নতুন ঋতু শীতকালের আগমনি বার্তা আগেই ঘোষিত হয়েছে। এখন আমরা পুরোপুরি শীত অনুভব করছি। মুমিনের জন্য প্রতিটা ঋতু, প্রতিটা মৌসুমই গনিমত, সুবর্ণ সুযোগ। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একজন মুমিন জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে, চির আকাঙ্ক্ষিত জান্নাতের পথের পাথেয় খুঁজে ফেরে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘জাহান্নামের আগুন তার রবের কাছে অভিযোগ করে বলল, হে রব! আমার একাংশ আরেকাংশকে খেয়ে ফেলছে। আল্লাহ তখন তাকে দুটি নিঃশ্বাসের অনুমতি দিলেন। একটি নিঃশ্বাস শীতকালে এবং আরেকটি নিঃশ্বাস গ্রীষ্মকালে। এ কারণেই তোমরা গ্রীষ্মের প্রখরতা ও ঠান্ডার তীব্রতা অনুভব করে থাক।’ (বুখারি: ৩০৩২; মুসলিম: ১২৭৭)
তাই কনকনে শীত কিংবা ছাতি শুকানো গ্রীষ্ম দুই-ই আমাদের জাহান্নামের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেহেতু প্রতিটি মুমিনের উচিত তীব্র শীত ও অত্যধিক গরম অনুভূত হলে জাহান্নামের কথা স্মরণ কর। আল্লাহ তায়ালার কাছে জাহান্নামের শাস্তি থেকে পানাহ চাওয়া। যে কোনো দোয়ায় বিশেষত সকাল-সন্ধ্যা ‘আল্লাহুম্মা আজিরনি মিনান্নার’, (হে আল্লাহ, আপনি আমাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দান করুন) বা এ এমন অর্থবোধক দোয়াগুলো গুরুত্বের সঙ্গে করা দরকার।
প্রথম দোয়াটি সকাল-সন্ধ্যা সাতবার পড়ার কথা মুসনাদে আহমাদের একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। যা পড়লে ওইদিন মারা গেলে জাহান্নাম থেকে আল্লাহ তাকে মুক্তি দান করবেন। তবে ওই হাদিসটিকে অনেক মুহাদ্দিস যঈফ বলেছেন।
অবশ্য আনাস ইবনু মালিক (রা.) কর্তৃক এ মর্মে সহিহ হাদিসও বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো লোক জান্নাতের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে তিনবার প্রার্থনা করলে জান্নাত তখন বলে, হে আল্লাহ! তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান। আর কোনো লোক তিনবার জাহান্নাম থেকে পানাহ (আশ্রয়) চাইলে জাহান্নাম তখন আল্লাহ তায়ালার কাছে বলে, হে আল্লাহ! তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিন।’ (সুনান তিরমিজি: ২৫৭২)
ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবু বকর (রা.) একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) কে প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), আপনার কালো দাড়ির মধ্যে কিছু সাদা দাড়ি দেখা যাচ্ছে। আপনি কি তাহলে বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আমাকে হুদ, ওয়াকিয়া, মুরসালাত, আম্মা-ইয়াতাসা আলুন এবং ইযাশ-শামসু কুওবিরাত— এই সুরাগুলো বৃদ্ধ করে ফেলেছে।’ (সুনান তিরমিজি: ৩২৯৭)
এ সুরাগুলোতে মূলত কিয়ামত ও জাহান্নামের ভয়াবহতা নিয়ে আলোচিত হয়েছে। কিয়ামত ও জাহান্নামের টেনশনে তাঁর দাড়ি পেকে গেছে বলে তিনি বুঝিয়েছেন। নিষ্পাপ নবীর দাড়ি সেই জাহান্নামের আগুনে পেকে গেলেও আমাদের যেন কোনো ভাবনাই নেই! জাহান্নামের অসহ্য আগুন থেকে বাঁচতে আমরা কী করছি? আছে কি কোনো চিন্তা বা পরিকল্পনা? আমাদের কি কোনো উদ্বেগ আছে? আল্লাহ তায়ালা কী বলেন লক্ষ্য করুন— ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন হতে বাঁচাও, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর।’ (সুরা তাহরিম: ৬)
অর্থাৎ এই সর্বভুক জাহান্নামের খাদ্য বানানো হবে বেঈমান নাফরমান মানুষকে। অথচ আমরা এ ব্যাপারে একদমই উদাসীন। এর কারণ আমাদের পাপের দরুন আমাদের অন্তর মরে গেছে। জাহান্নামের কথা শুনলে আমাদের কোনো অনুভূতি তৈরি হয় না, আমাদের ভেতরে অস্থিরতা তৈরি হয় না। জাহান্নামের ভয়ে নবীজি (সা.) শুধু নন, যুগে যুগে আল্লাহভীরু সব পুণ্যবান মানুষই কেঁদেছেন। আমাদেরও কাঁদা উচিত। কান্না ও চোখের পানিই পারে জাহান্নামের অতল দরিয়া নেভাতে। একটি বড় হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের মাঠে আরশের নিচে ছায়া পাবে সাত শ্রেণির লোক। তার মধ্যে এক প্রকার হলো, সেই ব্যক্তি যে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও জাহান্নমের ভয়ে ভীত হয়ে নিভৃতে চোখের পানি ফেলে। (মুত্তাফাকুন আলাইহি হাদিস) তাই আমাদেরও জাহান্নামের ভয়ে ক্রন্দন করা উচিত। ইয়া রব, কিভাবে আমরা তীব্র ঠান্ডা ও প্রচণ্ড গরম সহ্য করব!
এখন শীতকাল চলছে, আসুন হাদিস ও সাহাবিদের কথামালায় দেখি তারা কিভাবে শীতকালকে মূল্যায়ন করেছেন। আবু সাইদ খুদরি (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘শীতকাল হলো মুমিনের জন্য বসন্তকাল।’ অর্থাৎ— ইবাদতের মৌসুম। (মুসনাদে আহমাদ)
বায়হাকির আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরপর বলেছেন, ‘শীতের দীর্ঘ রাত, ফলে সে তাহাজ্জুদ পড়ে এবং এর দিন সংক্ষিপ্ত ফলে সে রোজা রাখে।’ অর্থাৎ রাত লম্বা হওয়ায় পর্যাপ্ত ঘুম হওয়ার পরেও একটু রাত জেগে আল্লাহর ইবাদত করা তাহাজ্জুদ পড়া যায়। তেমনি দিন ছোট হওয়ার কারণে রোজা রাখা সহজ হয়ে যায়। এভাবেই সে বসন্তকালে যেমন নানা ফলফুল শোভিত বাগানে বিচরণ করে তেমনি শীতকালে সে নানা ইবাদতে সুশোভিত সময় উপভোগ করে।
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খাত্তাব (রা.) বলতেন, ‘ইবাদতকারীদের জন্য গনিমতের মৌসুম ঋতু হলো শীতকাল।’ বিখ্যাত তাবেয়ি উবাইদ বিন উমাইর লাইছি (রহ.) বলেন, ‘হে কোরআন ওয়ালারা ওঠো, লম্বা রাতে দীর্ঘ কেরাতে কিয়ামুল লাইল পড়। আর দিন ছোট তাই দিনে বেশি বেশি নফল রোজা রাখো।’
তেমনি হাসান আল-বসরি (রহ.) বলেন, ‘কতই সুন্দর না এই শীতকালের মৌসুম। রাত বড় তাই মুমিনরা তাহাজ্জুদ পড়ার সুযোগ পায় এবং দিন ছোট তাই রোজা রাখতে পারে।’ সুতরাং আসুন, হাদিসে রাসুল (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ও তাবেয়িদের (রহ.) কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা শীতের বড় রাতে তাহাজ্জুদ পড়া ও ছোট দিনে রোজা রাখায় নিজেকে অভ্যস্ত করি। জাহান্নাম থেকে মুক্তির প্রার্থনায় তাহাজ্জুদ ও রোজাকে কাজে লাগাই।
৮ ডিসেম্বর-২৩ টঙ্গীর আন-নূর জামে মসজিদে দেয়া জুমার বয়ান থেকে অনুলিখন
— মুহাম্মদ আব্দুল খালেক আশিক
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ