ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিজয় ও মুক্তি রবের শ্রেষ্ঠ দান

প্রকাশনার সময়: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ২০:০১

স্বধীনতা মানব জীবনে মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। মহান আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন সত্তা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আর তার স্বাধীন বিচরণক্ষেত্র হিসেবে বিশাল-বিস্তৃত পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। পরাধীনতা মানব জীবনে সবচেয়ে বড় বঞ্চনার নাম। বাবা আদম (আ.) ও মা হাওয়ার আবাসভূমি ছিল পৃথিবীজুড়ে।

পৃথিবীর বিশাল বক্ষে তখন কোনো সীমানা চিহ্ন আঁকতে পারেনি কেউ। তারপর তাদের সন্তানরা পারস্পরিক স্বার্থপরতার পথ ধরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, সীমানা চিহ্ন দিয়ে বিভক্ত করে ফেলেছে নিজেদের আবাসভূমি। সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য স্বাধীন রাষ্ট্র। জন্ম নিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন স্বাধীন জাতি। আর যখনই কোনো জাতির এক অংশ অন্য অংশের দ্বারা নিজেদের স্বাধীন অধিকার খর্ব হতে দেখেছে, একে অন্যের দ্বারা শোষিত ও বঞ্চিত হয়েছে, তখনই শোষিত জনগোষ্ঠী শোষণকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে এবং নিজেদের মুক্ত করতে সংগ্রাম করেছে। একই ধারায় পশ্চিম পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে সাড়ে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়। স্বাধীন বাঙালি জাতির অভ্যুদয় হয়েছিল ১৯৭১ সালে।

বিজয় শব্দটি যদিও খুব ছোট, কিন্তু এর পেছনে লুকিয়ে থাকে বিশাল ইতিহাস। ত্যাগ-তিতিক্ষার, হাসি-কান্নার, আনন্দ-বেদনার এবং অর্জন-বর্জনের ইতিহাস। বিজয় দিবস শুধুই উদযাপনের নয়; তা হূদয় দিয়ে আত্মোপলব্ধি করার বিষয়। বিজয় দিবস উদযাপনে ইসলামেও বিরোধিতা নেই। বরং দেশের স্বাধীনতা অর্জন ও বিজয় উদযাপন উপলক্ষ্যে আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করা এবং তারই কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করাই ইসলামের নির্দেশ।

‘হুব্বুল ওয়াত্বানে মিনাল ঈমান অর্থাৎ দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।’ আর দেশকে ভালোবাসার সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা ও পরাধীনতা থেকে মুক্তি লাভ করে বিজয় অর্জন করা একই সুতোয় গাঁথা। মুক্তিযুদ্ধে যারা জানমাল বাজি রেখে স্বদেশের জন্য, মানুষের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে লিপ্ত ছিল- তাদের এ নৈতিক অধিকারকে ইসলাম সমর্থন করে সর্বতোভাবে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন স্বাধীনচেতা ব্যক্তিত্ব। তিনি মদিনাকে স্বাধীন করেছিলেন মুনাফিক চক্র এবং সুদখোর, চক্রান্তবাজ, ইহুদিদের কবল থেকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) যে কতটা স্বাধীনচেতা রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন তার পরিচয় মেলে পঞ্চম হিজরির শাওয়াল মাসে সংঘটিত খন্দকের যুদ্ধে। মদিনার ইহুদিদের প্ররোচনায় মক্কার কুরাইশরা যখন মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) ইসলামি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে অক্ষুণ্ন্ন রাখার স্বার্থে সালমান ফারসির (রা.) পরামর্শে মদিনার চারপাশে পরিখা খনন করেন। কুরাইশ বাহিনী পরিখা পার হয়ে মদিনায় আসতে না পেরে কিছুদিন অবরুদ্ধ থাকার পর ব্যর্থ মনে মক্কায় ফিরে যায়। সে সময় এটা ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী বিজয় ধরে রাখতে রাসুলুল্লাহর (সা.) একটি বিস্ময়কর পদক্ষেপ।

মানবতার ধর্ম ইসলামে দেশকে ভালোবাসার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনাদর্শ ও স্বভাব-চরিত্রে দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। তিনি নিজের মাতৃভূমি পবিত্র মক্কা নগরীকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাই স্বজাতি কর্তৃক নির্যাতিত, নিপীড়িত ও বিতাড়িত হয়ে জন্মভূমি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকালে বারবার মক্কার দিকে ফিরে তাকিয়ে কাতর কণ্ঠে আফসোস করে বলেছিলেন, ‘হে আমার স্বদেশ! আমাকে বাধ্য করা না হলে আমি তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’

সত্যিকারের দেশপ্রেম স্বদেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করে, স্বদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কর্মকৌশল উদ্ভাবনে আত্মনিয়োগ করার শিক্ষা দেয়। অতএব, আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি স্বাধীনতা ও এ বিজয়কে অর্থবহ করতে দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করা এবং সবার মাঝে দেশকে কিছু দেয়ার মানসিকতা তৈরি করা জরুরি।

সেই সঙ্গে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা দেশের জন্য আত্মত্যাগ করেছেন, সেসব শহিদের স্মরণ ও দোয়া করাও প্রয়োজন। তাদের স্মরণ ও দোয়া করতে হবে ইসলাম নির্দেশিত পন্থায়। যেমন কোরআনে কারিমের একটি সুরা হচ্ছে ‘আল ফাতহ’, যার অর্থ বিজয়। আরেকটি সুরার নাম ‘আন নাসর’, যার অর্থ মুক্তি ও সাহায্য। সুরা নাসরের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের বিজয় উৎসব করার নিয়ম বাতলে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য ও বিজয় আসবে, তখন মানুষদের তুমি দেখবে, তারা দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করছে। অতঃপর তুমি তোমার মালিকের প্রশংসা কর এবং তার কাছেই ক্ষমা প্রার্থনা কর; অবশ্যই তিনি তওবা কবুলকারী।’ (সুরা নাসর: ১-৩)

এ সুরায় আল্লাহ তায়ালা বিজয় অর্জনের পর দু’টি কাজ করতে বলেছেন। এক. বিজয় অর্জিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহান আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করে তার দরবারে শুকরিয়া জ্ঞাপন করা। দুই. আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। আসলে স্বাধীন হওয়ার চেয়ে বড় আনন্দ আর কিছু নেই।

এ কারণেই আল্লাহ নির্দেশ দিলেন, ‘তোমরা বিজয় লাভ করেছ, এখন তোমাদের কাজ হচ্ছে এ বিজয়ের জন্য আল্লাহর দরবারে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে কিংবা তাসবিহ পাঠ করে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। বিজয়ের দিনে যারা দেশের জন্য আত্মত্যাগ করেছেন, সেসব শহিদের জন্য দোয়া করা। সেই সঙ্গে তাদের শাহাদাত থেকে নতুন করে শপথ নেয়া, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকার, বাতিলের কাছে মাথা নত না করার এবং অন্যের কাছে নিজের স্বাধীনতা বিকিয়ে না দেয়ার শপথ নেয়া জরুরি।

আমরা মুসলমান। তাই বিজয় উৎসব করতে গিয়ে আল্লাহকে ভুলে গেলে চলবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে আল্লাহ আমাদের বিজয় দান করেছেন, এটা আল্লাহর অপার অনুগ্রহ। অষ্টম হিজরিতে নবীজি (সা.) মক্কা বিজয় করেন। মক্কার কুরাইশদের তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। নবী করিম (সা.) বিজয়ের দিন শুকরিয়াস্বরূপ আট রাকাত নামাজ আদায় করেছিলেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর পথে একদিন ও এক রাত (দেশের) সীমানা পাহারা দেয়া এক মাসব্যাপী রোজা পালন ও মাসব্যাপী রাত জাগরণ করে নামাজ আদায়ের চেয়ে বেশি কল্যাণকর। এ অবস্থায় যদি ওই ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে; তবে যে কাজ সে করে যাচ্ছিল, মৃত্যুর পরও তা তার জন্য অব্যাহত থাকবে; তার রিজিক অব্যাহত থাকবে; কবর ও হাশরে ওই ব্যক্তি ফিতনা থেকে মুক্ত থাকবে।’ (মুসলিম) দেশপ্রেম, দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় প্রহরা ও বিজয় দিবসে তাসবিহ, ক্ষমা প্রার্থনা এবং আনন্দ উৎসবও দেশের প্রতিটি নাগরিকের আবশ্যকীয় কাজ।

এ বিজয় দিবসে দেশের জন্য আত্মদানকারী সব শহিদের জন্য দোয়া ও প্রার্থনা করা ঈমানের একান্ত দাবি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিরপরাধ বাংলা ভাষাভাষী মানুষ অত্যাচারী পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যাচার নির্যাতন থেকে মুক্তির জন্য মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করব। দেশের উন্নয়নে তার কাছে সাহায্য চাইব। নিজেদের পরিশুদ্ধ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতেও তার সাহায্য চাইব। নিজেদের দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলে প্রকৃত ঈমানদার হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করব। নিজেদের দেশের সেবায় উৎসর্গ করব। এমনটিই ইসলামের দিকনির্দেশনা।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ