পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এটি প্রাণীর জীবন রক্ষাকবচ। পরিবেশ সংরক্ষণে ইসলামের নির্দেশনা রয়েছে। মানুষের কল্যাণ ইসলামের মূল লক্ষ্য। ফলে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটে এমন সব কাজ থেকে মানুষকে দূরে রাখতে ইসলাম সদা তৎপর থাকে। পর্যাপ্ত বনায়ন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মহান আল্লাহ মানবজাতির জন্য ভূপৃষ্ঠের সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। বৃক্ষরাজি তার অন্যতম সৃষ্টিজীব। পৃথিবীর প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ হিসেবে ফলবান বৃক্ষরাজি ও সবুজ-শ্যামল বনভূমির দ্বারা একে সুশোভিত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছেন। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালায় পরিবেশ ও প্রকৃতির ভারসাম্য সংরক্ষণ করা হয়েছে।
এ মর্মে কোরআনে এসেছে, ‘আমি বিস্তৃত করেছি ভূমিকে এবং তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং তাতে উদ্গত করেছি নয়নাভিরাম সব ধরনের উদ্ভিদ। আকাশ থেকে আমি বর্ষণ করি কল্যাণকর বৃষ্টি এবং এর দ্বারা আমি সৃষ্টি করি উদ্যান ও পরিপক্ব শস্যরাজি এবং সমুন্নত খেজুর গাছ, যাতে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ খেজুর। আমার বান্দাদের জীবিকাস্বরূপ। (সুরা কাফ: ৭-১১)।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বনভূমিতে গাছ লাগানো, পরিচর্যা ও সংরক্ষণকে বলা হয় বনায়ন। পরিবেশ বলতে কোনো ব্যবস্থার ওপর কার্যকর বাহ্যিক প্রভাবকগুলোর সমষ্টিকে বোঝায়। পরিবেশ বিভিন্ন কারণে দূষিত হতে পারে। প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট কারণও এর জন্য কম দায়ী নয়। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতির দান বৃক্ষরাজির অবদান অনস্বীকার্য। কেননা গাছ থেকে প্রাপ্ত অক্সিজেন গ্রহণ করে মানুষ বেঁচে থাকে।
প্রাণিকুল বিপন্ন হয়ে যেতে পারে যদি গাছ না থাকে। বনায়ন বর্তমান বিশ্বের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার একমাত্র হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাই সুস্থ-সুন্দর জীবনের জন্য সবুজ পৃথিবী রক্ষার্থে গাছ লাগানোর মাধ্যমে বনায়ন ছাড়া বিকল্প কোনো পথ আমাদের সামনে উন্মুক্ত নেই।
গাছ ও পরিবেশের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। বন বজ্রপাত প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। বৃক্ষ বায়ুমণ্ডকে বিশুদ্ধ ও শীতল রাখতে সাহায্য করে। যেখানে গাছপালা ও বনভূমি বেশি, সেখানে ভালো বৃষ্টিপাত হয়। ফলে ভূমিতে পানির পরিমাণ বাড়ে, চাষাবাদ ও ফল-ফসল ভালো হয়। তাছাড়া গাছপালা মাটির উর্বরতা বাড়ায়, ভূমির ক্ষয়রোধ করে। ঝড়বৃষ্টি ও বন্যা প্রতিরোধে সহায়তা করে। আমরা কোনো কারণ ছাড়াই অথবা সামান্য কারণে বন উজাড় করি। অথচ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ, বৃক্ষরোপণ ও বনায়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করে রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো মুসলিম যদি বৃক্ষরোপণ করে, আর সেখান থেকে যদি কোনো মানুষ বা পাখি কিংবা কোনো জীবজন্তু কিছু ভক্ষণ করে তাহলে ওই ব্যক্তি সদকার সওয়াব পাবে।’ (মুসলিম: ৩০০৩)। অন্যত্র এসেছে, ‘যদি কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার মুহূর্তেও তোমাদের কারও হাতে একটি চারাগাছ থাকে, তাহলে সে যেন সেই বিপদসংকুল মুহূর্তেও তা রোপণ করে দেয়।’ (বুখারি, আদাবুল মুফরাদ: ৪৭৯)।
গাছপালা মানুষের পরম বন্ধু। গাছ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ছাড়াও বিশুদ্ধ বাতাস সরবরাহ, জ্বালানি ও নানা ধরনের আসবাবপত্র তৈরিতে কাজে লাগে। এ ছাড়া বিভিন্ন ওষুধ তৈরিতে গাছ কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত হয়। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন রোগমুক্তিতে গাছের শিকড়, মূল, কাণ্ডের ব্যবহার দেখা যায়।
ফ্লুজনিত রোগের চিকিৎসায় গাছের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। হাদিসে এসেছে, উম্মু কায়েস বিনতে মিহসান (রা.) বলেন, আমি নবী (সা.) কে বলতে শুনেছি, তোমরা ভারতীয় কস্টাসের (উদুল হিন্দ) ব্যবহার আবশ্যক করে নাও। কেননা তার মাঝে সাত ধরনের শিফা রয়েছে। শ্বাসনালির ব্যথায় এটা নাক দিয়ে (ড্রপ হিসেবে) নেয়া যায়। নিউমোনিয়া দূর করার জন্যও তা সেবন করা যায়। (বুখারি: ৫৩৬৮)
পবিত্র কোরআনে খেজুর গাছ, লাউ গাছ, আনার গাছ, জলপাই গাছ, কুল গাছ ও অনেক কাঁটাবিশিষ্ট জাক্কুম সম্পর্কে আলোচনা স্থান পেয়েছে। পরিবেশের ওপর গাছের প্রভাব থাকায় রাসুল (সা.) গাছ কর্তন করতে নিষেধ করেছেন। কেননা মানুষ ছাড়াও অনেক প্রাণী গাছ থেকে উপকৃত হয়। বিনা প্রয়োজনে গাছ কর্তন করাকে রাসুল (সা.) নিরুৎসাহিত করেছেন। শুধু তাই নয়, যুদ্ধের ময়দানেও অমুসলিম শত্রুদের গাছ কর্তন করতে নিষেধ করেছেন।
মুতার যুদ্ধে সেনাপতিকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘তোমরা কোনো খেজুর বৃক্ষ জ্বালিয়ে দেবে না এবং কোনো বৃক্ষ কর্তন করবে না।’ অপর এক হাদিসে এসেছে, তিনি এমন ঘৃণিত কর্ম সম্পাদনকারী সম্পর্কে বলেন, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে কাঁটাযুক্ত কোনো বৃক্ষ কর্তন করবে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।’ (আবু দাউদ: ৪৬২৬)।
আমাদের দেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ। সুতরাং এ দেশের পরিবেশগত বিপর্যয় ঠেকাতে প্রয়োজন ব্যাপক বনাঞ্চল। দেশের প্রায় সর্বত্র বনভূমি জবরদখলের খবর পত্রপত্রিকায় চোখে পড়ে। এসবের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব জলাভূমি সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যসহ যে কোনো বনভূমি শুধু রক্ষণাবেক্ষণ নয়, সম্প্রসারণও করতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক ও কৃষি বনায়ন কর্মসূচি জোরদার করতে হবে।
মহাবিপর্যয় ও দুর্যোগ থেকে পরিবেশ রক্ষার একমাত্র উপায় পর্যাপ্ত বনাঞ্চল সৃষ্টি করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য অক্ষুণ্ন রাখা। সর্বোপরি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি বাসযোগ্য, সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে গাছ নিধন নয়, সৃজনই হোক সবার লক্ষ্য। অন্যথায়, পরিবেশের ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। এ লক্ষ্যে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের দেশে মসজিদ মাদ্রাসা, ধর্মীয় মাহফিল অনুষ্ঠান ধর্মীয় কাজ এবং সওয়াবের উপলক্ষ্য হিসেবে মনে করা হয়। কিন্তু গাছের পরিচর্যার মাধ্যমে যে সওয়াব অর্জন করা যায় সেই ধারণা ও চেতনা জাগ্রত করতে পারলে আমরা সামগ্রিকভাবে উপকৃত হব।
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ