ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

খুবায়েব বিন আদীর (রা.) শাহাদতের ঘটনা

প্রকাশনার সময়: ২২ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:৫৬

ইসলামের ইতিহাসে সোনালি মানুষ হিসাবে স্মরণীয় ও বরণীয় যারা নিজেদের জীবনকে আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিয়ে শাহাদতের অমিয় সুধা পান করেছেন, খুবায়েব বিন আদী (রা.) ছিলেন তাদের অন্যতম। তার নাম খুবায়েব, পিতার নাম আদী। তার জন্ম ও শৈশব-কৈশোর সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। তিনি বদর ও উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। অতঃপর ৪র্থ হিজরিতে সারিয়া রাজিতে অংশগ্রহণ করে শাহাদতবরণ করেন।

শাহাদতবরণের ঘটনা : ৪র্থ হিজরির সফর মাসে কুরায়েশরা ষড়যন্ত্র করে আযাল ও ক্বাররাহ গোত্রের সাতজন লোককে রাসূল (সা.)-এর দরবারে পাঠায়। তারা গিয়ে আরজ করে, আমাদের গোত্রের মধ্যে ইসলামের কিছু চর্চা রয়েছে। তাদের দ্বীন শিক্ষাদানের জন্য ও কুরআন পড়ানোর জন্য কয়েকজন উঁচু মর্যাদাসম্পন্ন সাহাবিকে পাঠালে আমরা উপকৃত হতাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) সরল বিশ্বাসে তাদের গোত্রে আছেম বিন ছাবিত (রা.)-এর নেতৃত্বে ৬ জন মুহাজির ও ৪ জন আনসারিসহ ১০ জনের একটি মুবাল্লিগ দল প্রেরণ করেন।

তবে ইমাম বুখারি উল্লেখ করেন, আল্লাহর রাসূল (সা.) দশ ব্যক্তিকে গোয়েন্দা হিসাবে সংবাদ সংগ্রহের জন্য পাঠান। ওই দলের নেতা আছেম ছিলেন ওমরের শ্বশুর এবং আছেম বিন ওমরের নানা। তারা রাবেগ ও জেদ্দার মধ্যবর্তী রাজি নামক ঝরনার কাছে পৌঁছলে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী হুযায়েল গোত্রের শাখা বনু লেহিয়ানের ১০০ তীরন্দাজ তাদের ওপর হামলা করে। এতে আছেমসহ ৮ জন শহিদ হন এবং খুবায়েব বিন আদী ও যায়েদ বিন দাছেনাহকে তারা মক্কায় নিয়ে বিক্রি করে দেয়।

অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তারা উসফান ও মক্কার মধ্যবর্তী হাদাআত নামক স্থানে পৌঁছলে হুযায়েল গোত্রের লেহইয়ান শাখার প্রায় দুশ তীরন্দাজকে তাদের পিছু ধাওয়া করার জন্য পাঠায়। এরা তাদের চিহ্ন দেখে চলতে থাকে। সাহাবিরা মদিনা থেকে সঙ্গে নিয়ে আসা খেজুর যেখানে বসে খেয়েছিলেন। অবশেষে এরা সে স্থানের সন্ধান পেয়ে যায়। তখন তারা বলল, ইয়াছরিবের খেজুর। অতঃপর এরা তাদের পদচিহ্ন দেখে চলতে থাকে। আছেম ও তার সাথিরা এদের দেখে একটি উঁচু স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। তখন কাফিররা তাদের ঘিরে ফেলল এবং তাদের বলতে লাগল, তোমরা অবতরণ কর ও স্বেচ্ছায় বন্দিত্ববরণ কর। আমরা তোমাদের অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, তোমাদের মধ্য থেকে কাউকে আমরা হত্যা করব না।

তখন দলনেতা আছেম ইবনু ছাবিত (রা.) বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি তো আজ কাফিরদের নিরাপত্তায় অবতরণ করব না। হে আল্লাহ! আমাদের পক্ষ থেকে আপনার নবীকে সংবাদ পৌঁছে দিন’। অবশেষে কাফিররা তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করল। আর তারা আছেম (রা.)সহ সাতজনকে শহিদ করল। অতঃপর অবশিষ্ট তিনজন খুবায়েব আনছারী, যায়েদ ইবনু দাছিনা (রা.) ও অপর একজন তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারের ওপর নির্ভর করে তাদের কাছে অবতরণ করলেন। কাফিররা তাদের আয়ত্তে নিয়ে তাদের ধনুকের রশি খুলে ফেলে তাদের বেঁধে ফেলল।

এ সময় তৃতীয় ব্যক্তি বলে উঠলেন, ‘এযে গোড়াতেই বিশ্বাসঘাতকতা! আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের সঙ্গে যাব না। যারা শহিদ হয়েছেন আমি তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করব’। কাফিররা তাকে শহিদ করে ফেলে এবং খুবায়েব ও ইবনু দাছিনাকে নিয়ে চলে যায়। অবশেষে তাদের উভয়কে মক্কায় বিক্রি করে দেয়।

খুবায়েবকে ক্রয়কারী: খুবায়েবকে হত্যার জন্য ৮০ মিছক্বাল স্বর্ণ মতান্তরে ৫০টি উটের বিনিময়ে খরিদ করেন হুজায়ের বিন আবু ইহাব তামীমী, যিনি বদর যুদ্ধে নিহত হারেছ বিন আমের-এর সহোদর ভাই ছিলেন। কারও মতে, হারেছ বিন আমের বিন নওফেলের মেয়ে ১০০ উটের বিনিময়ে খুবায়েবকে ক্রয় করে। মামার ইবনু শিহাব সূত্রে বর্ণনা করেন, হারেছ ইবনু আমের ইবনে নওফেলের বংশধররা খুবায়েবকে ক্রয় করে নেয়।

ইমাম বুখারি উল্লেখ করেন, হারেছ বিন আমেরের পুত্ররা খুবায়েবকে ক্রয় করে নেয়। কারণ বদর যুদ্ধের দিন খুবায়েব (রা.) হারিছ ইবনু আমিরকে হত্যা করেছিলেন। খুবায়েব (রা.) কিছু দিন তাদের কাছে বন্দি থাকেন।

শূলে বিদ্ধ করার স্থান ও হত্যাকারী : হারাম এলাকা থেকে বের করে ৬ কিমি উত্তরে ‘তানঈম’ নামক স্থানে ছাফওয়ান বিন উমাইয়ার গোলাম নিসতাস ইবনুদ দাছিনাকে হত্যা করে। অতঃপর একই দিনে খুবায়েবকে সেখানে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা হয়।

ইমাম বুখারি উল্লেখ করেন, তারা খুবাইবকে শহিদ করার উদ্দেশে হারামের কাছে হতে হিলের দিকে নিয়ে বের হয়ে পড়ল। ওক্ববা বিন হারেছ বিন আমের খুবায়েবকে এবং ছাফওয়ান বিন উমাইয়া বিন খালাফ যায়েদ হত্যা করে বদর যুদ্ধে তাদের স্ব স্ব পিতৃহত্যার বদলা নেয়। কিন্তু আববাদ ইবনু আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের স্বীয় পিতার সূত্রে উক্ববা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি খুবায়েবকে হত্যা করিনি। কেননা তখন আমি ছোট ছিলাম। তবে বনু আব্দুদ দারের মিত্র আবু মায়সারা একটি ছোট বর্শা নিয়ে আমার হাতে ঢুকিয়ে দেয়। অতঃপর সে বর্শাসহ আমার হাত ধরে খুবায়েবকে আঘাত করে তাকে হত্যা করে।’

শূলে চড়ার আগে খুবায়েব দুরাকাত নফল সালাত আদায় করেন এবং বলেন, আমি ভীত হয়েছি, এ অপবাদ তোমরা না দিলে আমি দীর্ঘক্ষণ সালাত আদায় করতাম। তিনিই প্রথম এ সুন্নাতের সূচনা করেন। অতঃপর কাফেরদের জন্য বদ দোয়া করেন এবং মর্মন্তুদ কবিতা আবৃত্তি করেন, যা সহিহ বুখারিসহ বিভিন্ন হাদিস ও জীবনীগ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে। খুবায়েবের সেই বিখ্যাত দোয়াটি ছিল নিম্নরূপ— ‘হে আল্লাহ! তুমি এদের এক এক করে গুণে রাখ। তাদের এক এক করে হত্যা কর এবং এদের একজনকেও অবশিষ্ট রেখ না’।

তার পঠিত সাত বা দশ লাইন কবিতার বিশেষ দুটি লাইন ছিল নিম্নরূপ—

‘আমি যখন মুসলিম হিসাবে নিহত হই তখন আমি কোনো পরোয়া করি না যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমাকে কোন পাশে শোয়ানো হচ্ছে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আমার মৃত্যু হচ্ছে। তিনি ইচ্ছা করলে আমার খণ্ডিত টুকরাগুলোয় বরকত দান করতে পারেন।’

খুবায়েবের সাথি যায়েদ বিন দাছেনাকে হত্যার পূর্বে আবু সুফিয়ান তাকে বললেন, তুমি কি এটাতে খুশি হবে, তোমার স্থলে আমরা মুহাম্মাদকে হত্যা করি এবং তুমি তোমার পরিবারসহ বেঁচে থাক? তিনি বলেন, ‘কখনোই না। মহান আল্লাহর কসম! আমি চাই না যে, আমার স্থলে তার পায়ে একটি কাটারও আঘাত লাগুক’। এ কথা শুনে বিস্মিত আবু সুফিয়ান বললেন, ‘মুহাম্মাদের সাথিরা মুহাম্মাদকে যেরূপ ভালোবাসে সেরূপ কাউকে আমি দেখিনি’।

মৃত্যুর পূর্বে খুবায়েবের শেষ বাক্য ছিল— ‘হে আল্লাহ, আমরা তোমার রাসূলের রিসালাত পৌঁছে দিয়েছি। এক্ষণে তুমি তাকে আমাদের সঙ্গে যা করা হচ্ছে, সে খবরটি পৌঁছে দাও’।

ওমর (রা.)-এর গভর্নর সাঈদ বিন আমের (রা.) যিনি খোবায়েবের হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, তিনি ওই মর্মান্তিক ঘটনা স্মরণ করে মাঝে-মধ্যে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যেতেন। তিনি বলতেন, খোবায়েবের নিহত হওয়ার দৃশ্য স্মরণ হলে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। আল্লাহর পথে কত বড় ধৈর্যশীল তিনি ছিলেন যে, একবার উহ্ পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। বন্দি অবস্থায় তাকে থোকা থোকা আঙুর খেতে দেখা গেছে। অথচ ওই সময় মক্কায় কোনো আঙুর ছিল না’।

দাফন : বীরে মাউনার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে বেঁচে যাওয়া একমাত্র সাহাবি আমর বিন উমাইয়া যামরি প্রহরীদের লুকিয়ে অতীব চতুরতার সঙ্গে খুবায়েবের লাশ এনে সসম্মানে দাফন করেন।

ইবনু হাজার আসক্বালানি (রহ.) উল্লেখ করেন, নবী করিম (স.) মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ ও যুবায়ের ইবনুল আওয়ামকে প্রেরণ করেন খুবায়েব (রা.)-কে শূলের কাষ্ঠ থেকে নামানোর জন্য। তারা দুজন তানঈমে পৌঁছে ৪০ জন নেশাগ্রস্ত মাতাল লোক দেখতে পান। তারা খুবায়েবকে নামান এবং যুবায়ের তাকে স্বীয় ঘোড়ায় উঠিয়ে নেন। তার দেহ তখনো সজীব ছিল, কিছুমাত্র পরিবর্তিত হয়নি। এ সময় মুশরিকরা এসে তাদের ধমক দিল ও সতর্ক করল। তারা সন্নিকটে চলে এলো, তখন যুবায়ের (রা.) খুবায়েবের লাশ ফেলে দিলেন। জমিন লাশকে গিলে ফেলল। ফলে তার নামকরণ হলো ‘জমিন কর্তৃক গ্রাসকৃত’ মহান শহিদ।

খুবায়েবের অনুপম ব্যবহার : ইবনু শিহাব (রহ.) বলেন, আমাকে ওবায়দুল্লাহ ইবনু আয়ায অবহিত করেছেন, তাকে হারিছের কন্যা জানিয়েছে যে, যখন হারিছের পুত্রগণ খুবায়েব (রা.)-কে শহিদ করার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিল, তখন তিনি তার কাছ থেকে ক্ষৌর কাজ সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে একটা ক্ষুর ধার চাইলেন। তখন হারিছের কন্যা তাকে একখানা ক্ষুর ধার দিল। সে সময় ঘটনাক্রমে আমার ছেলে আমার অজ্ঞাতে খুবায়েবের কাছে চলে যায় এবং আমি দেখলাম যে, আমার ছেলে খুবায়েবের ঊরুর ওপর বসে আছে এবং খুবায়েবের হাতে রয়েছে ক্ষুর। আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম।

খুবায়েব আমার চেহারা দেখে বুঝতে পারলেন যে, আমি ভয় পাচ্ছি। তখন তিনি বললেন, তুমি কি এ ভয় কর যে, আমি শিশুটিকে হত্যা করব? কখনো আমি তা করব না। আল্লাহর কসম! আমি খুবায়েবের মতো উত্তম বন্দি কখনো দেখিনি। আল্লাহর শপথ! আমি একদা দেখলাম, তিনি লোহার শিকলে আবদ্ধ অবস্থায় ছড়া থেকে আঙুর খাচ্ছেন, যা তার হাতেই ছিল। অথচ এ সময় মক্কায় কোনো ফলই পাওয়া যাচ্ছিল না। হারিছের কন্যা বলত, এ তো ছিল আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে প্রদত্ত জীবিকা, যা তিনি খুবায়েবকে দান করেছেন।

নয়াশতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ