ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারি ২০২৫, ২৫ পৌষ ১৪৩১, ৮ রজব ১৪৪৬

ভালোবাসা হোক আল্লাহর জন্য

প্রকাশনার সময়: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:২৪

পশ্চিমা দুনিয়ার মতো সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশেও তথাকথিত বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বিশেষভাবে উদযাপন করা হচ্ছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভালোবাসা দিবসের ইতিহাস প্রাচীন রোমে ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল রোমান দেব-দেবীর রানী জুনোর সম্মানে ছুটির দিন। জুনোকে নারী ও প্রেমের দেবী বলে লোকে বিশ্বাস করত। কারও কারও মতে, ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস হওয়ার কারণ ছিল এটিই। আবার কেউ বলেন, রোমের সম্রাট ক্লডিয়াস ২০০ খ্রিস্টাব্দে দেশে বিয়ে প্রথা নিষিদ্ধ করেন। তিনি ঘোষণা দেন, আজ থেকে কোনো যুবক বিয়ে করতে পারবে না। যুবকদের জন্য শুধুই যুদ্ধ। তার মতে, যুবকরা যদি বিয়ে করে তবে যুদ্ধ করবে কারা?

সম্রাট ক্লডিয়াসের এ অন্যায় ঘোষণার প্রতিবাদ করেন এক যুবক। যার নাম ভ্যালেন্টাইন। অসীম সাহসী এ যুবকের প্রতিবাদে খেপে উঠেছিলেন সম্রাট। রাজদ্রোহের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় তাকে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা মাথা কেটে ফেলা হয় তার। ভালোবাসার জন্য ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগকে স্মরণ করতে তখন থেকেই এ দিনটিকে পালন করা হয় ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে। তবে এটিও সর্বজন স্বীকৃত নয়। এখানেও দ্বিমত আছে। আছে আরও অনেক ঘটনা। (উইকিপিডিয়া)

বাংলাদেশে এই প্রথা চালুর জনক কে? যায়যায়দিন পত্রিকার সম্পাদক শফিক রেহমান ১৯৮০ সালে তৎকালীন লন্ডনে পড়া অবস্থায় এই কৃষ্টি-সংস্কৃতি বুকে ধারণ করে এনে ১৯৯৩ সালে নিজ পত্রিকার মাধ্যমে আমাদের এই সোনার বাংলাদেশে অপসংস্কৃতি ছড়িয়ে দেন। (উইকিপিডিয়া)

ভালোবাসা একটা ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। এর বিভিন্ন অর্থ আছে। ভালোবাসা কেবল নারীর রূপ-লাবণ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে কামভাব চরিতার্থ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ভালোবাসাকে অস্বীকার করার উপায় পৃথিবীতে কারও নেই। এটা মানুষের স্বভাবগত চাহিদা। এ ভালোবাসা শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং সৃষ্টির সূচনা লগ্নে আল্লাহতায়ালা সমস্ত মাখলুকের স্বভাবে ভালোবাসা রেখে দিয়েছেন। তবে মানুষের মধ্যে আর প্রাণীর মধ্যে ব্যবধান হলো, জীবজন্তুর ভালোবাসার কোনো নিয়ম নেই। পক্ষান্তরে মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষের একটা নিয়মনীতি রয়েছে। একটা বিধান রয়েছে। আর ইসলাম চায় মানুষ তার সেই বিধান বা নিয়মনীতি মেনে চলুক।

ইসলাম ভালোবাসাকে সমর্থন করে। তবে সেই ভালোবাসাকে সমর্থন করে যেই ভালোবাসা ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ। যেই ভালোবাসার মাধ্যমে মানুষ পাবে সাওয়াব, পাবে জান্নাত। সেই ভালোবাসাকে ইসলাম সমর্থন করে না, যেই ভালোবাসা একটা মানুষকে বেহায়াপনার কারণে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। যেমন সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতার প্রতি ভালোবাসা। কোনো সন্তান যদি ভালোবাসা দৃষ্টিতে পিতা-মাতার প্রতি একবার তাকায়, তাহলে আল্লাহতায়ালা তাকে একটি কবুল হজের পরিমাণ সাওয়াব দান করে।

আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) সূত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো নেককার সন্তান যখন স্বীয় মা-বাবার প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকায় তখন আল্লাহতায়ালা প্রতিটি দৃষ্টির বিনিময়ে তার আমলনামায় একটি মকবুল হজ লিপিবদ্ধ করেন। সাহাবিগণ বললেন, যদি সে দৈনিক একশবার এভাবে তাকায়? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হ্যাঁ! (প্রত্যেক দৃষ্টির বিনিময়ে সে এই সাওয়াব পেতে থাকবে) আল্লাহ অতি মহান, অতি পবিত্র তাঁর কোনো অভাব নেই।’ (মিশকাত)

আবার কেউ যখন তার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকায় বা ভালোবাসার সঙ্গে তাকে এক লোকমা খাবার খাইয়ে দেয় সে ক্ষেত্রেও তার জন্য রয়েছে সাওয়াব। নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা তাদের স্ত্রীদের জন্য উত্তম। আর আমি আমার স্ত্রীদের জন্য তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি।’ (তিরমিজি) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আমার কাছ থেকে মহিলাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহারের অছিয়ত গ্রহণ কর।’

সুতরাং এই হাদিসদ্বয় থেকে বোঝা যায়, আদেশ পালনের উদ্দেশ্য কেউ যখন স্ত্রীকে ভালোবাসে তখন তা আর দুনিয়া থাকে না; বরং সরাসরি দ্বীন হয়ে যায়। আর দ্বীনের কাজ করলেই সাওয়াব পাওয়া যায় এবং এই সাওয়াব আপনাকে জান্নাতে নিয়ে যায়। সুবহানাল্লাহ। পক্ষান্তরে অবৈধ ভালোবাসা, তা শুধুই শয়তানি ধোঁকা। এই শয়তানি ধোঁকায় পরে আপনি হার-হামেশা লিপ্ত থাকেন গুনাহে। যেমন কোনো বেগানা মহিলার দিকে যদি কেউ ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকায় তাহলে তার জন্য রয়েছে গুনাহ। আর এই গুনাহ তাকে জিনা বা ব্যভিচারের দিকে নিয়ে যায়। তারপর এই ব্যভিচার আপনাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মুমিনদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গ হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা রয়েছে। নিশ্চয়ই তারা যা করেন আল্লাহ তা অবহিত আছে...।’ (সুরা নূর : ৩০)

অপর এক আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মতো নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পরপুরুষের সঙ্গে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বল না, ফলে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করবে যার অন্তরে ব্যাধি আছে। তোমরা সংগত কথাবার্তা বলবে।’ সুরা আহযাব : ৩২)

এসব আয়াতের ধারা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়, যুবক-যুবতীরা পরস্পর হাত ধরে অভিসারে বেরিয়ে যাওয়া প্রেম-ভালোবাসা নিবেদন করা তো দূরের কথা পরস্পরের প্রতি তাকানোই হারাম। সুতরাং প্রচলিত বিশ্ব ভালোবাসা দিবস নামে দেশের প্রতিটি জায়গায় বেহায়াপনা সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ছে। এই ভালোবাসার নামে দেশে ঘটে যাচ্ছে হাজারো ঘটনা। কেউ হয় ধর্ষণের শিকার, কেউবা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার মতো জঘন্য পথও বেঁচে নেয়। আবার অনেকে বিবাহে অবাধ্য হলেও এর অধিকাংশ বিবাহ টেকে না। বিভিন্ন পত্রিকার পাতায় চোখ আওড়ালে আমরা দেখতে পাই এই দিনকে কেন্দ্র করে দেশে হাজারো ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।

তথাকথিত এ ভালোবাসা দিবসের সঙ্গে মুসলমানদের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা খ্রিস্টানদের উৎসবের দিন, না হয় পৌত্তলিকদের পূজার দিন, না হয় ধর্মহীনদের বেহায়াপনার দিন। তাই আমাদের তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে।

ভালোবাসা হতে হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল, বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী, শিক্ষক, ইসলামের ধারক-বাহক ও আলিম-উলামার সঙ্গে। ভালোবাসা হতে হবে গরিব-অসহায় মানুষের সঙ্গে। এলাকাবাসীর সঙ্গে। দেশ ও দেশবাসীর সঙ্গে। গোটা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর সঙ্গে। এতে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে। জান্নাত পাওয়া যাবে। এর বাইরে নিষিদ্ধ ভালোবাসার অবৈধ ব্যবহার করলে, তাতে জাহান্নাম পাওয়া যাবে।

সুতরাং আসুন, এমন ঘৃণিত অপসংস্কৃতিকে ‘না’ বলি এবং যাবতীয় নোংরামি ও কদার্যপনা থেকে দূরে থাকি। আল্লাহতায়ালা আমাদের সঠিক বুঝে, সঠিকভাবে আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামি’আ ইসলামিয়া আরাবিয়া সাভার, ঢাকা।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ