ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

হূদয় আলোকিত হয় তাসাউফ চর্চায়

প্রকাশনার সময়: ২১ ডিসেম্বর ২০২৩, ২০:৫৮

তাসাউফ আরবি শব্দ। আভিধানিক অর্থ সুফিবাদ, আধ্যাত্মিকতা আধ্যাত্মবাদ। মুসলিম দর্শনে তাসাউফ সুফিবাদ নামে খ্যাত। বিশেষজ্ঞদের মতে সুফি শব্দটি সুফ শব্দ থেকে উৎপন্ন যার অর্থ পশম। পশমি বস্ত্র সরলতা ও আড়ম্বরতাহীনতার প্রতীক। রাসুল (সা.) ও তার সাহাবায়ে কেরাম বিলাসিতার পরিবর্তে সাদাসিধে পোশাক পরিধান করতেন। তাই সাদাসিধে জীপনযাপনকারী ব্যক্তিরা মুসলিম দর্শনে সুফি নামে অভিহিত।

ইসলামের প্রাজ্ঞ বুজুর্গরা বিভিন্নভাবে তাসাউফের (সুফিতত্ত্বের) সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। শায়খ আবু বকর শিবলি (রহ.) তাসাউফের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, ‘এর প্রারম্ভে রয়েছে খোদা তায়ালার ভেদের রহস্য (মা’রেফত) এবং শেষে রয়েছে তার একত্ব (তাওহিদ)।’ জুনাইদ বাগদাদি (রহ.) বলেন, ‘নিজ সত্তাতে মৃত কিন্তু খোদা তায়ালার মাঝে জীবিত।’ ‘সুফিবাদ শিক্ষা দেয় নিজ সত্তার পরিশুদ্ধি, নৈতিকতার উন্নতি এবং নিজ অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক জীবনকে গড়ে তোলা, যাতে করে চিরস্থায়ী আশীর্বাদ লাভ করা যায়। এর সারবস্তু হলো আত্মিক পরিশুদ্ধি এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো চিরস্থায়ী কল্যাণ ও আশীর্বাদ লাভ।’

এ তিনটি সংজ্ঞা- যার প্রথমটি আকল তথা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত, দ্বিতীয়টি হাল তথা ভাব বা আধ্যাত্মিক অবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং তৃতীয়টি আখলাক তথা নৈতিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

তাসাউফের উৎসসমূহ

তাসাউফ ইসলাম ধর্মবহির্ভূত উৎস থেকে আবির্ভূত হয়েছে- এটা দেখাতে পূর্ববর্তী প্রাচ্যদেশ-সম্পর্কিত গবেষণাগুলো যথেষ্ট কষ্ট স্বীকার করেছিল। এসব গবেষণা অনুযায়ী, ‘ইসলাম ধর্ম আরবের শুকনো পতিত জমি থেকে এসেছিল, আর তাই তাতে কখনই এত গভীর ও অনুপ্রেরণাদায়ক জ্ঞানের বীজ অন্তর্নিহিত থাকতে পারে না; সুফিদের আশীর্বাদপুষ্ট অন্তর্দৃষ্টির শেকড় কোনক্রমেই মরুভূমিতে প্রোথিত হতে পারে না।’

এই একপেশে নীতির কারণে অনেক পশ্চিমা গবেষক কোরআনে এবং মহানবী (সা.)-এর হাদিসে নিহিত অন্তর্দৃষ্টি ও দিব্যজ্ঞান সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারেননি। তবে সুফিবাদ সংক্রান্ত কোরআনি উৎসগুলো সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। সুফিবৃন্দ তাদের অবস্থানের পক্ষে আল কোরআনের যে দলিলাদি পেশ করেন, তার মধ্যে সুরা ওয়াকিয়াহর আয়াতে কারিমাগুলো প্রণিধানযোগ্য। এসব আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মানুষদেরকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। ১. আসহাব আল মাশআমাহ্ তথা বাম হাতের দিকের মানুষ; ২. আসহাব আল মায়মানাহ তথা ডান হাতের দিকের মানুষ; ৩. মুকাররাবুন তথা সেই সব বুজুর্গ যারা আল্লাহর নিকটবর্তী; এদেরকে ‘অগ্রবর্তী’ও বলা হয়েছে।

প্রথম দলটি ঈমান গ্রহণ করেনি। দ্বিতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত হলেন নেককার মুসলমানরা যারা আল্লাহর প্রতি তাদের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট। তাদের সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে— ‘পূর্ববর্তীদের মধ্য থেকে এক দল এবং পরবর্তীদের মধ্য থেকে এক দল।’ (সুরা ওয়াকিয়া: ৩৯-৪০) আর সর্বোপরি রয়েছেন মুকাররাবুন। তারা হলেন মুমিন বান্দাদের মধ্যে এমনি একটি বিশেষ দল, যারা আধ্যাত্মিক উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে উপনীত হয়েছেন। তাদেরকে বেশিরভাগ সময় খাওয়াস আল খাসওয়াস তথা মনোনীতদের মাঝে মনোনীত বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। এদের ঈমানের প্রাচুর্যই এদেরকে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্যের মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।

সুরা ওয়াকিয়াতে এই বুজুর্গদের সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে: ‘পূর্ববর্তীদের মধ্য থেকে এক দল এবং পরবর্তীদের মধ্য থেকে এক দল।’ (সুরা ওয়াকিয়া: ৩৯-৪০) আর সর্বোপরি রয়েছেন মুকাররাবুন। তারা হলেন মুমিন বান্দাদের মধ্যে এমনি একটি বিশেষ দল, যারা আধ্যাত্মিক উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে উপনীত হয়েছেন। সুরা ওয়াকিয়াতে এই বুজুর্গদের সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে: ‘পূর্ববর্তীদের মধ্য থেকে এক দল; এবং পরবর্তীদের মধ্য থেকে স্বল্প সংখ্যক।’ (১৩-১৪ নং আয়াত) এই উচ্চ মার্গের ঈমান ও আধ্যাত্মিক উন্নতিই সুফিবৃন্দের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করে।

বিশ্বনবী (সা.)-এর বর্ণিত একটি হাদিসে কুদসিতেও আল্লাহ তায়ালার নৈকট্যের বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমার বান্দা নফল (তরিকার রেয়াযত) ইবাদত-বন্দেগি দ্বারা আমার এত নিকটবর্তী হন যে আমি তাকে ভালোবাসি; এত ভালোবাসি যে আমি তার কান হই যা দ্বারা তিনি শোনেন; তার চোখ হই যা দ্বারা তিনি দেখেন; আমি তার হাত হই যা দ্বারা তিনি কাজকর্ম করেন এবং তার পা হই যা দ্বারা তিনি চলাফেরা করেন।’ (বুখারি)

আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য ও তার ভালোবাসার সঙ্গে যখন তার সৌন্দর্যের বিষয়টি যুক্ত হয়, যেমনিভাবে হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে— ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা নিজে সুন্দর এবং সুন্দরকেও ভালোবাসেন।’ (মুসলিম), তখন সুফি-দরবেশ রাবেয়া আদাউইয়্যার (রহ.) কথার মর্মও বোধগম্য হয়; তিনি বলেছিলেন— ‘হে আল্লাহ! আমি দোজখের ভয়ে আপনার ইবাদত করে থাকলে আপনি আমায় তাতে পুড়িয়ে খাক করে দিন; আর যদি বেহেশতের আশায় ইবাদত করে থাকি, তবে তা থেকে আমায় বঞ্চিত করে দিন; কিন্তু আপনার খাতিরে যদি আমি আপনার বন্দেগি করে থাকি, তাহলে আপনার চিরস্থায়ী সৌন্দর্য দর্শন থেকে আমায় বঞ্চিত করবেন না!’

এ আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষার আলোকেই আমরা সুফিবৃন্দের বিভিন্ন ভক্তিমূলক কর্মকাণ্ডের ঐকান্তিকতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো। পূর্ববর্তী যুগের সুফিবৃন্দের মধ্যে উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন হাসান বসরী (মৃ. ৭২৪ খ্রি.), ইবরাহিম ইবনে আদহাম (মৃ. ৭৭৭ খ্রি.), রাবেয়া আদাউইয়্যা (৮০১ খ্রি.), ফুযাইল ইবনে আয়াজ (৮০৩ খ্রি.), মারূফ কারখি (৮১৫ খ্রি.), আবু আব্দুল্লাহ মুহাসিবি (৮৫৭ খ্রি.), সিররী সাকাতি (৮৬৭ খ্রি.), বায়েজিদ বোস্তামি (৮৭৪ খ্রি.) এবং আবুল কাসেম জুনাইদ বাগদাদি (৯১০ খ্রি.)।

পীর ও মুরিদের সম্পর্কের মাঝে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল। প্রথমটি হলো ইলবাসুল খিরকা তথা জোড়াতালি দেয়া একটি জামা পরিধান, যা মুরিদের তরিকায় বা তাসাউফে দাখিল হওয়ার ইঙ্গিতবহ ছিল। দ্বিতীয় দিকটি তালকিনুয যিকর নামে জ্ঞাত, যার অর্থ হলো মুরিদ কী ধরনের যিকর পালন করবে সে সম্পর্কে পীরের নির্দেশ। তৃতীয় দিকটিকে সোহবত বলে, যা পীরের সান্নিধ্যের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য জ্ঞাপন করে।

এসব দিক প্রাথমিক যুগ থেকেই সুফি তরিকার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে চলে আসছে। বস্তুত এসব আচারের অধিকাংশই রাসুলে খোদা (সা.)-এর সুন্নাহতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধরনের যিকরসহ সুফিবৃন্দের শিক্ষাসমূহ পীরের কাছ থেকে মুরিদের কাছে ধারাবাহিক পরম্পরায় হস্তান্তরিত হয়ে আসছে; এটিকে সিলসিলা বলে। এসব সিলসিলার মাধ্যমে এবং এজাযত প্রথার দ্বারা সুফিবৃন্দের শিক্ষাসমূহ আমাদের আধ্যাত্মিকতার ঐতিহ্যগত অংশ হিসেবে সংরক্ষিত হয়েছে। এজাযত হলো পীরের শিক্ষাসমূহ (তরিকা)-কে আরও প্রসারিত করার জন্যে মুরিদ (খলিফা)-কে পীরের দেয়া অধিকার।

সুফিবাদ তিন ধারা বিশিষ্ট প্রক্রিয়া

১. শরিয়ত— এটির বিধান সম্পর্কে জানা এবং তা কঠোরভাবে মেনে চলা।

২. তরিকত— মহানবী (সা.) ও তাসাউফের বরেণ্য ও বিজ্ঞ বুজুর্গবৃন্দের নির্দেশিত আধ্যাত্মিক প্রথার (যেমন যিকর) অনুশীলন বা চর্চা।

৩. হাকিকত— সেই আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি বা দিব্যদৃষ্টি লাভ যার দর্শন হলো সকল বস্তুই আল্লাহ্ তায়ালা থেকে আগত এবং তারই মালিকানাধীন।

শরিয়ত ও তাসাউফ

ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক যুগে সুফি মতাদর্শ সম্পর্কে শরিয়তের কিছু আলেমের মনে বিভ্রান্তি দেখা দিলে সর্বজনমান্য ও স্বনামখ্যাত সুফি ও আলেমে দ্বীন ইমাম আবু হামিদ গাজালি (১০৫৭-১১১১ খ্রি.) তার লেখনীর মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা ফিরিয়ে আনেন। ইসলাম ধর্মের ফেকাহ্ (বিধানবিষয়ক শাস্ত্র) ও সুফি (আধ্যাত্মিকতা বিষয়ক দর্শন) ভাবধারার মধ্যে সুসমন্বয় সাধন তার অমূল্য ও সফল কীর্তি। দুটোর কোনোটিকে প্রত্যাখ্যান করলে ইসলাম ধর্ম হাস্যস্পদ বস্তুতে পরিণত হয়।

পরিশেষে আওলিয়াদের জীবন থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, তাসাউফ সত্য। সুতরাং আমাদের কর্তব্য তাসাউফকে ইনকার না করা এবং জীবনকে ইলমে মারিফাত তথা কুসংস্কার ও বিদআতমুক্ত তাসাউফের আলোতে আলোকিত করার চেষ্টা করা। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন। আমিন!

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ