সমাজ, রাষ্ট্র সর্বোপরি পুরো পৃথিবীতে যখন জুলুম-নির্যাতন-নিপীড়ন, অন্যায়-অবিচার, পাপাচার, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা ব্যাপক আকার ধারণ করে, তখন মহান আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে ভূমিকম্পসহ নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বালা-মুসিবত দিয়ে সতর্ক করে থাকেন। যাতে করে মানবজাতি ওইসব পাপাচার, অবিচার, অন্যায়-অপরাধ বর্জন করে দ্বীনের পথে ও আল্লাহর দিকে ফিরে আসে।
কোরআনে ভূমিকম্প প্রসঙ্গ মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘হে মানুষ! নিজ প্রতিপালকের (ক্রোধকে) ভয় কর। জেনে রেখ, কিয়ামতের প্রকম্পন এক সাংঘাতিক জিনিস।’ (সুরা হাজ্জ: ১) অপর এক আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা কি আসমানওয়ালার থেকে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে গেছ যে, তিনি তোমাদেরকে ভূমিতে ধসিয়ে দেবেন না, যখন তা হঠাৎ থরথর করে কাঁপতে থাকবে? নাকি তোমরা আসমানওয়ালা থেকে নিশ্চিত হয়ে গেছ এ ব্যাপারে যে, তিনি তোমাদের ওপর পাথর-বৃষ্টি বর্ষণ করবেন না, অচিরেই তোমরা জানতে পারবে কেমন ছিল আমার সতর্কবাণী?’ (সুরা মুলক: ১৬-১৭)
আরেকটা আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, তবে কি তারা আল্লাহ প্রদত্ত অবকাশ (-এর পরিণাম) সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গেছে? (যদি তাই হয়) তবে (তারা যেন স্মরণ রাখে), আল্লাহ প্রদত্ত অবকাশ সম্পর্কে নিশ্চিত থাকে কেবল সেইসব লোক, যারা শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’ (সুরা আ’রাফ: ৯৯) অন্য আরেকটা আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘মানুষ নিজ হাতে যা কামায়, তার ফলে স্থলে ও জলে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে, আল্লাহ তাদেরকে তাদের কতক কৃতকর্মের স্বাদ গ্রহণ করাবেন বলে, হয়ত (এর ফলে) তারা ফিরে আসবে।’ (সুরা রুম: ৪১)
উপরিউক্ত আয়াতসমূহ দ্বারা বোঝা গেল, মানুষ দুনিয়ার জীবনে যে ব্যাপক বালা-মুসিবতের সম্মুখীন হয়, যেমন দুর্ভিক্ষ, মহামারি, ভূমিকম্প, ভূমিধস, শত্রুর আগ্রাসন, জালিমের আধিপত্য ইত্যাদির প্রকৃত কারণ ব্যাপকভাবে আল্লাহ তায়ালার হুকুম-আহকাম অমান্য করা এবং পাপাচারে লিপ্ত হওয়া। এভাবে এসব বিপদ-আপদ মানুষের আপন হাতের কামাই হয়ে থাকে। আল্লাহ তায়ালা মানুষের ওপর এসব বালা-মুসিবত, বিপদ-আপদ এজন্য চাপিয়ে দেন, যাতে করে মানুষের মন নরম হয়ে দুষ্কর্ম থেকে, পাপাচার থেকে বিরত থাকে।
হাদিসে ভূমিকম্প প্রসঙ্গ
এ ব্যাপারে দীর্ঘ এক হাদিসে আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন মানুষ গনিমতের (যুদ্ধলব্ধ) ব্যক্তিগত সম্পদ মনে করতে থাকবে, আমানতের সম্পদ গনিমত মনে করতে থাকবে, জাকাতকে জরিপানার মাল মনে করবে, ধর্মবিবর্জিত শিক্ষার প্রচলন হবে, পুরুষ স্ত্রীর আনুগত্য করবে, কিন্তু নিজ মায়ের অবাধ্য হবে, বন্ধুবান্ধবকে কাছে টানবে, কিন্তু পিতাকে দূরে ঠেলে দেবে, মসজিদে হট্টগোল বেড়ে যাবে, পাপাচারীরা গোত্রের নেতা হবে, নিকৃষ্ট লোক সমাজের কর্তা হবে, মানুষের অনিষ্টতার ভয়ে তাকে সম্মান করা হবে, গায়িকা-নর্তকী ও বাদ্যযন্ত্রের বিস্তার ঘটবে, মদ পান করা হবে, উম্মতের শেষ জামানার লোকেরা পূর্ববর্তী মনীষীদের অভিসম্পাত করবে, তখন তোমরা অগ্নি বায়ু, ভূমিধস, ভূমিকম্প, চেহারা বিকৃতি, পাথর বর্ষণের এবং আরও কিয়ামতের আলামতসমূহের অপেক্ষা করতে থাক। তখন একের পর এক বালা-মুসিবত আপতিত হবে। যেমন মালা খুলে গেলে একের পর এক পুঁতি ঝরতে থাকে।’ (মেশকাত: ৫৪৪০)
এ ব্যাপারে আরেকটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামত কায়েম হবে না, যে পর্যন্ত না ইলম উঠিয়ে নেয়া হবে, অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে, সময় সংকুচিত হয়ে আসবে, ফিতনা প্রকাশ পাবে এবং হারজ বৃদ্ধি পাবে। হারজের ব্যাখ্যায় বলেন, হারজ অর্থ খুনখারাবি। তোমাদের সম্পদ এত বৃদ্ধি পাবে যে, শেষ গ্রাম সম্পদ গ্রহণের জন্য কোনো লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না।’ (বুখারি: ১০৩৬)
ভূমিকম্পের সময় করণীয়
ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক যে কোনো দুর্যোগের সময় প্রত্যেক মুসলমানের খুবই আন্তরিকভাবে মহান আল্লাহর কাছে তওবা করা উচিত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যদি সে সকল জনপদবাসী ঈমান আনত ও তাকওয়া অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের জন্য আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী থেকে কল্যাণধারা মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা (সত্য) প্রত্যাখ্যান করল। সুতরাং তারা ক্রমাগত যা করে যাচ্ছিল, তার পরিণামে আমি তাদেরকে পাকড়াও করি।’ (সুরা আরাফ: ৯৬)
তাই যখন কোথাও ভূমিকম্প হয় অথবা সূর্যগ্রহণ কিংবা ঝড়ো বাতাস বা বন্যা হয়, তখন সবার উচিত মহান আল্লাহর কাছে অতি দ্রুত তওবা করা। তার কাছে নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা। মহান আল্লাহকে বেশি পরিমাণে স্মরণ করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা। সঙ্গে সঙ্গে নফল নামাজে দাঁড়িয়ে যাওয়া এ ব্যাপারে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হুযাইফা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)কে যখনই কোনো বিষয় চিন্তিত করে তুলত, তিনি নফল নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন।’ (আবু দাউদ: ১৩১৯)
তাই প্রতিটি মুমিন-মুসলমানের উচিত, যাপিত জীবনে যখনই ভূমিকম্পসহ যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসে, তখন আল্লাহ তায়ালার দিকে অভিমুখী হয়ে তওবা ইস্তেগফার করা এবং নামাজে দাঁড়িয়ে যাওয়া। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহায় হোন।
লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া কাশেফুল উলূম মাদ্রাসা, মধুপুর, টাঙ্গাইল
নয়াশতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ