ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

জান্নাতের সংখ্যা ৮টি নাকি ১২টি?

প্রকাশনার সময়: ২১ অক্টোবর ২০২৩, ১৬:৫৯

জান্নাতের সংখ্যা কতটি? এমন প্রশ্নের উত্তরে ৯৯ শতাংশ মুসলমান উত্তর দেবেন, ৮টি। জান্নাতের সংখ্যা কী আসলেই ৮টি নাকি আরও বেশি? প্রসঙ্গত আরও একটি প্রশ্ন রয়েছে, তা হলো—জান্নাতের সংখ্যা আলাদা আলাদাভাবে ৮টি নাকি জান্নাত মূলত একটি?

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘সিফাত বা গুণের বিবেচনায় জান্নাতের নাম ও সংখ্যা একাধিক হলেও মৌলিকতা বিচারে জান্নাত মূলত একটি-ই। একইভাবে আল্লাহর নাম, কিতাবের নাম, রাসুলদের নাম, আখিরাতের নাম এবং জাহান্নামের নাম- সবই মৌলিকতার বিচারে এক কিন্তু গুণগত বিবেচনায় একাধিক।’ (হাদিয়ুল আরওয়াহ ইলা বিলাদিল আফরাহ, আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম, পৃষ্ঠা : ১১১)

সাধারণত ৮টি জান্নাতের কথা, নাম ও পরিচয়ের তথ্য প্রচলিত থাকলেও পবিত্র কোরআন ও হাদিসের বর্ণনায় প্রায় ১২টি জান্নাতের কথা, নাম ও পরিচয় পাওয়া যায়। চলুন তাহলে আমরা সেসব জান্নাতের নাম, পরিচয় জানি—

১. জান্নাত : জান্নাতের শাব্দিক অর্থ বাগান বা উদ্যান। পরকালীন জীবনের শান্তির নিবাস বোঝাতে এ নামটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে এবং এ নামটি সর্বজনবিদিত। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘তোমরা যে আমল করতে তার প্রতিদানস্বরূপ তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করো।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৩২)

আল্লাহতায়ালা আরও এরশাদ করেছেন, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে; তাদের জন্য রয়েছে এমন জান্নাত; যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয় নদীনালা এবং এটাই প্রকৃত সফলতা।’ (সুরা বুরুজ, আয়াত : ১১)

২. দারুস সালাম : দারুস সালাম আরবি দুটি শব্দের যুগল রূপ। ‘দার’ মানে দরজা, ঘর, নিবাস আর ‘সালাম’ মানে শান্তি। নিরাপত্তা। দারুস সালাম মানে শান্তি বা নিরাপত্তার নিবাস। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে দারুস সালাম বা শান্তির নিবাস রয়েছে।’ (সুরা আনআম, আয়াত : ১২৭)

আরও এরশাদ হয়েছে, ‘আর আল্লাহ তাদের দারুস সালাম বা শান্তির নিবাসের দিকে ডাকেন।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত : ২৫)

যাবতীয় সব বিপদ-আপদ ও বালা-মুসিবত থেকে শান্তি ও নিরাপত্তার ঘর হলো দারুস সালাম। (হাদিয়ুল আরওয়াহ ইলা বিলাদিল আফরাহ, আল্লামা ইবনুল কাইয়্যুম, পৃষ্ঠা : ১১৩)

৩. দারুল খুলদ : দারুল খুলদ আরবি দুটি শব্দের যুগল রূপ। ‘দার’ মানে দরজা, ঘর, নিবাস আর ‘খুলদ’ মানে স্থায়ী। দারুল খুলদ মানে স্থায়ী নিবাস। এ জান্নাতে প্রবেশপথ আছে কিন্তু বের হওয়ার কোনও দরজা নেই।

আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘তাদের জিজ্ঞাসা করুন উত্তম কী এটাই নাকি চিরস্থায়ী জান্নাত- মুত্তাকিদের যার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এটাই তাদের পুরস্কার ও শেষ ঠিকানা। তারা যা চাবে; সব থাকবে সেখানে। সেখানে তারা বাস করবে অনন্তকাল।’ (সুরা ফুরকান, আয়াত : ১৫-১৬)

আল্লাহতায়ালা আরও এরশাদ করেছেন, ‘তোমরা তাতে (জান্নাতে) শান্তির সঙ্গে প্রবেশ করো। আর এটাই স্থায়িত্বের দিন।’ (সুরা কাফ, আয়াত : ৩৪)

৪. দারুল মুকামাহ : দারুল মুকামাহ আরবি দুটি শব্দের যুগল রূপ। ‘দার’ মানে দরজা, ঘর, নিবাস আর ‘মুকামাহ’ মানে স্থায়ী বা চিরস্থায়ী। দারুল মুকামাহ মানে চিরস্থায়ী নিবাস।

আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘যিনি নিজ অনুগ্রহে আমাদের চিরস্থায়ী নিবাস দিয়েছেন; যেখানে কোনও কষ্ট এবং কোনো ক্লান্তিও আমাদের স্পর্শ করবে না।’ (সুরা ফাতির, আয়াত : ৩৫)

৫. জান্নাতুল মাওয়া : জান্নাতুল মাওয়া আরবি দুটি শব্দের যুগল রূপ। অর্থ নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এ জান্নাতকে শহিদদের জান্নাত বলা হয়। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই তিনি তাকে আরেকবার সিদরাতুল মুনতাহার বরইগাছের কাছে দেখেছেন, যার কাছে জান্নাতুল মাওয়া অবস্থিত।’ (সুরা নাজম, আয়াত : ১৩-১৫)

৬. জান্নাতুল আদন : জান্নাতুল আদন আরবি দুটি শব্দের যুগল রূপ। অর্থ স্থায়ী বা অবিনশ্বর বাসগৃহ। চিরন্তন নীড়। জান্নাতুল আদন হলো স্থায়ী ও চিরঞ্জীব জান্নাত। (হাদিয়ুল আরওয়াহ, পৃষ্ঠা : ১১৪)

আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘তারা প্রবেশ করবে জান্নাতুল আদন বা স্থায়ী বাসগৃহে। সেখানে তাদের অলংকৃত করা হবে সোনার বালা ও মণি-মুক্তা দ্বারা।’ (সুরা ফাতির, আয়াত : ৩৩)

আরও এরশাদ হয়েছে, ‘তাদের প্রবেশ করাবেন জান্নাতুল আদনের উত্তম বাসগৃহে।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত : ১২)

৭. দারুল হায়াওয়ান : দারুল হায়াওয়ান আরবি দুটি শব্দের যুগল রূপ। অর্থ স্থায়ী নিবাস। মুমিনদের পরকালীন স্থায়ী নিবাস বোঝাতে এ নামটি ব্যবহার করেছেন। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই পরকালীন নিবাস-ই স্থায়ী।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত : ৬৪)

৮. জান্নাতুল ফেরদৌস : জান্নাতুল ফেরদৌস আরবি দুটি শব্দের যুগল রূপ। অর্থ উৎকৃষ্ট বা উত্তম স্থান। সর্বোত্তম ও সর্বোৎকৃষ্ট জান্নাতকে জান্নাতুল ফিরদাউস বলা হয়ে থাকে। এ জান্নাতটি অন্যান্য জান্নাতের তুলনায় এ নামে নামকরণ করার অধিক উপযুক্ত। জান্নাতুল ফিরদাউস হলো সর্বোৎকৃষ্ট, প্রশস্ত ও সর্বোত্তম জান্নাত। এ জান্নাতের ছাদ হলো আল্লাহর আরশ। (হাদিয়ুল আরওয়াহ, পৃষ্ঠা : ৮৪-১১৬)

আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘তারাই জান্নাতুল ফেরদৌসের অধিকারী হবে; সেখানে তারা বসবাস করবে অনন্তকাল।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ১০-১১)

আরও এরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তাদের আতিথেয়তার জন্য রয়েছে জান্নাতুল ফেরদৌস।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত : ১০৭)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা যখন আল্লাহতায়ালার কাছে জান্নাত কামনা করবে; তখন জান্নাতুল ফেরদৌস কামনা করবে। কারণ, সেটাই হলো উৎকৃষ্ট ও উন্নত জান্নাত। এ জান্নাতের ওপর রয়েছে পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার আরশ। তা থেকে জান্নাতের নহরগুলো প্রবাহিত।’ (বুখারি, হাদিস : ২৭৯০, ৭৪২৩)

৯. জান্নাতুন নাঈম : জান্নাতুন নাঈম আরবি দুটি শব্দের যুগল রূপ। অর্থ সুখময় নিসাব। এ জান্নাতে থাকবে শুধু সুখ আর শান্তি। থাকবে না কোনও দুঃখ-কষ্ট। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে; তাদের জন্য রয়েছে সুখময় জান্নাত।’ (সুরা লুকমান, আয়াত : ৮)

১০. মাকামুন আমিন : মাকামুন আমিন আরবি দুটি শব্দের যুগল রূপ। অর্থ নিরাপদ বা নিরাপত্তাবেষ্টিত স্থান। এ জান্নাতে সব ধরনের নিরাপত্তাজনিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। (হাদিয়ুল আরওয়াহ, পৃষ্ঠা : ১১৬)। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘মুত্তাকিরা থাকবে মাকামুন আমিন বা নিরাপদ স্থানে।’ (সুরা দুখান, আয়াত : ৫১)

১১. মাকআদু সিদক : মাকআদু সিদক আরবি দুটি শব্দের যুগল রূপ। অর্থ উপযুক্ত আসন। যথাযোগ্য আসন। এ জান্নাতের বৈশিষ্ট্য হলো, যত সুন্দর সুন্দর আসন ও বসার স্থান চাওয়া হবে, সবই পাওয়া যাবে। (হাদিয়ুল আরওয়াহ, পৃষ্ঠা : ১১৭) আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘মুত্তাকিরা থাকবে নদীবিধৌত জান্নাতে- উপযুক্ত আসনে বা যথাযোগ্য আসনে।’ (সুরা কমার, আয়াত : ৫৪-৫৫)

১২. কদামু সিদক : কাদামু সিদক আরবি দুটি শব্দের যুগল রূপ। অর্থ হলো সুউচ্চ মর্যাদা। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘মুমিনদের সুসংবাদ দিন, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে সুউচ্চ মর্যাদা।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত : ২)

জান্নাতের সংখ্যা ৮টি নাকি ১২টি এটা যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—জান্নাতের সংখ্যা আরও বেশিও হতে পারে বা কমও হতে পারে। কারণ এটা পরকালীন বিষয়। ইহকালীন জীবনে এ বিষয়ের সঠিক তথ্য জানার উপায় কোরআন ও হাদিস। কোরআন ও হাদিসে জান্নাতের বিভিন্ন শাখা-উপশাখাসহ যেসব নাম পাওয়া যায়, সেগুলো পয়েন্ট আকারে তুলে ধরা হলো মাত্র। এ বিষয়ে কোরআন বিশেষজ্ঞ আলেমগণ (মুফাসসির) বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। এ বিষয়ে তাদের মতামতগুলো মতপার্থক্য। কোনোভাবেই তা মতবিরোধ নয়। সুতরাং এটা নিয়ে কোনো তর্ক-বির্তকে জড়ানো উচিত না। মৌলিকভাবে জান্নাত একটি হতে পারে, হতে পারে আরও বেশিও এবং উল্লেখিত নামগুলো জান্নাতের বিভিন্ন শাখা-উপশাখা-স্তর।

নয়া শতাব্দী/আরআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ