অধিক লাভের আশায় পণ্য মজুত রাখার প্রবণতা বর্তমান বিশ্বের পুঁজিবাদী দেশগুলোতে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ এটাকে কোনো অপরাধই মনে করছে না। অথচ এর ফলে খাদ্যের চরম সংকট তৈরি হয়। পণ্যের মূল্য হুট করে বেড়ে যায়। জনসাধারণের দুঃখ-কষ্টের সীমা থাকে না। একচেটিয়া কারবারের উদ্দেশ্যই হচ্ছে চড়া মূল্যের লোভে পণ্য স্টক বা মজুত করে রাখা।
দেখা যায়, এক শ্রেণির ব্যবসায়ী মৌসুমের শুরুতেই চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুনসহ নানা রকম শস্য ও ফলফলাদি বিপুল পরিমাণে গুদামজাত করে রাখে। ফলে বাজারে সৃষ্টি হয় কৃত্রিম সংকট। দাম বহুগুণে দ্রুত বেড়ে যায়। আর এ সুযোগে মজুতদাররা সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে। একইভাবে শিল্পজাত পণ্যেও মজুতদারি চলে।
ডিম, তেল, চিনি, গুড়, কসমেটিক, শিশুখাদ্য, সার, বীজ, তুলা, সুতা ইত্যাদি এমন কোনো বস্তু নেই ব্যবসায়ীরা যা মজুত করে না। এর পরিমাণ এত বেশি যে বাজারে কৃত্রিম সংকট দেখা দেয়াটাই স্বাভাবিক। ফলে অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি হয়। সাধারণ মানুষ তখন অসাধু ব্যবসায়ীদের কৃপার পাত্র হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে রমজানের পণ্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনে একটি বড় কারণ এটিও যে, চড়া মূল্যের লোভে অসাধু ব্যবসায়ীরা মজুত রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে।
রাসুল (সা.) চড়া মূল্যের লোভে জিনিসপত্র, ভোগ্যপণ্য ইত্যাদি গুদামজাত করে রাখতে নিষেধ করে বলেন, ‘যে (চড়া মূল্যের লোভে খাদ্য ইত্যাদি) মজুত করে রাখে সে অপরাধী।’ (মুসলিম: ১৬০৫)
রাসুলে কারিম (সা.) পণ্য মজুত করাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করে বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইহতিকার করবে অর্থাৎ, অতিরিক্ত দামের আশায় ৪০ দিন ধরে খাদ্যদ্রব্য বিক্রয় না করে আটক রাখবে আল্লাহর সঙ্গে তার ও তার সঙ্গে আল্লাহর সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে।’ (মুসনাদে আহমাদ: ৪৮৮০)
অপর হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমদানিকারী (পণ্য সরবরাহকারী) ব্যবসায়ী রিজিকপ্রাপ্ত হয় এবং মজুতদার অভিশপ্ত।’ (ইবনে মাজাহ: ২১৫৩)
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের বিরুদ্ধে (বা সমাজে) খাদ্যদ্রব্য মজুতদারি করে আল্লাহ তাকে কুষ্ঠরোগ ও দারিদ্র্যতার কষাঘাতে শাস্তি দেবেন।’ (ইবনে মাজাহ: ২১৫৫)
মানুষের খাদ্য, কাপড়-চোপড় ও আসবাবপত্রসহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র স্টক করে রাখার পরিণাম বিবেকবানদের নিকট অস্পষ্ট নয়, যা গুটিকয়েক স্বার্থান্বেষী ছাড়া ব্যাপকহারে কল-কারখানা, মেল-ফ্যাক্টরি, ব্যবসায়ী, কর্মজীবী, পেশাজীবী ও দিনমজুরসহ সকলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটা স্পষ্ট জুলুম! এ কাজ থেকে সৃষ্টি হয় মুনাফাখোরী মানসিকতা, ব্যবসায়িক অসাধুতা। জন্ম নেয় নৈতিকতাবিরোধী মনোবৃত্তি। এজন্যই আজ দেশে দেশে কালোবাজারি ও চোরাকারবারি বেড়ে গেছে। মানবসেবা কিংবা জনস্বার্থ ব্যবসায়ীদের কাছে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। যেভাবেই হোক না কেন, অধিক থেকে অধিকতর মুনাফা অর্জন করে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধিই এদের একমাত্র লক্ষ্য। মানবিকতা ও নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে তারা বৈষয়িক উন্নতির পথ বেছে নিয়েছে। প্রতিটি ব্যবসায়ীকে এ কথা মনে রাখতে হবে ব্যবসায় নীতি ও সততা রক্ষা করে চলা প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব। একদিন আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। প্রতিটি দায়িত্ব সম্পর্কে আল্লাহর দরবারে জবাবদিহিতা করতে হবে।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা সকলেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই অধীনস্থদের (দায়িত্ব) জিজ্ঞাসা করা হবে। ইমাম একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি, তাকে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। পুরুষ তার পরিবারবর্গের অভিভাবক, তাকে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। নারী তার স্বামী-গৃহের কর্ত্রী, তাকে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। খাদিম তার মনিবের ধন-সম্পদের রক্ষক, তাকেও তার মনিবের ধন-সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।’
ইবনু উমর (রা.) বলেন, ‘আমার মনে হয়, রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, পুত্র তার পিতার ধন-সম্পদের রক্ষক এবং এগুলো সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করা হবে। তোমরা সবাই দায়িত্বশীল এবং সবাইকে তাদের অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।’ (বুখারি: ৮৯৩)
ব্যবসাও একটি দায়িত্ব ও জিম্মাদারি এবং জনগণের পক্ষ থেকে আমানতদারি। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালার নিকট এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে। দুনিয়ার জীবনে অবৈধ পন্থায় উপার্জন করে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করলেও পরকালীন জীবনে রয়েছে এর জন্য জবাবদিহিতা ও সুবিচার।
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিবসে বান্দার দুই পা জায়গা থেকে এক চুলও সরবে না, যতক্ষণ না তাকে প্রশ্ন করা হবে তার জীবনকাল সম্পর্কে, কোথায় সে তা ব্যয় করেছে; তার ইলম-জ্ঞান সম্পর্কে, সে অনুযায়ী কী করেছে; তার সম্পদ সম্পর্কে, কীভাবে সে তা উপার্জন করেছে এবং কোথায় ব্যয় করেছে এবং তার দেহ সম্পর্কে, কীভাবে সে তা ক্ষয় করেছে।’ (জামে তিরমিজি: ২৪১৭)
তাই আসুন, আমরা সততা ও আমানতদারিতার সঙ্গে ব্যবসা করি, তাহলে দুনিয়ায় জীবনেও লাভবান হবো পরকালেও সফলতা লাভ করব। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী (কিয়ামতের দিন) সত্যবাদী ও শহিদদের সঙ্গে থাকবেন।’ (তিরমিজি: ১২০৯)
এ ছাড়া আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘এরা এমন লোক (মুমিন ব্যবসায়ী) যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ (জিকির) থেকে সালাত কায়েম করা থেকে এবং জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না। তারা ভয় করেন সেই দিনকে, যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিগুলো উল্টে যাবে। (তারা আল্লাহর পবিত্রতার ঘোষণা করে,) যাতে আল্লাহ তাদের উৎকৃষ্ট কর্মের প্রতিদান দেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরও অধিক দেন। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিজিক দান করেন।’ (সুরা নূর: ৩৭-৩৮)
লেখক: শিক্ষক, আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, মদিনাতুল উলূম মাহমূদিয়া, নারায়ণগঞ্জ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ