ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

আশুরার প্রসঙ্গ-অপ্রসঙ্গ

প্রকাশনার সময়: ২৮ জুলাই ২০২৩, ০৭:৪৪
ছবি: সংগৃহীত

আশুরা অর্থ হলো ‘দশম’ বা ‘দশমী’। পরিভাষায় মহররমের দশম দিনটিকে আশুরা বলা হয়। কোরআন-হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী পুরো মহররমই মর্যাদাপূর্ণ। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হলো আল্লাহর মাস মহররমের রোজা।’ (মুসলিম: ১৯৮২)। কিন্তু পুরো মহররম মাসের মধ্যে আশুরার দিনটির রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। অনেকে মনে করেন আশুরা হুসাইন (রা.) এর কারবালার শাহাদাতবরণের কারণেই গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। এটি আশুরার ব্যাপারে ভুল ধারণা। হুসাইন (রা.) এর মর্মান্তিক শাহাদাত উম্মাহর জন্য অবশ্যই বেদনার কিন্তু আশুরা কারবালার কারণে নয় বরং সৃষ্টির সূচনা থেকেই সম্মানিত। আল্লাহর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফায়সালা হয়েছে এ দিনকে কেন্দ্র করে। নবীজি (সা.) এর আগমনের পূর্বে ইহুদিদের কাছে দিনটি জাতীয় মুক্তির দিবস হিসেবে পরিচিত ছিল। নবীজি (সা.)ও আশুরার মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়েছেন।

আশুরার গুরুত্ব আশুরার দিনটি বিভিন্ন কারণে অনেক আগে থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। এ দিনে মুসা (আ.) ফেরাউনের ওপর বিজয়ী হয়েছিলনে। ইহুদিরা দিনটিকে নিজেদের জাতীয় মুক্তির দিন হিসেবে পালন করত। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় এসে দেখেন, ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা পালন করছে। তিনি তাদের বললেন, এ দিনটির বিষয় কী যে তোমরা তাতে রোজা পালন কর? তারা বলল, এটি একটি মহান দিন। এ দিনে আল্লাহ মুসা (আ.) এবং তার জাতিকে পরিত্রাণ দিয়েছেন এবং ফেরাউন ও তার জাতিকে নিমজ্জিত করেন। এজন্য মুসা (আ.) কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এ দিনে রোজা পালন করেছিলেন তাই আমরাও এ দিনে রোজা পালন করি। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মুসা (আ.) এর বিষয়ে তো আমাদের অধিকার বেশি। এরপর তিনি এ দিবসে রোজা পালন করেন এবং (সাহাবিদের) রোজা পালনের নির্দেশ দেন। (বুখারি: ২/৮৬১)।

অন্য হাদিসে এসেছে, (মহাপ্লাবন শেষে) আশুরার দিনে নূহ (আ.) এর নৌকা জুদি পর্বতে স্থির হয়েছিল। তাই এর শুকরিয়া জানাতে নূহ (আ.) আশুরার দিনে রোজা রাখতেন। (আহমাদ: ৮৭১৭)

হুসাইন (রা.) কারবালায় শাহাদাত বরণ করেন ৬১ হিজরিতে। অথচ এ ঘটনারও অন্তত অর্ধশত বছর আগে রাসুলুল্লাহ (সা.) আশুরার রোজা রেখেছেন। যে উপলক্ষ্যে রোজা রেখেছেন তা সংঘটিত হয়েছে কারবালার ঘটনারও দুই সহস্রাধিক বছর আগে। আশুরার দিনে ইহুদিরা ঈদ পালন করত এবং রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে এ দিনের রোজা ফরজ ছিল।

নবীজি (সা.)ও হিজরতের পর নিজে আশুরার রোজা রেখেছেন, সাহাবিদের রোজার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজা ঐচ্ছিক করে দেয়া হয়। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘জাহিলিয়াতের যুগে কুরাইশরাও আশুরার রোজা পালন করত। হিজরতের পর নবীজি (সা.) সে দিনে রোজা রেখেছেন, সাহাবিদের রোজা রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর তা ঐচ্ছিক করে দিলেন।’ (বুখারি: ১৮৯৮)।

আশুরার আমল

কোরআন ও হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী আশুরার একমাত্র আমল রোজা। নবীজি (সা.) রমজানের রোজার পরই আশুরার রোজার গুরুত্ব দিয়েছেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আমি নবীজি (সা.)-কে রোজা রাখার ব্যাপারে এত অধিক আগ্রহী হতে দেখিনি যেমনটি আশুরার রোজা ও রমজান মাসের রোজার ব্যাপারে দেখেছি।’ (বুখারি: ১৮৬৭)।

নবীজি (সা.) আশুরার রোজায় গুরুত্ব প্রদানের কারণ হলো আশুরার রোজা এক বছরের গুনাহ ক্ষমার কারণ হয়ে যায়। (মুসলিম: ১৯৭৬)। তবে যেহেতু ইহুদিরা শুধু মহররমের দশম (আশুরা) দিনে রোজা রাখে তাই এর ব্যতিক্রম করার জন্য নবীজি (সা.) এর সঙ্গে তাসুআর (নবম) দিনে রোজা রাখার ইচ্ছে করেন। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেন, ‘যদি আমি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে মহররমের ১০ তারিখের (আশুরা) সঙ্গে নবম তারিখেও রোজা রাখব।’ (মুসলিম: ২৬৬২)।

তিনি সাহাবিদেরকেও ইহুদিদের রোজার মতো শুধু ১০ তারিখে রোজা না রেখে এর সঙ্গে একদিন বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা আশুরার রোজা রাখ এবং এক্ষেত্রে ইহুদিদের রোজার ব্যতিক্রম করো। তোমরা আশুরার সঙ্গে এর আগে একদিন অথবা দিন পরে একদিন রোজা রাখ।’ (আহমাদ: ২১৫৫)।

আশুরায় তাওবা কবুল করা হয় বলে একটি হাদিসে এসেছে। আলী (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে বসা ছিলাম, এক লোক রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করল, আপনি আমাকে কোন মাসে রোজা রাখার নির্দেশ দেন? উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তুমি যদি রমজানের পর আরও কোনো মাসে রোজা রাখতে চাও তাহলে মহররমে রাখ। কারণ তা আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন রয়েছে, যেদিন আল্লাহ অনেকের তাওবা কবুল করেছেন, ভবিষ্যতেও সেদিন আরও মানুষের তাওবা কবুল করবেন। (তিরমিজি: ৩/১০৮)।

আশুরা ও কারবালা সন্দেহ নেই যে মহানবী (সা.) এর আদরের দৌহিত্র হুসাইন (রা.) এর কারবালা প্রান্তরের শোকাবহ ঘটনা ইতিহাসের এক দুঃখজনক অধ্যায়। কিন্তু এও সত্য, কারবালা ট্র্যাজেডির হাজার বছর আগে থেকেই আশুরা মর্যাদার দিন হিসেবে অভিহিত হয়ে এসেছে। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিকই এ কথা বলেন, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে হুসাইন (রা.) এর শাহাদাত আশুরার দিনেই হয়েছিল।

নবীজি (সা.) এর ওফাতের ৫০ বছর পর ৬১ হিজরিতে ইরাকের কারবালা নামক স্থানে তিনি নির্মমভাবে শহীদ হন। তাই আশুরার দিনটি একদিকে যেমন ফেরাউনের বিপক্ষে মুসা (আ.) এর বিজয়ের দিন হিসেবে শুকরিয়া আদায়ের দিন অন্যদিকে ইসলামে শোক পালন জায়েজ হলে কারবালার ঘটনার ফলে দিনটি হতো শোকের দিন। কিন্তু ইসলামে তো কারও মৃত্যুতে তিন দিনের বেশি শোক পালনের বৈধতা নেই। এমনকি মহানবী (সা.) এর মৃত্যুতেও শোক পালনের বৈধতা দেয়নি ইসলাম। শরিয়তের বিধান প্রণেতা রাসুল (সা.) এ ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে বলে গেছেন। ‘যে মহিলা আল্লাহ ও পরকালের ওপর ঈমান রাখে, তার জন্য কারও মৃত্যুতে তিনদিনের বেশি শোক পালনের অনুমোদন নেই। তবে স্বামীর মৃত্যুতে চার মাস ১০ দিন শোক পালন করতে পারবে।’ (নাসায়ি: ৩৫০৩)।

তাজিয়া মিছিল আশুরাকেন্দ্রিক প্রচলিত তাজিয়া বানানোরও কোনো বৈধতা নেই। অভিধানে তাজিয়া অর্থ হলো বিপদগ্রস্ত লোককে সান্ত্বনা দেয়া। বর্তমানে তাজিয়া বলতে হুসাইন (রা.) এর কবরের মতো করে একটি কবর তৈরি করা, একে লাল চাদরে আবৃত করে তা নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে শোক পালন করা। এ ধরনের কৃত্রিম সমাধি তৈরি করা ইসলামী চেতনার সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। নবীজির ইন্তেকালের পর সাহাবিরা এমনটি করেননি। কোনো তাবেয়িও এমনটি করেননি।

কারও মৃত্যুতে বিলাপ বা মাতম করা আশুরা বা অন্য কোনো দিনে যে কারও মৃত্যুতেই বিলাপ বা মাতম করে শোক পালন সম্পূর্ণ হারাম। নবীজি (সা.) মাতম করাকে জাহিলিয়াতের নিন্দনীয় স্বভাব হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মাতম করা কুফরির সমতুল্য অন্যায়। নবীজি (সা.) বলেন, ‘মানুষের মধ্যে দুটি চরিত্র কুফরির পর্যায়ের। একটি হলো বংশ মর্যাদায় আঘাত হানা আর অপরটি হলো কোনো মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে বিলাপ করা।’ (মুসলিম: ৬৭)।

তাই তো যে ব্যক্তি এমন করে তাকে নবীজির উম্মতের বাইরের লোক হিসেবে অভিহিত করেছেন। ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি গালে থাপ্পড় মারে, পকেট ছিড়ে ফেলে ও জাহিলিয়াতের রীতি-নীতির প্রতি আহ্বান করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (বুখারি: ১২৯৪)।

মাতমকারীর ওপর লা’নত বর্ষিত হয়। আবু উমামা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মুখমণ্ডল ক্ষত-বিক্ষতকারী, পকেট বিদীর্ণকারী এবং দুর্ভোগ ও ধ্বংস প্রার্থনাকারীর ওপর লা’নত করেছেন।’ (ইবনে মাজা: ১৫৮৫)।

এমন ব্যক্তি যে কি-না কারও মৃত্যুতে মাতম করেছে সে যদি তার এ কাজের জন্য আল্লাহর কাছে তাওবা না করে মারা যায় তাহলে পরকালে তাকে ভয়াবহ শাস্তি ভোগ করতে হবে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মাতমকারিনী মৃত্যুর পূর্বে তাওবা না করলে কিয়ামতের দিন তাকে আলকাতরার পাজামা ও খোস-পাঁচড়ার ঢাল পরিহিতা অবস্থায় দাঁড় করানো হবে।’ (মুসলিম: ৯৩৪)।

তাই আমাদের উচিত আশুরার দিনে এবং এর আগে কিংবা পরে একদিন রোজা রাখা। আশুরার দিনে শোক পালনের অন্যায় পদ্ধতি বর্জন করে হুসাইন (রা.) যেমন সত্য, ন্যায় ও ইসলামের পক্ষে জীবন দিয়ে জীবনের চেয়ে ইসলামকে বেশি মূল্যবান বলে প্রমাণ দিয়েছেন তেমনি আমাদেরও উচিত ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে নিজেদের উৎসর্গ করা।

লেখক : প্রিন্সিপাল, বাইতুল হিকমাহ একাডেমি, গাজীপুর

নয়া শতাব্দী/এফআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ