ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

কারবালার শোকাবহ ঘটনা

প্রকাশনার সময়: ২৯ জুলাই ২০২৩, ০৮:৩৬
ছবি : সংগৃহীত

সেদিন কী ঘটেছিল কারবালার প্রান্তরে? আর কেনইবা ঘটেছিল? কেন আমার প্রাণের কুটিরে নির্মাণ করেছি সেই তের শত বছর আগের শিশু আসগরের প্রতীকী মাজার। তবে শুনুন! সেই রঞ্জিত কাহিনির কিঞ্চিৎ বিবরণ।

ইতিহাস বলে, ইমাম হুসাইন (রা.) নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর প্রিয় দৌহিত্রই ছিলেন না, ছিলেন তাঁর আদর্শের প্রতীকও। আর সেজন্যই তিনি দুষ্কৃত ইয়াজিদের সঙ্গে আপস করেননি। বরং তার স্বৈরাচারি শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে দীনের ঝান্ডা হাতে নিয়ে প্রমাণ করে গেছেন ‘শির দেগা, নেহি দেগা আমামা’।

অর্থাৎ প্রয়োজনে জীবন দেব, শহীদ হবো। কিন্তু কোনো অযোগ্যের কাছে বা অনৈসলামিক নেতৃত্বের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করব না। তিনি ইসলামের জন্য সপরিবারে জীবন উৎসর্গ করে বিশ্ব মুসলিমকে শিখিয়ে গেলেন, অত্যাচারী যেই হোক, আর যতই শক্তিশালী হোক, তার কাছে মাথা নত করা চলবে না।

অথচ কিছু নামধারী মুসলমান এই শাশ্বত চেতনাকে মিথ্যা প্রমাণ করার হীন চেষ্টায় বলে থাকে যে হুসাইন (রা.) এর এই সিদ্ধান্ত নাকি ভুল ছিল। তিনি ক্ষমতার জন্যই নাকি কুফায় গমন করেছিলেন।

আর তার এই যাওয়াই নাকি ইসলামের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনে। (নাউজুবিল্লাহ)। অথচ এই শোহাদায়ে কারবালা ছিল সত্যের রক্ষাকবচ। তাই যারা এই সত্যকে মিথ্যা বলে ইতিহাসকে বিকৃত করতে চায়, নিঃসন্দেহে তারা ইয়াজিদের দোসর।

এ কথা তো দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, ইমাম হুসাইন (রা.) এর এই পদক্ষেপ ছিল মহান আল্লাহ তায়ালারই নির্দেশিত। আল্লাহ তায়ালা কি পবিত্র কোরআনে বলেননি?- ‘তোমাদের সৃষ্টিই করা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য। মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজ হতে নিষেধ করবে।’ (সুরা আলে ইমরান: ১১০) ইমাম হুসাইন (রা.) তো এই বিধানেরই বাস্তবায়ন করেছিলেন।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নরাধম ইয়াজিদ যখন ক্ষমতার জোরে সত্য-ন্যায়ের মসনদে চেপে বসেছিল, তখন সমাজ ছেয়ে গিয়েছিল অনাচারের বিষ বাষ্পে। ইয়াজিদ ভুলে গিয়েছিল তাকওয়া-তাহারাত। খোদাভীতি এবং ইবাদত। তার কার্যকলাপে কুফার লোকেরা অসন্তুষ্ট হয়ে ইমান হুসাইন (রা.) এর কাছে চিঠি পাঠিয়ে জানাল যে, তারা মুসলিম জাহানের ইমাম হিসেবে ইয়াজিদকে নয়, হুসাইন (রা.)-কেই চায়।

তাদের চিঠি পেয়ে ইমাম হুসাইন (রা.) কুফার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকীলকে (রা.) পাঠালেন। মুসলিম ইবনে আকিল (রহ.) কুফায় এসে দেখলেন ঘটনা সত্য। এখানকার অধিকাংশ লোকই হুসাইন (রা.) কে খলিফা হিসেবে চাচ্ছেন। তিনি ইমাম হুসাইন (রা.) কে দ্রুত সেই সংবাদ জানিয়ে দিলেন।

ইতিমধ্যে অনেকেই মুসলিম ইবনে আকিল (রহ.) এর হাতে ইমাম হুসাইন (রা.) এর পক্ষে বায়াত হতে শুরু করেন। মুনাফিক মারফৎ এই খবর ইয়াজিদের কাছে পৌঁছলে, সে কুফার গভর্নর নোমান বিন বাশির (যিনি মুসলিমের পক্ষে ছিলেন) কে বরখাস্ত করে তার জায়গায় উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে বসাল। আর বলে দিল, ‘তুমি বসরারও গভর্নর, পাশাপাশি কুফারও গভর্নর। অতএব, তুমি মুসলিমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ কর’।

ইবনে যিয়াদ ছিল ক্ষমতালোভী ও কঠোর প্রকৃতির লোক। সে কুফায় এসেই মুসলিম ইবনে আকিল (রহ.) এর হাতে বায়াত হওয়া অনুসারীদের থেকে নেতৃস্থানীয়দেরকে গ্রেপ্তার করা শুরু করে। এমতাবস্থায় মুসলিম ইবনে আকিল (রহ.) সকলের সঙ্গে পরামর্শ করে গভর্নর ভবন ঘেরাও করলেন। সেদিন অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তিনি ইশারা দিলেই গভর্নর ভবন ধুলিসাৎ হয়ে যেত।

অবস্থা বেগতিক দেখে চতুর যিয়াদ ফন্দি করে বন্দিদের বলে যে তোমরা গভর্নর ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে বলো, তারা যদি ঘেরাও প্রত্যাহার না করে, তবে তোমাদের জবাই করে হত্যা হবে। বন্দিরা প্রাণ বাঁচাতে তাই করল।

তাদের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই মুসলিম ইবনে আকিল (রহ.) এর হাতে বায়াত হওয়া ৪০ হাজার অনুসারী আলোর পথ ছেড়ে অন্ধকারে তলাতে লাগল। আর সুযোগ পেয়ে ইবনে যিয়াদ সত্যের বাহক মুসলিম ইবনে আকিল (রহ.) কে গ্রেপ্তার করে অত্যন্ত নির্মমভাবে শহীদ করে দিল। হায়রে কুফাবাসী! কি নিকৃষ্টতম ছিল তোমাদের সেদিনের বিশ্বাসঘাতকতা! তোমাদের মুনাফেকির কারণেই রচিত হলো কারবালা ইতিহাসের রক্তিম অধ্যায়।

এদিকে হুসাইন (রা.) তার স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়-স্বজন, এমনকি দুগ্ধপোষ্য শিশুসহ প্রায় ৭৩/৭৪ জনের একটি কাফেলা নিয়ে মক্কা শরিফ থেকে কুফার দিকে রওনা হন। মাঝপথে এসে চাচাত ভাই মুসলিম ইবনে আকিল (রহ.) এর শহীদ হওয়ার সংবাদ পেলেন। কিন্তু তিনি যে ভীরু নন।

তিনি তো আসাদুল্লাহিল গালিব, আলী ইবনে আবী তালিবের রক্ত। নবী মুহাম্মাদের আদর্শের রক্ষাকবচ। তাই তিনি ভয়ে পিছপা হলেন না। বরং বীর বিক্রমে সম্মুখে অগ্রসর হলেন। অতঃপর কুফা থেকে দু’মঞ্জিল দূরে কারবালা প্রান্তরে তাঁবু টানালেন। অসত্যের মূলোৎপাটনে সত্যের তলোয়ার ধরলেন।

ইয়াজিদ বাহিনীর মাথা কেটে কেটে লাশের স্তূপ বানিয়ে দিলেন। অপরদিকে শত্রুরা তার পবিত্র বদনে বৃষ্টির মতো তীর বর্শা নিক্ষেপ করতে থাকে। আঘাতে আঘাতে তিনি রক্তে রঞ্জিত হলেন। এক সময় আঘাত সহ্য করতে না পেরে ঘোড়া থেকে জমিনে পড়ে গেলেন। তখন নির্দয় সিমারের নির্দেশে জাহান্নামী সেনান ইবনে আনাস নখয়ী ইমাম হুসাইন (রা.) এর মাথা মোবারক শরীর মোবারক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল। আহা! কি হূদয়বিদারক ছিল ইমাম হুসাইন (রা.) এর সেই শাহাদাত। সেদিন যদি ইমাম হুসাইন (রা.) ইয়াজিদের বশ্যতা মেনে নিতেন, তাহলে তাকে জীবন দিতে হতো না।

পিপাসায় কাতর হয়ে মারা যেত না দুধের শিশুগুলোও। জাতীয় কবির ভাষায়- ‘গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা, আম্মা গো! পানি দাও, ফেটে গেল ছাতি, মা!’, সেদিন ইমাম হুসাইন (রা.) ইয়াজিদের বশ্যতা মেনে নিলে হয়তো তিনি ও তার পরিবার বেঁচে যেতেন। কিন্তু নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর দাঁতভাঙা দীনের কী হতো?

সেদিন যদি তিনি নীরবে সব মেনে নিতেন, তাহলে এই তের শত বছর পর এসে আমরা নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর রেখে যাওয়া এই অক্ষুণ্ন দীনকে পেতাম না। বহু আগেই তা কবর হয়ে যেত। আর পরবর্তীতে দুঃশাসকদের ব্যাপারে আমরাও হতাম নীরব সমর্থক। কেন না তখন তো আর আমাদের সামনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইমাম হুসাইন (রা.) এর দৃষ্টান্ত থাকত না। থাকত না মাথা উঁচু করার সাহস।

দহনে দহনে অঙ্গার হয়ে গেলেও আমাদের মনোভাব হতো, এটাই বুঝি অখণ্ডিত তাকদির। কিন্তু হুসাইন (রা.) তা হতে দেননি। তিনি বিশ্ব মুসলিমের জন্য এই শিক্ষাই রেখে গেলেন যে, অযোগ্য ও অসৎ ব্যক্তির অন্ধ আনুগত্য চলবে না। নীরবচারী হওয়া যাবে না।

বরং পুরো পৃথিবীও যদি অসত্যের পক্ষে নেয়, তবুও কিছু লোকের এমন হওয়া চায়, এ মিথ্যের মোকাবিলায় তারা পরোয়াহীনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এটাই ছিল মুসলিম জাহানের ইমাম হুসাইন (রা.) এর কারবালার শিক্ষা।

কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, বিশ্ব মুসলিম আজ ইমাম হুসাইন (রা.) এর এই শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। আর সেজন্যই পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে আজ মুসলিমদের হাহাকার। দীর্ঘ নি:শ্বাস।

লেখক: ইমাম ও খতিব, বাইতুল আমান জামে মসজিদ, বাঙ্গরা, কুমিল্লা

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ