ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ রক্ষা ও আল কোরআন

প্রকাশনার সময়: ০৪ জুলাই ২০২৩, ১১:৪৮

বিশ্বজুড়ে যে উদ্ভিদ প্রজাতি রয়েছে, তার বংশ বিস্তার পদ্ধতির প্রতি আমরা মনোনিবেশ করলে দেখতে পাব, এই উদ্ভিদ কীভাবে বিশ্বে প্রাণিকুলের জীবনপ্রবাহে ভূমিকা রেখে চলেছে। উদ্ভিদের ওপর গবেষণা করে বহুসংখ্যক তথ্য পাওয়া গেছে। উদ্ভিদ বংশ বিস্তার পদ্ধতিতে মূল উদ্ভিদের কোনো অংশ নতুন উদ্ভিদের উদ্ভাবন ঘটায়, তা আমরা অবহিত হতে পারি। অযৌন বংশ বিস্তার পদ্ধতি কেবল নিম্নশ্রেণির উদ্ভিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যা মূল উদ্ভিদ দেহের বিশেষ কোষকলাকে একটি নতুন বৃক্ষ জন্মানোর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। এ উভয় ধরনের নীচু শ্রেণির সীমিত সংখ্যক উদ্ভিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। উচ্চ শ্রেণির আড়াই লাখ প্রজাতির উদ্ভিদ বংশ বিস্তারে যৌন প্রক্রিয়া অবলম্বন করে থাকে।

এ প্রক্রিয়ায় প্রকৃতিতে যে অদ্ভুত নিয়ম-কানুন পরিলক্ষিত হয়, তা একদিকে যেমন সুদৃঢ় তেমনি জটিল এবং চিত্তাকর্ষক। অথচ পুরো ব্যাপারটিকে একটি অনিশ্চয়তার মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। এ অনিশ্চয়তা থেকে উদ্ভূত সুনিশ্চয়তার প্রক্রিয়ায় সামান্যতম ব্যতিক্রম বা পরিবর্তন ঘটলে প্রকৃতি মারাত্মক অস্তিত্বের ঝুঁকির সম্মুখীন হয়ে পড়তে পারে। এমনকি এ অবস্থায় কোনো কোনো প্রজাতি চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াও অসম্ভব কিছু নয়।

উদ্ভিদের বংশ বিস্তারের প্রধান সাহায্য আসে বাতাস, কীট-পতঙ্গ, পাখি ও পানি থেকে। ফুলের পরিণত পুংকেশর লাখ লাখ পরাগরেণুকে উপযুক্ত করে রাখে। এ পরাগরেণু কেবল সঠিকভাবে গর্ভকেশরে প্রতিস্থাপিত হলেই নিষিক্তকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে এবং ভবিষ্যতের বংশবিস্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত হতে পারে। এর জন্য চাই একসঙ্গে অনেক কিছুর সমন্বয়, যে সমন্বয়ের বিষয়ে আমরা অনেক কিছু জানি না বিধায় বিষয়টি আমাদের তত মনোযোগ আকর্ষণ করে না। পুংকেশরের লাখ লাখ পরাগরেণু সৃষ্টি হয়ে অবাধভাবে কোনো মাধ্যমে, বিশেষত বাতাসে প্রবেশ করে। এই লাখ লাখ পরাগরেণু থেকে হয়তো মাত্র ১-২টি ফুলের গর্ভকেশরে প্রতিস্থাপিত হয়ে নিষিক্ত হওয়ার সুযোগ পায়, বাকিরা ধ্বংস হয়ে যায়। অথচ এই লাখ লাখ পরাগরেণু সৃষ্টি না হলে, যে একটি নিষিক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে তা সম্ভব হতো না।

সমন্বয়ের ব্যাপারটি এখন পর্যালোচনা করা যাক। যে সময় পরাগরেণু পরিপক্ব হবে, ঠিক সেই সময় গর্ভকেশরের দেহ থেকে আঠালো পদার্থ বের করে তার অঙ্গটিকে আঠালো করে রাখবে। সেই সময় আবার বাতাস প্রবাহের জন্য সূর্যকে তার তেজোদীপ্ত আলো দিয়ে পৃথিবীর কোনো স্থানে বায়ুর শূন্যতা সৃষ্টি করতে হবে। সেই শূন্যতা পুরণ করবে বায়ু-প্রবাহ। অর্থাৎ শত শত মাইল দূরে কোনো সমুদ্রে সৃষ্ট নিম্নচাপটি তার প্রান্তিক প্রভাবমণ্ডল যে ধীরগতির বাতাসের সৃষ্টি করেছে, যে প্রবাহটি আমাদের অজ্ঞাতে পৃথিবীপৃষ্ঠের যাবতীয় ফুলের পরাগরেণু তুলে নিয়ে অন্য ফুলের গর্ভকেশরে প্রতিস্থাপন করে চলেছে। ফুল, বাতাসের এ ছোঁয়াটুকু না পেলে লাখ লাখ উদ্ভিদ হয়তো বঞ্চিত থেকে যেত গর্ভধারণ সঞ্চালন প্রক্রিয়া থেকে। গর্ভধারণ না হলে জন্মাত না লাখ লাখ নতুন উদ্ভিদ। প্রকৃতির খাদ্য ভান্ডার এ উদ্ভিদের ফলন থেকে বঞ্চিত হলে জীবজগতের মজুদে টান পড়ত। এতে জীব জগতের অস্তিত্ব বজায় রাখাই দুরূহ হয়ে পড়ত। অতএব, বলা যায় যে, ক্ষতিকর এ নিম্নচাপটি আমাদের অজান্তেই কত সুষ্ঠুভাবে জীবজগত তথা পৃথিবীর জীবনমণ্ডলকে নিয়ত সাহায্য করে যাচ্ছে। নিম্নচাপের এমনি উপযোগীর উদাহরণ আল্লাহর বাণীশৈলীর সঙ্গে একেবারে মিলে যাচ্ছে। আমরা বিমুগ্ধ চিত্তে উচ্চারণ করতে বাধ্য হই : ‘হে আমাদের রব। আপনি কোনো কিছুই অনর্থক সৃষ্টি করেননি। আপনি মহান, পবিত্র। অতঃপর আপনি আমাদের আগুনের আজাব থেকে বাঁচান।’ [সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৯১]

উদ্ভিদের বংশবিস্তারের প্রক্রিয়ায় সমন্বয়ের কথা বলা হচ্ছিল। বিভিন্ন ফুলে রয়েছে বিভিন্ন স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণ। কোনো কোনো ফুলের বর্ণের চেয়ে গন্ধ তীব্র, কোনোটির রঙের চেয়ে সাজে অতুলনীয়। কীটপতঙ্গরা বিভিন্ন ফুলের বিভিন্ন বিশেষত্বে আকৃষ্ট হয়ে থাকে। ফুলে ফুলে তারা ঘুরে বেড়ায় ক্ষুধা নিবারণের জন্যে অথবা আশ্রয়ের সন্ধানে ও ডিম ফোটানোর প্রয়োজনে। ফুলে আগত কীটপতঙ্গ তাদের অজান্তে পা ও পাখায় মেখে নেয় পরাগরেণু। তারপর স্বভাবজাত তাগিদে ও প্রয়োজনে ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায়। তাদের এ ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ানোর স্বভাবটি কত অমূল্য ফলই না বয়ে আনে পৃথিবীতে। কীট-পতঙ্গসমূহের ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ানোর কারণে কোনো এক জাতির ফুলের পরাগ অন্য অতি কাছাকাছি প্রজাতির ফুলের গর্ভকেশরে সার্থকভাবে প্রতিস্থাপিত হলেও বংশ রূপান্তরে তিল পরিমাণও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। ‘প্রাকৃতিক ও মানবীয় নির্বাচনী প্রক্রিয়া সারা জলবায়ু ও পারিপার্শ্বিকতা পরিবর্তন অথবা জৈব-শুক্র দ্বারা উপর্যুপরি আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও সব যুগের উদ্ভিদের কোনো পরিবর্তন হয় না বা একই এবং অপরিবর্তনীয় থাকে।’ এ আবিষ্কারে যেন আল্লাহর কথাটির প্রমাণিত হলো : আল্লাহর সৃষ্টিতে কোনো পরিবর্তন নেই।’ [সুরা আর-রূম, আয়াত : ৩০]

এ প্রক্রিয়াটি সৃষ্টির প্রথম থেকেই চলে আসছে। ‘আল্লাহর বিধানে কোনোরূপ পরিবর্তন দেখতে পাবে না।’ [সুরা আল-ফাতাহ, আয়াত : ২৩]

বিবর্তনবাদের অসারতার প্রতি নিশ্চয় এটা কটাক্ষ। ফরাসি উদ্ভিদবিদ দ্য জাসিয়া তার প্রজাতি সম্পর্কিত গবেষণায় দাবি করেন যে ‘এটি (প্রজাতি) প্রজনন দ্বারা চিরস্থায়ী একই রকম উদ্ভিদের বহু বর্ষজীবী পরপর অনুগমন মাত্র।’ এতে বিজ্ঞানের আবিষ্কার আর কোরআনের বাণীতে কোনো পার্থক্য নেই তা-ই প্রমাণিত হলো।

এতে আমাদের চোখে যে সত্যটি ধরা পড়ে তা হলো, একটি ফুলের পরাগ পৌঁছানোর জন্য সমন্বয়ের ব্যাপারটি এত সুবিশাল এবং এত ব্যাপক যে, ভাবলে স্তম্ভিত হতে হয়। ফুলের স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ, সুর্যের তেজ, সমুদ্র, বাতাস, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি অসংখ্য জ্ঞাত অজ্ঞাত বিষয়গুলো যখন একসঙ্গে সমন্বিত হয়, তখনই কেবল একটি ফুলের গর্ভকেশরে গর্ভধারণের গৌরব অর্জন করে এবং জীব জাতি বেঁচে থাকার সনদপ্রাপ্ত হয়। সব কিছু মিলিয়ে চিত্তাকর্ষক অনুভূতি জাগানোর মতো বিস্ময়কর ও নিদর্শনমূলক এসব রহস্যের দাবি নিয়েই বুঝি কোরআন ঘোষণা করল : ‘আর দৃঢ়-বিশ্বাসীদের জন্য পৃথিবীতে রয়েছে বহু নিদর্শন।’ [সুরা আয-যারিয়াত, আয়াত : ২০]

অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে : ‘যারা স্মরণ করে তাদের জন্য আমরা নিদর্শনসমূহ সবিস্তারে ব্যক্ত করেছি।’ [সুরা আল-আন’আম, আয়াত : ১২৬]

এখন আমরা প্রকৃতির ভারসাম্যের বিষয়টি লক্ষ্য করে দেখব। বর্তমান পৃথিবীর শিক্ষিত লোকেরা ইকোলজি কথাটির সঙ্গে পরিচিত। বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য দূষণ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা আজ শঙ্কিত। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার প্রতি নজর না দিয়ে, বৃক্ষ নিধনে মানুষের সীমালঙ্ঘন মরুকরণ প্রকোপের মাত্রা বৃদ্ধি করে দেয়, যা আজ পৃথিবীর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবিকা, চাষাবাদ, নির্মাণ ইত্যাদি নানাবিধ অজুহাতে গাছপালা নিধন করা হচ্ছে নির্বিচারে। মানুষ প্রয়োজনাতিরিক্ত ভোগ-বিলাসের প্রয়োজনে অতিরিক্ত বন নিধনের কারণেই আজ সারা বিশ্বে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ঝড়, বন্যা-খরা, সাইক্লোন, টর্নেডো ইত্যাদি আজ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং ফসলাদির মারাত্মক ক্ষতি হওয়ায় বিশ্বে আজ খাদ্যে টান পড়েছে। মানুষ কর্তৃক প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করার জন্যই আজ এ বেহাল অবস্থা। প্রকৃতিতে বনবাদাড়, পাহাড় পর্বত, নিবিড় জঙ্গল ইত্যাদি যদি না থাকত, তবে সমস্ত পৃথিবীতে অক্সিজেনের যে ঘাটতি হতো তাতে জীবজগতের বেঁচে থাকাই দুরূহ হয়ে পড়ত।

একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে যে, এমন বহু বনবাদাড় রয়েছে যা, দুর্গম পাহাড়-পর্বত, নদী, সাগর ও অন্যান্য প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা দ্বারা মানুষের সহজ গমনের বাইরে ফেলে রাখা হয়েছে। উপরন্তু তার মধ্যে হিংস্র জন্তুর আবাসস্থল করা হয়েছে, যাতে মানুষ তার ক্ষতি না করতে পারে। এদের ভয়সংকুলতা ও প্রাকৃতিক দুর্গমতা না থাকলে লোভী মানুষ ইতোমধ্যেই এ পৃথিবীকে জীবজগতের বাঁচার অযোগ্য করে ফেলত। বিষয়টি যুক্তি ও প্রমাণভিত্তিক বিচার-বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে, দূরদূরান্তের গহীন অরণ্যে প্রকৃতির বন্যতায় লালিত প্রাণসংহারক জীবজন্তুসমূহ, প্রাকৃতিক দুর্লংঘতা ইত্যাদি সবই মূলত জীবমণ্ডলের সেবার কাজে নিয়োজিত। সমস্ত জীবমণ্ডল ও উদ্ভিদকুল মূলত মানুষের কল্যাণ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

‘তোমরা কী লক্ষ্য কর না, যে আল্লাহ তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করে দিয়েছেন যা কিছু আছে আসমান ও জমিনে?’ [সুরা লোকমান, আয়াত : ২০]

পৃথিবীর পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য আল্লাহ কী নিপুণতায় তাকে সাজিয়েছেন বিবিধ বস্তু দিয়ে। জীবজগতের বসবাসের জন্য যেখানে যা প্রয়োজন, সেখানে ঠিক সেই জিনিসটি সমপরিমাণে দান করেছেন। তার একটু হেরফের হলে জীবজগতের বেঁচে থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়ত। তাই আল্লাহর অসীম কুদরতের কথা ভেবে জ্ঞানী ও বিজ্ঞানীরা তাদের মাথা নত করে দেন তাঁর সম্মুখে।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ