-নদীর ব্যবস্থা করেন।’ (সুরা নূহ: ১০-১২)
লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া কাশেফুল উলূম মাদ্রাসা, মধুপুর, টাঙ্গাইল
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ