ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুমিনের ব্যবহার হতে হয় অনুসরণীয়

প্রকাশনার সময়: ৩১ আগস্ট ২০২৩, ০৯:২৮

মানবজীবনে সুন্দর ব্যবহারের গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সুন্দর ও উত্তম কথা বলার নির্দেশ দিয়েছেন। ‘তোমরা মানুষের সঙ্গে উত্তম ও সুন্দর কথা বলো।’ (সুরা বাকারা: ৮৩) যুগে যুগে নবী-রাসুলগণ অন্ধকারে নিমজ্জিত, পথহারা, দিশেহারা মানুষদেরকে আলোর পথ দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন সুন্দর আচরণের মাধ্যমে। আজকের দিনে এসেও মানুষকে সত্য সুন্দর কল্যাণের পথে আনার ক্ষেত্রে উত্তম ব্যবহার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা পালন করছে।

সুন্দর আচরণ কাকে বলে

সুন্দর ব্যবহার এবং সুন্দরভাবে কথা বলা সুন্দর মনের পরিচয় বহন করে। সুন্দর আচরণ বলতে আমরা বুঝি কারও সঙ্গে সুন্দর করে কথা বলা, দেখা হলে সালাম দেয়া, কুশলাদি জিজ্ঞেস করা, কর্কশ ভাষায় কথা না বলা, ঝগড়া-ফাসাদে লিপ্ত না হওয়া, ধমক বা রাগের সুরে কথা না বলা, গিবত বা পরনিন্দা না করা, অপমান-অপদস্থ না করা, উচ্চ আওয়াজে কথা না বলা, গম্ভীর বা কালো মুখে কথা না বলা, সর্বদা হাসিমুখে কথা বলা, অন্যের সুখে সুখী হওয়া এবং অন্যের দুঃখে দুঃখী হওয়া, বিপদে দেখা করে সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ করা সুন্দর আচরণের অন্তর্ভুক্ত।

প্রকৃতপক্ষে মানুষের ভালো-মন্দ পরিচয় নির্ভর করে সুন্দর আচরণের ওপর। সুন্দর আচরণের মাধ্যমে ভালো পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব। কথায় আছে , ‘Courtesy pays a lot, but costs nothing’। সাধারণত মানুষ তার কার্যাবলি সম্পাদনের সময় যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করে তাকেই আমরা আচরণ বলে থাকি। ইংরেজি পরিভাষায়: ‘Do unto others as you wish to be done by’। কাজের দ্বারা মানুষের আচরণ প্রকাশ পায়। তাই বলা যায় ইবযধারড়ঁৎ রং ধ ধুি ড়ভ ধপঃরড়হ অর্থাৎ আচরণ হলো কার্যের একটি পন্থা বা উপায়। মানুষ মনে মনে যা চিন্তা করে এবং যেসব কাজের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয় তাকেই আচরণ বলা চলে।

সুন্দর আচরণের গুরুত্ব

ইসলামে সুন্দর আচরণের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। একজন মানুষের জীবনে সুন্দর আচরণ ও সৌজন্যবোধ শিক্ষা ও অনুসরণ করার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। সুন্দর আচরণ সম্পর্কে জনৈক ফ্রায়া স্টার্ক বলেন, ‘সু-আচার আচরণ অংকশাস্ত্রের শূন্যের মতো, আপাতদৃষ্টিতে এর গুরুত্ব ততটা বোঝা যায় না, কিন্তু সবকিছুর সঙ্গে এর সংমিশ্রণ বিরাট মূল্য পরিবর্ধন করে।’ মানব চরিত্রে দুইটি দিক হলো ভালো ও মন্দ। এই গুণ দুটির পরস্পর বিপরীত মেরুতে অবস্থান এবং এর সঙ্গে ব্যক্তির যোগাযোগ ও প্রভাব নির্ভর করে। যদি ব্যক্তির চরিত্রে ভালো গুণটি প্রকাশ পায় তাহলে তার অবস্থান একরকম, খারাপটি প্রকাশিত হলে অন্য রকম।

আল-কোরআনের দৃষ্টিতে সুন্দর আচরণ

পবিত্র কোরআনে সুন্দর আচরণের ব্যাপারে অনেক আয়াত রয়েছে। আল্লাহর নবীও ছিলেন সুন্দর আচরণের মূর্তপ্রতীক। যেমন:

ক. আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হূদয় হয়েছেন, পক্ষান্তরে আপনি যদি রূঢ় ও কঠিন হূদয় হতেন, তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য মাগফিরাত কামনা করুন।’ (সুরা আলে-ইমরান: ১৫৯)

খ. ‘কেউ যখন তোমাকে সৌজন্যমূলক সম্ভাষণ জানাবে প্রতি-উত্তরে তুমি তাকে তার চাইতে সুন্দর ধরনের সম্ভাষণ জানাও, কিংবা অন্তত ততটুকুই জানাও।’ (সুরা নিসা: ৮৬)

গ. তোমরা আল্লাহ্ ছাড়া কারও উপাসনা করবে না, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম ও দরিদ্রদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার তথা সুন্দর আচরণ করবে এবং মানুষকে সুন্দর কথা বলবে। (সুরা বাকারা : ৮৩)

ঘ. ‘আপন পালনকর্তার পথের প্রতি আহ্বান করুন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সঙ্গে বিতর্ক করুন উত্তম পন্থায়।’ (সুরা নাহল: ১২৫)

ঙ. ‘তোমরা তোমাদের পিতা-মাতা, নিকটাত্মীয়, এতিম, দরিদ্র, প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, পথিক এবং যারা তোমাদের অধিকারে এসেছে, সবার সঙ্গে সুন্দর আচরণ কর। (সুরা নিসা: ৩৬)

হাদিসে উত্তম ব্যবহার

রাসুল (সা.) ছিলেন উত্তম নৈতিক চরিত্রের সর্বোত্তম মডেল। আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি উত্তম নৈতিক চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত।’ (সুরা আল-কালাম: ৪)। প্রিয়নবী (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘উত্তম কথা বা ভালো কথাও একটি সাদকা।’ (বুখারি ও মুসলিম)

ক. ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, প্রিয়নবী (সা.) বলেন, ‘মুমিন ব্যক্তি কখনও অভিশাপকারী, তিরস্কারকারী হতে পারে না। অশ্লীল বাক্যব্যয়ী ও অহেতুক বাক্যব্যয়ীও হয় না।’ (তিরমিজি)

খ. ‘সদকা বা দান-খয়রাত মানুষকে শোচনীয় মৃত্যু হতে রক্ষা করে আর সুন্দর আচরণ আয়ুবর্ধক হয়। সুন্দর আচরণকারীকে আল্লাহ্ ভালোবাসেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)

গ. ‘যে ব্যক্তি সুন্দর আচরণ থেকে বঞ্চিত সে কল্যাণ থেকেও সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত।’ (মুসলিম)

ঘ. ‘যার আচার-ব্যবহার সুন্দর, আমি তার জন্য জান্নাতে একটি বাড়ির নিশ্চয়তা প্রদান করছি।’ (আবু দাউদ)

ঙ. ‘তোমার ভাইয়ের সঙ্গে মুচকি হাসির বিনিময় করাও সদকার সওয়াব হয়ে যায়।’ (তিরমিজি)

চ. ‘সর্বোত্তম ঈমানদার হচ্ছে ওই লোক যার চরিত্র সর্বোত্তম। আর তোমাদের মধ্যে সে লোকগুলো সর্বোত্তম যারা তাদের স্ত্রী-পরিবারের প্রতি উত্তম আচরণে অভ্যস্ত।’ (আহমদ, তিরমিজি) ছ. ‘উত্তম নৈতিক চরিত্র ও আচার-ব্যবহারের ন্যায় নেকির পাল্লা ভারী করতে আর দ্বিতীয় কোনো আমল নেই। আর আল্লাহ্ অশ্রাব্য গালমন্দ ও কটুকথা বলে এমন ব্যক্তিকে খুবই ঘৃণা করেন।’ (তিরমিজি, আবু দাউদ)

উত্তম আচরণ উন্নত ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক

ভালো কথা, ভালো ব্যবহার, সুন্দর আচরণ যাই বলি না কেন, এগুলো হচ্ছে একটি শিল্প। সুন্দর আচরণের মাধ্যমেই একজন ব্যক্তির সার্বিক পরিচয় ফুটে ওঠে, তার উন্নত ব্যক্তিত্বের প্রমাণ মেলে। সুন্দর আচরণের মাধ্যমেই একজন ব্যক্তি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হন। যারা সবসময় মানুষের সঙ্গে ভালো কথা বলে, সুন্দর আচরণ করে তাদেরকে সমাজের, দেশের সবাই অত্যন্ত পছন্দ করে, ভালোবাসে, সম্মান ও শ্রদ্ধা করে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনও তাদেরকে অত্যন্ত পছন্দ করেন। একটি ভালো কথা, সুন্দর আচরণ একটি ভালো গাছের মতো। সুন্দর আচরণকারীর সামনে-পেছনে মানুষ তার প্রশংসা করে। তার জন্য মন খুলে দোয়া করে। ফলে আল্লাহ এবং আসমান-জমিনের ফেরেশতারাও তাকে অত্যন্ত পছন্দ করেন। অপরদিকে খারাপ ব্যবহারে সম্পর্ক বিনষ্ট হয়। অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। সমাজের মানুষ তাকে অবহেলা, অবজ্ঞা ও ঘৃণার চোখে দেখে।

আমাদের নবী ছিলেন সদা-সত্যভাষী, হিতভাষী, শুদ্ধভাষী, সুভাষী এবং মানুষের সঙ্গে সুন্দর আচরণকারী। তাই তিনি ছিলেন সব মানুষের সেরা।

সুন্দর আচরণ চারিত্রিক সৌন্দর্যের মাপকাঠি

সামাজিক পরিমণ্ডলে সবার মাঝে বেড়ে ওঠা মানুষের সহজাত প্রকৃতি। যাদের চরিত্রে উত্তম গুণাবলির সমাবেশ ঘটে সে হয় স্মরণীয় ও বরণীয়। আর যার চরিত্র মন্দ দোষে দুষ্ট হয় সে হয় ধিকৃত ও পরিত্যাজ্য। আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আমার কাছে অধিক প্রিয়, যার চরিত্র ভালো।’ (বুখারি)

সেই সঙ্গে আরও কিছু বিষয় আছে সেগুলোও ত্যাগ করতে হবে। তবেই আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবন সুন্দর হবে। যেমন- মিথ্যা, কপটতা, কারও নামে মিথ্যা অপবাদ, অন্যের ছিদ্রান্বেষণ, পরশ্রীকারতা ত্যাগ, অহমিকা বর্জন, জুলুম-নির্যাতন, শত্রুতা-ঘৃণা, ক্রোধ, গিবত, বিশ্বাসঘাতকতা ও ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি গুণাবলি পরিত্যাগ করতে হবে। উল্লেখিত বদগুণ থেকে নিজেদের যেমন দূরে থাকার চেষ্টা করতে হবে, তেমনি যাদের মধ্যে এসব দুর্বলতা আছে তাদেরকে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে ধৈর্য, প্রজ্ঞা, ক্ষমা ও অমায়িক ব্যবহার দিয়ে। অন্যের ভুল উপেক্ষা করে তাকে ক্ষমা করে দিতে হবে। তবেই সমাজ হয়ে উঠবে সুন্দর।

নয়াশতাব্দী/এমটি

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ