ব্যাংকের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ‘ফিন্যান্সিং’ বা অর্থসংস্থান করা; অর্থাৎ অপরকে ব্যবসা ইত্যাদির জন্য পুঁজি জোগাড় করে দেয়ার ইসলামি বিভিন্ন পদ্ধতি প্রসঙ্গে আলোচনায় আসা যাক। শরয়ী দৃষ্টিকোণে এর কতগুলো পদ্ধতি হতে পারে:
১. শিরকত ও মুদারাবা: সুদের সঠিক ও বিকল্প ইসলামি ব্যবস্থা হলো শিরকত (অংশীদারি হয়ে ব্যবসা) এবং মুদারাবা (একজনের পুঁজি ও অপরজনের শ্রম ব্যয়ে ব্যবসা)। এ ধরনের ব্যবসার সুফল সুদি কারবারের তুলনায় বহুগুণে বেশি। আর উক্ত প্রকার ব্যবসায় অংশগ্রহণ করাই হলো অর্থসংস্থানের নিতান্ত আদর্শভিত্তিক ন্যায়সঙ্গত ও ইনসাফপূর্ণ পদ্ধতি; যাতে লভ্যাংশ ভাগাভাগির ক্ষেত্রেও বড় সুফল সন্নিবিষ্ট থাকে।
শিরকত ও মুদারাবার নিয়ম ব্যবস্থা জারি হওয়ার ক্ষেত্রে সমস্ত কারবারে রীতিমতো ব্যাংকের কর্তৃত্ব চলবে। অর্থাৎ এখানে তার পজিশন কেবল টাকা জমা রাখা ও তোলার কোনো প্রতিষ্ঠানের মতোই থাকবে না।মূলত ইসলামি ফিন্যান্সিং পদ্ধতি শিরকত বা মুদারাবা হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুদারাবার রূপ দান করা সম্ভব হয় না। যেমন, কোনো এক কৃষকের একটি ট্রাক্টর খরিদ করার জন্য পুঁজির প্রয়োজন হলে তাকে ‘মুদারাবা’ রূপে পুঁজি সংস্থান করা সম্ভব নয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আরও কয়েকটি ফিন্যান্সিং পদ্ধতি নিম্নরূপ:
২. ইজারা: এটিও একটি শরয়ী ফিন্যান্সিং পদ্ধতি; যাকে ইংরেজিতে (LEASING) (লিজ দেয়া) বলে। এর নিয়ম হলো এই যে, কৃষক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নিজে ট্রাক্টর ক্রয় করার পরিবর্তে কোনো ব্যাংক অথবা অর্থ প্রতিষ্ঠানকে আবেদন জানাবে, যাতে এ ট্রাক্টর কিনে তাকে ভাড়া দেয়া হয়।
এক্ষেত্রে ট্রাক্টরের মালিক হবে উক্ত ক্রয়কারী ব্যাংক বা অর্থ প্রতিষ্ঠান। আর কৃষক ভাড়া গ্রহণকারী হিসেবে তা গ্রহণ করবে। ভাড়া এমন হারে নির্ধারিত করা হবে, যেন তাতে ট্রাক্টরের দামও উসুল হয়ে যায় এবং ততটা মেয়াদের জন্য উক্ত অঙ্কের অর্থ দ্বারা ব্যাংকের অংশীদারি কারবারে অংশীদার হলে যে মুনাফা আসত তাও লাভ হয়। যখন নির্দিষ্ট মেয়াদ উত্তীর্ণ হবে এবং ভাড়া আকারে প্রাপ্ত টাকার মাধ্যমে ট্রাক্টরের মূল্য তথা কিছু লাভও উসুল হয়ে যাবে, তখন সেই ট্রাক্টরটি এ কৃষকের মালিকানাধীন থেকে যাবে।
৩. বিলম্বিত মুনাফা অর্জন: এটি এরূপে হবে যে, যখন কোনো ব্যক্তি ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে আসবে, তখন তাকে কোন জিনিস ক্রয় করার জন্য ঋণ নেবে তা প্রশ্ন করা হবে। ব্যাংক তাকে টাকা দেয়ার পরিবর্তে তার সেই দরকারি জিনিস নিজে ক্রয় করে পুনরায় তাকে লাভ রেখে ধারে বিক্রয় করবে (সে ব্যক্তি তা সংগ্রহ করে কিস্তিতে টাকা মিটাবে)। লাভের একটি নির্দিষ্ট হার স্থির করে মুনাফা লাভ এ জন্যই করা হবে; যাতে নিয়ম-ব্যবস্থায় ভারসাম্য বজায় থাকে এবং সকল শ্রেণির মানুষের নিকট থেকেই লাভ একই হারে আদায় করা সম্ভব হয়। এই লাভের যে নির্দিষ্ট হার স্থির করা হয় তাকে ইংরেজিতে (MARK UP) মার্কআপ বলা হয়।এরূপ বিলম্বিত মুনাফা লাভের সঙ্গেও অর্থসংস্থান করা এক প্রকার বৈধ ফিন্যান্সিং হতে পারে। তবে এতে শর্ত এই যে, তা যেন সঠিক আকারে জরুরি শর্তাবলি পালনের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়। যেহেতু ধারে বিক্রয়ের জন্য দাম বেশি নেয়া ফকিহগণের নিকট সর্বসম্মতভাবে বৈধ। পরন্তু ইসলামি ব্যাংকগুলোতেও এই শেষোক্ত পদ্ধতির ওপর বড় ব্যাপক আকারে আমল করা হচ্ছে। কিন্তু এটা নেহাতই স্পর্শকাতর পদ্ধতি। কারণ এতে কিঞ্চিৎ পরিমাণের অসাবধানতা একে বৈধ কারবার থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে সুদি কারবারের ভাগাড়ে ফেলে দিতে পারে।
সুদি কারবার হলো সর্বনাশী ও বিশ্ব বিধ্বংসীতার দুয়ার ও পথ এবং ব্যাংক হলো তার আন্তর্জাতিক বাজার। আর এই হলো সেই সর্বনাশের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার লক্ষ্যে আমলযোগ্য ইসলামি পদ্ধতি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য যা হারাম করেছেন তা বিশদভাবে তোমাদের নিকট বিবৃত করেছেন; তবে নিরুপায় অবস্থার কথা স্বতন্ত্র।’ (সুরা আনআম: ১১৯)
যেহেতু আল্লাহ তায়ালা তাঁর হারামকৃত জিনিসগুলোকে বিশদ ও স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন সেহেতু যথাসাধ্য চেষ্টা-সাধনা করে সুদ থেকে বাঁচা একজন পাক্কা-সাচ্চা মুসলিমের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। বরং যেখানে সূদের গন্ধ আছে, যে পয়সায় সুদের মিশ্রণ আছে বলে সন্দেহ আছে সেখান ও সে পয়সা থেকে দূরে থাকাও তার জন্য জরুরি। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহর (হারাম) সীমারেখার ধারেপাশেই ঘোরাফেরা করে তার জন্য এই আশঙ্কা থাকে যে, কখন যে তার পা পিছল কেটে এ হারাম ও নিষিদ্ধ সীমায় গিয়ে আপতিত হয়ে যাবে, সে তার আদৌ টের পাবে না।
প্রত্যেক মুসলিমের জন্য আরও একটি ভয় সর্বদা এই রাখা ওয়াজিব যে, যাতে সে নিজে নবী (সা.)-এর সেই বাণীর উদারহণ না হয়ে যায়, যাতে তিনি বলেছেন, ‘মানুষের ওপর এমন একটি যুগ (অবশ্যই) আসবে, যখন সে এ কথার কোনো পরোয়াই করবে না যে, সে যা গ্রহণ (উপার্জন) করছে তা হালালের শ্রেণিভুক্ত অথবা হারামের।’ (বুখারি: ২০৫৯) উপরন্তু এ ভয়েও মুসলিমকে কেঁপে ওঠা দরকার যে, যাতে সে নবী (সা.)-এর এই বাণীর উপমা না হয়ে যায়, যাতে তিনি বলেছেন, ‘আমার উম্মতের একদল লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা অবশ্যই পান করবে।’ (মুসনাদে আহমদ: ৫/৩৪৩, সহিহুল জামে: ৫৪৫৩)
সুতরাং অনুরূপভাবে সেও সুদের মনোলোভা হালালসূচক নাম ‘লভ্যাংশ, বোনাস বা অনুদান’ দিয়ে তা ভক্ষণ করছে না তো? অথচ খোদ ব্যাংকওয়ালারা তার নাম রেখেছে সুদ বা ইন্টারেস্ট। আর যথার্থতা ও প্রকৃষ্টতা প্রমাণের জন্য দুশমনের সাক্ষ্যই অধিক ফলপ্রসূ।
যারা ব্যাংকের সুদকে হালাল বলে ফতোয়া দেন তাদেরকে নিজেদের উক্ত ফতোয়া নিয়ে পুনর্বিবেচনা করা উচিত। নচেৎ এ রকম তো নয় যে, তারা ইসলামের দুশমনদের সহায়তা এবং আল্লাহ তায়ালার ওপর মিথ্যা রচনা করেছেন? আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(হে নবী! তুমি) বল, ‘কি রায় তোমাদের, আল্লাহ তোমাদেরকে যে রুজি দান করেছেন তোমরা যে তার কিছুকে অবৈধ ও বৈধ করে নিয়েছ’; বল, ‘আল্লাহ কি তোমাদেরকে এর অনুমতি দিয়েছেন; নাকি তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করছ?’ (সুুরা ইউনুস: ৫৯)
তিনি আরও বলেন, ‘তোমাদের মুখ থেকে সাধারণত মিথ্যা বের হয়ে আসে বলে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে বলো না যে, ‘এটা হালাল আর এটা হারাম।’ নিশ্চয় যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তারা সফলকাম হবে না।’ (সুরা নাহল: ১১৬)অথবা তাঁরা এ কথার বাস্তব নমুনা তো নন, যে কথা আবু সাঈদ খুদরী (রা.) আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসকে (রা.) বলেছিলেন, ‘হে ইবনে আব্বাস! আর কতদিন যাবৎ লোকদেরকে সুদ খাওয়াতে থাকবেন? শুধু কি আপনি আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সাহচর্য পেয়েছেন, আর আমরা পাইনি? শুধু আপনিই কি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট থেকে হাদিস শুনেছেন, আর আমরা শুনিনি?’ এ কথা শুনে আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস বললেন, ‘আপনি যা ভাবছেন তা নয়; বরং উসামা বিন যায়েদ আমাকে হাদিস বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সুদ তো কেবল ঋণেই পাওয়া যায়।’ তা শুনে আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বললেন, অর্থাৎ, আল্লাহর কসম! ততদিন পর্যন্ত কোনো গৃহের ছায়া আমাদেরকে আশ্রয় দেবে না, যতদিন পর্যন্ত আপনি উক্ত ফতোয়ার ওপর অটল থাকবেন! (অর্থাৎ ততদিন আমি আপনার সহিত দেখা-সাক্ষাৎ করব না।) (দেখুন, আল মাবসূত্ব: ২/১১১-১১২)
আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) এর ফতোয়া ছিল, কেবল ঋণের কারবারেই সুদ পাওয়া যায় এবং একই শ্রেণিভুক্ত দুটি জিনিসের কম-বেশি করে হাতে হাতে লেনদেনে সুদ হয় না। যেমন, স্বর্ণের পরিবর্তে স্বর্ণ বেশি (হাতে হাতে) নেয়া বৈধ। অথচ তা উবাদা বিন সামেত (রা.) এর হাদিসের স্পষ্ট উক্তি অনুসারে হারাম ও সুদ। অবশ্য পরবর্তীকালে আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) এই হাদিস শুনে তাঁর উক্ত ফতোয়া দান করা থেকে বিরত হয়েছিলেন। (মুগনী: ৪/৩)
যদি আমাদের কেউ না জানার কারণে অথবা কোনো শয়তানি চক্রান্তে পড়ে অথবা মনের কুপ্রবৃত্তি বশে অথবা কারও ফতোয়ায় ধোঁকা খেয়ে ব্যাংক থেকে সুদ নিয়ে তা ব্যবহার করে ফেলেছে, কিংবা (বিকল্প উপায় থাকা সত্ত্বেও) ব্যাংক থেকে লোন বা ঋণ নিয়ে তাকে সুদ প্রদান করেছে, তাহলে তার অপরিহার্য কর্তব্য হলো সত্বর তওবা করা এবং এই সংকল্প করা যে, আমরা আর সুদ নেয়া ও দেয়ার মতো বড় গুনাহতে নির্বিচল থাকব না।
বরং সেই সকল লোকদের দলভুক্ত হতে যথাসাধ্য প্রয়াস করব, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(তারা মুত্তাকীন) যারা কখনো কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা কোনো মন্দ কাজে জড়িত হয়ে নিজের ওপর জুলুম করে ফেললে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া আর কে পাপ ক্ষমা করবেন? তারা নিজেদের কৃতকর্মের জন্য হঠকারিতা প্রদর্শন করে না এবং জেনেশুনে তাই (বারবার) করতে থাকে না। তাদেরই জন্য প্রতিদান হলো তাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও জান্নাত; যার তলদেশে প্রবাহিত আছে বিভিন্ন প্রস্রবণ-সেখানে তারা অনন্তকাল বাস করবে। আর যারা সৎকর্ম করে তাদের জন্য কতই না চমৎকার প্রতিদান!’ (সুরা আলে ইমরান: ১৩৫-১৩৬)
সুতরাং আমরা আল্লাহর নিকট নিজ কৃতপাপের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হবো। আল্লাহ অবশ্যই নিতান্ত ক্ষমাশীল, পরম করুণাময় ও দয়াবান। তাঁর নিকট কোনো সংকীর্ণতা নেই। তিনি তো আমাদেরকে পাপমুক্ত করতে চান। অতএব, যত শিগগির সম্ভব তত শিগগিরই আমাদেরকে গুনাহ থেকে পবিত্র হওয়ার উপায় অবলম্বন করা উচিত।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে অসুবিধায় ফেলতে চান না। বরং তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান ও তোমাদের প্রতি স্বীয় অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।’ (সুরা মায়েদা: ৬) তিনি আরও বলেন, ‘ঈমানদার ব্যক্তিবর্গের জন্য এখনো কি সেই সময় আসেনি যে, আল্লাহর স্মরণ ও সত্য অবতীর্ণ হওয়ার ফলে তাদের হূদয় বিগলিত হয়ে উঠবে?’ (সুরা আল-হাদীদ: ১৬)
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ