ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

সুদের অভিশপ্ত দুষ্টচক্র

প্রকাশনার সময়: ২২ জুলাই ২০২৩, ০৮:১৮
ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে অর্থবছরের শেষ মাস জুন। জুলাই থেকে জুন অর্থবছর গণনা হয়। স্বাভাবিক কারণেই প্রতি জুনে জাতীয় বাজেট পেশ করা হয় এবং পহেলা জুলাই থেকে তা কার্যকর হয়। গেল জুন মাসেও জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার এ বাজেট পেশ করেছেন গত পহেলা জুন।

অর্থাৎ বাংলাদেশ সরকার আগামী অর্থবছরে সাড়ে সাত লাখ কোটি টাকার বেশি খরচ করবে। তার মধ্যে পরিচালনা বা অনুন্নয়ন খরচ প্রায় পাঁচ লাখ কোটি টাকা (৪৮৪২০৩)। উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে দুই লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা।

অন্যদিকে এ বিশাল ব্যয় মেটানোর জন্য আগামী বছর সরকার জনগণ থেকে কর বা রাজস্ব আহরণের প্রাক্কলন করেছে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। অবশিষ্ট দুই লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা ঘাটতি বাজেট। অর্থাৎ মোট বাজেটের মধ্যে যত টাকা সরকার আয় করার প্রাক্কলন করেছে সে পরিমাণ টাকার অর্ধেকেরও বেশি বাজেট ঘাটতি রয়েছে। যা ব্যাংক ঋণ ও বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে পূরণ করার চিন্তা করেছেন অর্থমন্ত্রী।

অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার পরের দিন জাতীয় দৈনিকগুলোয় এ নিয়ে বড় বড় প্রতিবেদন ছেপে থাকে। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদের মতামতও প্রকাশিত হয়ে থাকে পত্রিকাগুলোতে। প্রথমে এমন কয়েকটি প্রতিবেদনের শিরোনামের দিকে লক্ষ করা যেতে পারে।

একটি পত্রিকা মূল শিরোনাম করেছে, ‘অর্থনৈতিক অস্বস্তি আড়াল করে ‘কল্পবিলাসী’ বাজেট।’ আরেকটি শিরোনাম, ‘বাস্তবতা কম, স্বস্তির চেয়ে চাপ বেশি।’ আরেকটি পত্রিকা লিখেছে, ‘লক্ষ্য উচ্চাভিলাষী, বাস্তবায়ন দুরূহ।’ অন্য আরেকটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম, ‘স্মার্ট না বেহাল অর্থনীতির সূচনা।’

বিশেষজ্ঞদের কয়েকটি মন্তব্য ছিল এমন, জনগণের দুঃখ কষ্ট আরও বাড়বে। মূল্যস্ফীতি হ্রাসে বাজেটে সুনির্দিষ্ট কিছু নেই। সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেয় এমন কিছু নেই। এর চেয়ে বড় গোঁজামিল আর হতে পারে না। এ ধরণের হরেক প্রকারের মতামত।

আসলে বিগত কয়েক বছর থেকে এ দেশের বাজেট এত বেশি গতানুগতিক হয়ে গেছে যে এ নিয়ে গণমানুষের আগ্রহ একেবারেই কমে গেছে। মানুষ জেনে গেছে, বাজেট মানেই সরকারের লাখ লাখ কোটি টাকার খরচের হিসাব-নিকাশ। বাজেটের অর্থই হলো, আম জনতার উপরে করের বোঝা চাপানো।

বাজেট মানেই কল্পনাপ্রসূত ও হিসাব-নিকাশের জাদুকরী উন্নয়নের গালগল্প। তাই আগের সময়ে যেমন বাজেট বক্তৃতার তারিখে মানুষ আগ্রহ নিয়ে রেডিও-টেলিভিশনের সামনে বসে পড়ত এখন আর সে দৃশ্য পরিলক্ষিত হয় না। এবারের বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয় কিছু বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করা হয়েছে। দৃশ্যত এটি ইতিবাচক হলেও তা ফিকে হয়ে গেছে টিনধারীদেরকে রিটার্নের সঙ্গে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা বাধ্যতামূলক করায়।

আরেকটি কথা হচ্ছে, আসলেই কি বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তি করমুক্ত? সরকারের সবচেয়ে বড় রাজস্ব খাত ভ্যাট। এবারের বাজেটেও সে খাত থেকে সবচেয়ে বেশি আয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে। সে ভ্যাট কি শুধু ধনিকশ্রেণির? সেটি তো দরিদ্র এমনকি হতদরিদ্রকেও দিতে হয়। এমনকি পরনির্ভরশীল ব্যক্তি ভিক্ষুকদেরও দিতে হয়। অর্থাৎ করমুক্ত আয়সীমা বাক্যটির মধ্যেও ফাঁক রয়েছে।

বাজেট নিয়ে মন্তব্যকারী বিশিষ্টজনদের প্রায় সকলেই বলেছেন, এই বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কোনো পদক্ষেপ নেই। অথচ অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশে আটকে রাখার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বাজেট বক্তৃতায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বেহাল অবস্থায় পড়া নাগরিকদের আরও দুর্গতিতে পড়তে হবে বোঝাই যাচ্ছে।

বিগত বেশ কয়েক বছর থেকেই একটি দলের সরকারই বাজেট পেশ করে আসছে। আর গাণিতিক হারে বাড়ছে বাজেটের আকার। বাস্তবে যত টাকা সরকার জনগণ থেকে কর বাবদ নিয়ে থাকে, তার চেয়ে আরও বেশ বড় আকারে খরচ করে থাকে প্রতি বছর। যার দরুন সরকারের ঋণ বাড়ছে প্রতিনিয়ত। সে ঋণের মোটা অংকের সুদও আদায় করতে হচ্ছে। আবার সে সুদ আদায়ের জন্য করতে হচ্ছে ঋণ। অর্থাৎ ঋণের জন্য সুদ আবার সুদের জন্য ঋণ। এ যেন এক বিশাল ফাঁদ। এভাবেই বাড়ছে সুদের আকার।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার অনুন্নয়ন তথা পরিচালনা ব্যয়ের সবচেয়ে বড় খরচটিও করবে এই সুদ পরিশোধেই। এ খাতের মোট টাকা সাড়ে ১৯ শতাংশ। তথা ৯৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা শুধু সুদ আদায়েই খরচ করা হবে। এই সুদ পরিশোধ করতে হয় দেশি ব্যাংকগুলোকে এবং বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে।

যাদের কাছ থেকে সরকার প্রতি বছর মোটা অংকের ঋণ নিয়ে থাকে। এ ধরনের ঋণের সুদ ও কিস্তি আদায়ে ব্যর্থ হয়েই বিভিন্ন দেশ দেউলিয়া হচ্ছে। আলোচিত অর্থবছরেও সরকারের কাঙ্ক্ষিত বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এক লাখ দুই হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।

একটি মুসলিম রাষ্ট্রের জন্য এর চেয়ে বড় দুঃখজনক ও হতাশার বিষয় আর কী হতে পারে যে তাদের থেকে নেয়া প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ করের টাকায় সরকার সবচেয়ে বেশি খরচ করছে সুদ পরিশোধে; যে সুদ ইসলামে কঠোরভাবে হারাম। পবিত্র কোরআনের সুস্পষ্ট ঘোষণা অনুযায়ী সুদ শুধু অধঃপতনই ডেকে আনে। আজকের বিশ্ব অর্থনীতির দিকে আমরা নজর দিলে সে ঘোষণার বাস্তবতাই দেখতে পাব।

জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নত থেকে উন্নততর (!) অবস্থায় পৌঁছে যাওয়া পৃথিবীর চারদিকে এত অর্থনৈতিক শঙ্কা কেন? কেন আমেরিকার মতো সুপার পাওয়ার দেউলিয়া হওয়ার দৌড়গোড়ায় পৌঁছে যায়। কেন চারদিকে মন্দা মন্দা ধ্বনি? মুসলমানদের এবং মুসলিম শাসকদের বোঝার সময় এসেছে।

অন্যদের পথে হেঁটে সুদভিত্তিক অর্থনীতিতে চলে কখনো তাদের সাফল্য আসবে না। বরং তা শুধু বিপর্যয় ডেকে আনবে। এদেশে অধিকাংশ সাধারণ মুসলিম জনতা ক্ষুধায়-কষ্টে থাকলেও সুদকে তারা অন্তর থেকে ঘৃণা করে। সযত্নে এড়িয়ে চলে। অথচ তাদের থেকে নেওয়া ভ্যাট এবং আয়করের টাকার বিশাল অংশই খরচ হয় সুদ পরিশোধে। এর চেয়ে বেশি পরিতাপের বিষয় আর কী হতে পারে?

বাজেট নিয়ে বললে তো আরও অনেক বিষয়ই রয়েছে। কিন্তু কে শুনবে কার কথা। বিভিন্ন কাগজে বিভিন্ন বছরে বাজেট নিয়ে লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম শাসকদের সুমতি দিন। অন্যদের ধ্বংসাত্মক পথ থেকে বেরিয়ে এসে ন্যায়সঙ্গত সুষম ও সুদমুক্ত অর্থনীতি গড়ে তোলার তাওফিক দান করুন।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ