ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুমিনের দোয়া কখনো বিফলে যায় না

প্রকাশনার সময়: ১৭ আগস্ট ২০২৩, ১৬:৪১

কোনো ভয়াবহ বিপদে একমাত্র দৃঢ় কঠিন ঈমানের অধিকারী ও অসীম ধৈর্যশীল ব্যক্তি ছাড়া সাধারণ মানুষের মনের অবস্থা খুব দুর্বল হয়ে যায়। কখনও কখনও ঈমানের ভিত্তিও যেন নড়বড়ে হয়ে যায়। আর এটি একটি স্বাভাবিক বিষয় যে মাঝেমধ্যেই কঠিন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অনেকের ঈমান দুর্বল হয়ে যেতে পারে। যদিও এটি কারও ইচ্ছাকৃত না। তবুও যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে সবর ও তাওয়াক্কুলের মাধ্যমে এই ঈমানি দুর্বলতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য।

যেকোনো কঠিন বিপদের সময় কীভাবে টের পাওয়া যাবে যে আমাদের ঈমান দুর্বল হতে চলেছে! যখন বিপদে অত্যধিক ভয় পেয়ে দিশেহারা হয়ে বিপদ থেকে মুক্তিদাতা আল্লাহর কাছে যথাযথভাবে সাহায্য না চাওয়া হবে। মুমিনের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার দোয়ার ওপর যখন যথাযথ আস্থা থাকবে না। অথবা দৃঢ়ভাবে আস্থা না রেখে দোয়া করা হবে।

বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দোয়া নিয়ে লিখব লিখব করেও লিখা হচ্ছিল না। এ লেখাটিতে দোয়া সম্পর্কিত এমন কিছু ইনফরমেশন আপনাদের জন্য শেয়ার করব; যখন কোনো বিপদে আপনারা দোয়া করতে ভুলে যাবেন বা দোয়া করে ফল না পেয়ে মন খারাপ হবে তখন মনোযোগ দিয়ে লেখাটি পড়বেন। দোয়া সম্পর্কে আপনাদের বিশ্বাসের ভিত্তিটা আরও মজবুত হবে। আপনাদের বন্ধু/স্বজন কেউ যদি দোয়া নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন বা বিপদে মাত্রাতিরিক্ত দিশেহারা হয়ে পড়েন তাকেও লেখাটি পড়তে দিতে পারবেন। আশা করি মনে কিছুটা হলেও প্রশান্তি আসবে ইনশাআল্লাহ।

বিপদের সময় আসলে আমাদের অনেকের মনের অবস্থা অনেক নরম হয়ে যায়। কোনো কিছুতে ভরসা না পেয়ে অনেকে তখন বলে ফেলেন দোয়া করা ছাড়া আর কি-ই বা করব এখন! এখন আমাদের তো শুধু দোয়া-ই করে যেতে হবে!

হ্যাঁ, কথাটি ঠিক হলেও কথাটির প্রকাশ ভঙ্গিমা অনেকক্ষেত্রে-ই ঠিক থাকে না। কারণ কথাটি বলা হয় গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অথবা হালকাভাবে হতাশা নিয়ে। আর এটা-ই অনেকের দোয়া কবুল না হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর কাছে দোয়া কর কবুল হবে এই দৃঢ় প্রত্যয় রেখে। আর জেনে রেখ যে আল্লাহ উদাসীন ও অন্যমনস্কের হৃদয় থেকে দোয়া কবুল করেন না।’ (তিরমিজি : ৩৪৭৯)

অথচ আপনি কি জানেন দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে করা দোয়ার মাধ্যমে আমরা অনেক কিছুর পরির্বতন ঘটাতে পারি! এই ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই যে (বিপদ) নাজিল হওয়ার কথা ছিল, দোয়ার কারণে তা উঠিয়ে নেয়া হয়, যে (নিয়ামত) অবতীর্ণ হওয়ার কথা ছিল না, তা অবতীর্ণ করা হয়। হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা বেশি বেশি দোয়া কর।’ (সুনানে তিরমিজি)

প্রকৃতপক্ষে কোনো কিছুই আমাদের তাকদিরকে পরিবর্তন করতে পারবে না, একমাত্র দোয়া ব্যতীত। আপনি জেনে আশ্চর্য হবেন কোনো বিপদ আকাশ থেকে নাজিল হওয়ার আগে যদি দোয়া করা হয়ে থাকে, তবে দোয়া উপরের দিকে উঠতে থাকে এবং বিপদ নিচের দিকে নামতে থাকে। মাঝপথে তারা একে অন্যের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

বিপদ আর দোয়ার সংঘর্ষে বিজয় নির্ভর করে কে বেশি শক্তিশালী তার ওপর। দোয়া যদি কবুল হওয়ার মতো শক্তিশালী হয়, অর্থাৎ দোয়া যদি ইখলাস ও কবুলিয়াতের আশা নিয়ে করা হয় তবেই দোয়া বিজয়ী হয়। ফলে ওই বিপদ আর নাজিল হতে পারে না। সুবহানআল্লাহ!

পক্ষান্তরে অমনোযোগের সঙ্গে হতাশা নিয়ে করা দোয়া থেকে বিপদ শক্তিশালী হয়। তখন বিপদ দোয়াকে পরাজিত করে নিচে নেমে আসে। কখনও কখনও তারা সমানে সমান হলে কিয়ামত পর্যন্ত একে অন্যের সঙ্গে লড়তে থাকে।

তাই বিপদের আগেই বিপদ না হওয়ার জন্য বেশি বেশি দোয়া করা উচিত। আর দোয়াকে শক্তিশালী করার জন্য দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে দোয়া করতে হবে এটা ভেবে নিয়ে যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা দোয়া কবুল করবেন-ই।

বান্দার দোয়া আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে অনেক মূল্যবান। কারণ তিনি বান্দাদেরকে উনার কাছে দোয়া করতে বলেছেন। তিনি বান্দার ডাকে সাড়া দেন। বান্দাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে আর-রহমান লজ্জা বোধ করেন। তাই মুমিনদের জন্য দোয়া অত্যন্ত শক্তিশালী একটি হাতিয়ার। অথচ মহামূল্যবান এ হাতিয়ারের যথাযোগ্য মর্যাদা অনেকে অনুধাবন করতে পারেন না বলে এটি সঠিকভাবে খুব কম-ই ব্যবহৃত হয়। বান্দার দোয়া কবুল হওয়া প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেছিলেন, ‘যখনই কোনো মুসলিম পাপ ও আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্ন করা ছাড়া অন্য যে কোনো বিষয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, তখনই আল্লাহ তার প্রার্থনা পূরণ করে তাকে তিনটি বিষয়ের একটি দান করেন, ১. হয় তার প্রার্থিত বস্তুই তাকে দিয়ে দেন। ২. অথবা তার দোয়াকে (দোয়ার নেকি) তার আখিরাতের জন্য সঞ্চয় করে রাখেন। ৩. অথবা দোয়ার অনুরূপ পরিমাণ তার অন্য কোনো বিপদ তিনি দূর করে দেন।’ (সুনানে তিরমিজি) তাই দেখা যায় দোয়ার সুফল পাওয়া যাবেই কোনো না কোনোভাবে।

সঠিকভাবে দোয়া করা ছাড়া বিপদের সময় শুধু অত্যধিক টেনশন করলে কোনো ফল পাওয়া যায় না। আর দোয়ার বিষয়টা পুরোপুরি প্রাত্যহিক অভ্যাসের মতো করে ফেলতে হয়। একবার / দু’বার করলেই দোয়া কবুল হয়ে যাবে এ ভাবনা ঠিক নয়। এ সম্পর্কে ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেছেন, ‘একাগ্রচিত্তে দোয়া করা মানে আল্লাহর দুয়ারে কড়া নাড়া। আর যে-ই আল্লাহর দুয়ারে কড়া নাড়ে আল্লাহ তার জন্য দুয়ার খুলে দেন।’

তারিক মেহান্নাও এ নিয়ে সুন্দরভাবে লিখেছেন, ‘মনে রাখবেন ফুল ফুটবেই, কিন্তু সেটা এক রাতে না। দিনের পর দিন আপনাকে পানি দিয়েই যেতে হবে। অবশেষে এই ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করুন যে আপনার দোয়ার উত্তর আল্লাহ্র তৈরি প্রাকৃতিক নিয়মের কাঠামোর ভিতর থেকেই আসবে। এই কাঠামোর ভিতর যা ঘটে আল্লাহ সেটা নিয়ন্ত্রণ করেন এবং এই কাঠামোর মাধ্যমেই তিনি আপনার দোয়ার উত্তর দেন। আবারও বলছি, অবশ্যই অলৌকিক ঘটনা, কারামাহ ঘটে, কিন্তু সেগুলো হলো নিয়মের ব্যতিক্রম।

দোয়া কোনো প্যানিক বাটন নয়; যা মুহূর্তের মধ্যে কোনো সমস্যার অলৌকিক সমাধানের গ্যারান্টি দেবে। বরং এর জন্য প্রয়োজন সময় ও গভীরতা। এর জন্য দরকার অবিচলতা, অধ্যবসায়, ধৈর্য, পুনরাবৃত্তি এবং অন্তর্দৃষ্টি।’

আসলেই তো দোয়া কোনো ইন্সট্যান্ট বাটন নয় যে অন করলেই সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন পাওয়া যাবে। ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) তার ‘আদ-দা ওয়াদ-দাওয়া’ গ্রন্থে দোয়া সম্পর্কে আরও লিখেছেন, ‘দোয়াগুলো অস্ত্রের মতো। অস্ত্র কেবল ধারের ওপর নির্ভর করে না, চালনাকারীর ওপরও নির্ভর করে। যখন কোনো অস্ত্র যথাযথ ও ত্রুটিবিহীন হবে, অস্ত্রধারী হাতটাও দৃঢ় হবে এবং প্রতিবন্ধকতাও থাকবে না তখন শত্রুকে পরাভূত করা যাবে। আর এ তিনের কোনো একটির কমতি থাকলে প্রভাবও কমে যাবে।’

তাই দোয়ার শক্তি আর প্রভাব সম্পর্কে আমরা কখনই নিরাশ হতে পারি না, পারব না। ইমাম আশ-শাফিয়ী (রহ.) দোয়া নিয়ে আশা বহাল রাখতে বলেছেন, সেই সঙ্গে দোয়া নিয়ে কোনো ধরনের তুচ্ছতাচ্ছিল্য মনে স্থান দিতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা দোয়া নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করো, ফলে তোমাদের দোয়া বিফলে যায়! তোমরা জানো না দোয়ায় কী আছে! বরং শেষ রাতের দোয়া এমন এক তীর, যা কখনই লক্ষ্যচ্যুত হয় না।’

তাই বর্তমান ভয়াবহ কঠিন পরিস্থিতিতে আমাদের সবার উচিত বিনীতভাবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করে যাওয়া, তার সাহায্য চাওয়া। কেননা একমাত্র তিনিই পারবেন আমাদেরকে সবধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে। আর আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তার ওপর পরিপূর্ণ তাওয়াক্ক্বুল রেখে যারা দোয়া করে তাদের দোয়াই কবুল করতে আগ্রহী হন।

নয়া শতাব্দী/আরআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ