ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের অন্তিম উপদেশ

প্রকাশনার সময়: ০৬ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | আপডেট: ০৬ মার্চ ২০২৪, ১২:৩৪

ওমর ইবনু আব্দুল আজিজ (৬১-১০১ হি.) ছিলেন উমাইয়া খেলাফতের স্বনামধন্য খলিফা, এমনকি ইসলামের ৫ম খলিফাও বলা হয় তাকে। তার জীবন ছিল পরহেজগারিতা, দুনিয়াবিমুখতা ও অল্পে তুষ্টির আলোয় উদ্ভাসিত। তার জীবনের ভাঁজে ভাঁজে উপদেশের খোরাক রয়েছে জান্নাতপিয়াসী মুমিনের জন্য। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

তার মৃত্যুকালীন একটি ঘটনা খুবই শিক্ষণীয়। মৃত্যুশয্যায় থাকা অবস্থায় একবার তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন প্রখ্যাত উমাইয়া সেনাপতি ও রাজপুত্র মাসলামা ইবনে আব্দুল মালেক। কথার একপর্যায়ে তিনি বললেন, ‘হে আমীরুল মু'মিনীন! আপনি সর্বদা আপনার সন্তানদের সম্পদ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। তারা একেবারেই নিঃস্ব। যদি আমাকে অথবা আপনার পরিবারের যাকে উত্তম মনে করেন, তাকে আপনার সন্তানদের জন্য অভিভাবক মনোনীত করে যান, তাহলে খুবই ভালো হতো।

তার কথা শেষ হলে ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রহ.) বললেন, ‘আমাকে ধরে বসাও’। তাকে ধরে বসানো হলে তিনি বললেন, ‘মাসলামা! আমি তোমার কথা শুনলাম। প্রথম যে কথাটি বলেছ যে, আমি আমার সন্তানদের সম্পত্তি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি। আল্লাহর কসম! তাদের যে অধিকার রয়েছে, তা থেকে আমি কখনোই তাদের বঞ্চিত করিনি। তবে হ্যাঁ, যেখানে তাদের কোনো হক নেই, এর ধারে কাছেও তাদের ঘেঁষতে দেইনি। আর তোমার দ্বিতীয় কথা— ‘তাদের জন্য আমাকে অথবা...’। তাদের জন্য আমি যাকে অভিভাবক মনোনীত করে রেখেছি, তিনি হচ্ছেন সেই মহান আল্লাহ, যিনি সত্য কিতাব নাজিল করেছেন এবং সৎকর্মশীল বান্দাদের হেফাজতও করেন। আর তাদের বিশেষভাবে সাহায্য করে থাকেন।

মনে রেখ হে মাসলামা! আমার ছেলেরা হয়তো নেককার পরহেজগার হবে, যাদের আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে ধনী করে দিতে পারেন, যে কোনো সমস্যা থেকে বের হওয়ার পথ দেখাতে পারেন। অথবা তারা হতে পারে পাপাচারে নিমজ্জিত অসৎ বদকার। এদের অঢেল অর্থের জোগান দিয়ে আল্লাহর নাফরমানি ও অবাধ্যতায় আমি সহযোগী হতে চাইনি।

এরপর বললেন, ‘আমার ছেলেদের আমার কাছে ডেকে পাঠাও!’ সবাইকে ডেকে আনা হলো। তারা ছিল ১৩ জন। যখন তিনি তাদের (ছেলেদের) দেখতে পেলেন, অঝোর ধারায় তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে লাগল। ছেলেদের বললেন, ‘বাবারা! আমি তোমাদের একেবারে নিঃস্ব অবস্থায় রেখে যাচ্ছি..’। আবার তিনি কান্নায় নীরব হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তাদের দিকে তাকালেন। সবটুকু ভালোবাসা কণ্ঠে ঢেলে দিয়ে বললেন, ‘আমার বাবারা! ধন-দৌলতের বিচারে নিঃস্ব অবস্থায় রেখে গেলেও মান-মর্যাদার বিচারে আমি তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি প্রচুর মূল্যবান সম্পদ। এ বিশাল ইসলামি সাম্রাজ্যের যে জনপদেই তোমরা যাবে, মুসলিম-অমুসলিম, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সম্মান করবে তোমাদের।

আমার প্রাণাধিক পুত্ররা! তোমাদের সামনে দুটো পথ খোলা থাকবে; অন্যায় পথে লব্ধ সম্পদে হয়তো তোমরা ধনী হবে, ফলশ্রুতিতে তোমাদের পিতাকে যেতে হবে জাহান্নামে। অথবা আল্লাহর হুকুমে অবিচল থেকে দরিদ্রতা স্বীকার করে জীবনের পথে চলতে থাকবে। পুরস্কার হিসাবে তোমরা পাবে জান্নাত। আমি নিশ্চিত যে, এটাই হবে যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তানদের প্রকৃত পুরস্কার। এটাই হবে জাহান্নাম থেকে মুক্তির সনদপত্র’।

এরপর তাদের দিকে স্নেহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘এবার তোমরা যাও, আল্লাহ তোমাদের হেফাজত করুন। আল্লাহ তোমাদের সব অভাব মোচন করুন’। পিতার বুকভরা দোয়া নিয়ে সন্তানরা সেখান থেকে চলে গেল।

এবার মাসলামা কাছে এসে বললেন, ‘হে আমীরুল মুমিনীন! আমার কাছে ওদের জন্য আরো উত্তম প্রস্তাব আছে’।

—‘কী সেটা?’

—‘আমার কাছে তিন লাখ দিনার আছে। সেগুলো আপনাকে দিচ্ছি, আপনি ওদের মাঝে ভাগ করে দিন অথবা আপনার ইচ্ছামতো অন্য কোথাও দান করুন’।

ওমর ইবনু আব্দুল আজিজ বললেন, ‘আমি কী এর চেয়েও উত্তম প্রস্তাব দেব তোমাকে?’

—কী সেটা আমীরুল মুমিনীন!

—এগুলো সেখানে ফিরিয়ে দেবে যেখান থেকে নেওয়া হয়েছে। ওগুলোর ওপর তোমার কোনো হক নেই।

অনুশোচনায় ভিজে গেল মাসলামার দু’চোখ। বললেন, ‘আমীরুল মুমিনীন! ইহকাল ও পরকালে আল্লাহ আপনার ওপর রহমত বর্ষণ করুন। আমার পাথরসম হৃদয়কে আপনি কোমল করে দিয়েছেন। বিস্মৃতির আড়ালে চাপা পড়া কথা এনে দিয়েছেন স্মরণের সদর দুয়ারে। নেক মানুষের অন্তরে আমাদের স্মরণকে স্থায়ী করে দিয়েছেন’।

ওমর ইবনু আব্দুল আজিজ (রহ.)-এর মৃত্যুর পরে মাসলামা তার সন্তানদের খবরাখবর ও অবস্থার প্রতি বিশেষ নজর রাখেন। কিন্তু তাদের কাউকেই অভাবী, অসচ্ছল কিংবা নিঃস্ব পাওয়া যায়নি।

(ড. আব্দুর রহমান রাফাত পাশা, ছুয়ারুম মিন হায়াতিত তাবেঈন (কায়রো : দারুল আদাবিল ইসলামি, দ্বাদশ সংস্করণ, ১৯৯৭ খ্রি.) পৃ. ২৬১-২৬৪)।

শিক্ষা:

  • নেককার সন্তান গড়ে তোলার জন্য পিতামাতাকে আগে নেককার হওয়া জরুরি। কেননা পিতামাতার কাছেই সন্তান আদর্শ শেখে।

  • পিতামাতার গাফলতিতে সন্তান বিপথগামী হলে তার দায়ভার পিতামাতাকেও নিতে হবে।

  • যে পিতা সন্তানকে নেককার করে গড়ে তোলেন, মৃত্যুর সময় কোনো সম্পদ রেখে যেতে না পারলেও, তিনি সফল পিতা হিসাবে গণ্য হবেন। পক্ষান্তরে সন্তানদের যদি দীনের পথে গড়ে তোলা না হয়, তাহলে তাদের জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি সম্পদ রেখে গেলেও সেই পিতা ব্যর্থ পিতা হিসাবে বিবেচ্য হন।

  • সন্তানের জন্য পিতামাতার দোয়া অব্যর্থভাবে কার্যকর হয়। ঠিক তেমনি তাদের বদদোয়াও বাস্তবায়িত হয়।

  • সন্তানের জন্য সম্পদের পাহাড় গড়া সফলতা নয়; বরং তাদের দীনের শিক্ষা দেওয়াই সবচেয়ে বড় সফলতা।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ