বিবি হাজেরা ছিলেন হজরত ইবরাহিমের (আ.) সহধর্মিণী এবং ইসমাইলের (আ.) মাতা। তাঁর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে অসীম ত্যাগ ও কঠিন কঠিন পরীক্ষার স্তূপ। চরম দারিদ্র্য, নিঃসঙ্গতা এবং বিপদাপদে জর্জরিত থেকেও আল্লাহর প্রতি তাঁর বিশ্বাস ও ভরসা ছিল অকল্পনীয়। একজন নারী কতটা সাহসী ও স্রষ্টানির্ভর হতে পারে তা আমরা জানতে পারি বিবি হাজেরার জীবনী থেকে। আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস, অপরিসীম ধৈর্য ও সীমাহীন ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ইতিহাসে তিনি স্মরণীয়, বরণীয় হয়ে আছেন। মক্কানগরীর প্রতিষ্ঠা, জমজম কূপ, সাফা-মারওয়া পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ি, মিনা ময়দানে পশু কোরবানি, জমরায় শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ এসব কিছুতেই রয়েছে বিবি হাজেরা (রা.) এর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অবদান। তাকে বাদ দিয়ে হজ ও কোরবানির ইতিহাস অসম্পূর্ণ। তাই ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে এই মহীয়সীর নাম।
সংক্ষিপ্ত পরিচয়
হাজেরা শব্দের অর্থ হিজরতকারিণী। তিনি ইবরাহিমের (আ.) জীবনসঙ্গিনী হয়ে জন্মভূমি মিসর ত্যাগ করেছিলেন বিধায় হাজেরা নামে অভিহিত হন। তিনি ছিলেন মিসর অধিপতির কন্যা। সম্রাট তাকে ইবরাহিমের (আ.) বড় স্ত্রী সারার খেদমতের জন্য উপহার দিয়েছিল। এ মর্মে সহিহ বোখারিতে বর্ণিত হয়েছে, ‘একবার হজরত ইবরাহিম (আ.) মিসর হয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। তাঁর স্ত্রী সারা (আ.) ছিলেন পরমা সুন্দরী। মিসরে পৌঁছে তিনি কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন। সেখানকার রাজা ছিল অত্যন্ত জালেম ও নারীলোভী। ইবরাহিম (আ.) ধৃত হয়ে রাজার দরবারে উপনীত হন। রাত্রিকালে লম্পট রাজা অসৎ উদ্দেশ্যে চরিতার্থ করার জন্য বিবি সারার প্রতি অগ্রসর হলে তার হাত-পা অবশ হয়ে যায়। কোনো ক্রমেই সে নবীপত্নীর দেহ স্পর্শ করতে সক্ষম হলো না। রাজা সারা (আ.) এর কাছে ক্ষমা চেয়ে তার সুস্থতার জন্য দোয়া করতে বলল। তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করলে সে সুস্থতা লাভ করে। কিন্তু চরিত্রহীন রাজা পুনরায় তাঁর প্রতি ধাবিত হতে চাইল। এবারও পক্ষাঘাতের শিকার হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করল। এভাবে কয়েকবার প্রচেষ্টার পর অবশেষে রাজা ভরকে গেল। বারবার তার পক্ষাঘাত হওয়াকে বিবি সারার কারামত ভেবে তাঁকে মুক্ত করে দিল। সঙ্গে বহু উপঢৌকন প্রদান করল এবং তাঁর খেদমতের জন্য বিবি হাজেরা (আ.) কে দান করলো। হাদিসটি বর্ণনা করে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘হে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী আরববাসী! ইনিই তোমাদের মাতা হাজেরা (আ.)। (বোখারি: ৩১৭৯)
নির্বাসন জীবন
হজরত ইবরাহিম (আ.) তখন পর্যন্ত নিঃসন্তান ছিলেন। একদা তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন, ‘হে প্রতিপালক, আমাকে একটি নেক সন্তান দান করো।’ আল্লাহতায়ালা বিবি হাজেরার গর্ভ থেকে সন্তান মঞ্জুর করেন। একদিন ফেরেশতা এসে হাজেরা (আ.) কে বললো, ‘তুমি একটি পুত্র সন্তান প্রসব করবে। তার নাম রাখবে ইসমাইল।’ বর্ণিত আছে, ইসমাইল (আ.) এর জন্মের সময় ইবরাহিম (আ.) এর বয়স ছিল ৮৬ বছর।
ইসমাইলের জন্ম বিবি সারার জন্য অত্যন্ত মনোকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। তিনি মানবসুলব প্রকৃতি তাড়নায় মা হাজেরার প্রতি ঈর্ষান্বিত হলেন এবং তাকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করতে লাগলেন। তিনি ইবরাহিম (আ.) কে পরিষ্কার বলে দিলেন, ‘হাজেরা এবং তার শিশুপুত্র যেন আমার সম্মুখে না থাকে। এদের দূরে কোথাও দিয়ে আসা হোক।’ প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখ থেকে এরকম কথা শুনে আল্লাহর পয়গম্বর খুবই মর্মাহত হলেন। কিন্তু আল্লাহর তরফ থেকে নির্দেশ এলো, ‘সারার কথা মেনে নাও।’ সে মতে তিনি শিশু ইসমাইল ও হাজেরা (আ.)-কে নিয়ে রওনা করেন। সঙ্গে জিবরাইল (আ.) গাইড হিসেবে ছিলেন। পথিমধ্যে কোনো শস্যশ্যামল বনানী দৃষ্টিগোচর হলে তিনি বলতেন, এখানেই অবস্থান করানো হোক। কিন্তু জিবরাইল (আ.) বলতেন, এখানে অবস্থানের নির্দেশ নেই। অবশেষে জনশূন্য, তৃর্ণলতাহীন, উত্তপ্ত বালুকাময় প্রান্তরে পৌঁছে তাদের থামিয়ে দেয়া হলো। সেখানে বসবাস শুরু করতে না করতেই হাজেরা ও ইসমাইলকে এখানে রেখে সিরিয়ায় ফিরে যাওয়ার নির্দেশ পেলেন। চারদিকে ধূসর, ধূধূ প্রান্তর, চাষাবাদহীন, সবুজ-শ্যামলতার আমেজবিহীন, জনশূন্য মরুভূমিতে নিঃস্ব অবস্থায় একজন অবলা নারী ও দুধের শিশুকে ফেলে আসা নিঃসন্দেহে আল্লাহপাকের এক কঠিন পরীক্ষা। ‘আমি আল্লাহর নির্দেশে চলে যাচ্ছি’ প্রিয়তমা স্ত্রীকে এতটুকু বলে যাওয়ার দেরিও তিনি সহ্য করতে পারলেন না। স্রষ্টার হুকুম পালনের কী অপূর্ব দৃষ্টান্ত!
অসহায় স্ত্রী পেছন থেকে বারবার কাতরকণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি এ জনমানবহীন প্রান্তরে আমাদের একা রেখে কোথায় যাচ্ছেন? আল্লাহর পয়গম্বর কোনো জবাব দেননি। অবশেষে ডেকে বললেন, ‘আপনি কি আল্লাহর কোনো নির্দেশ পেয়েছেন? ইবরাহিম (আ.) মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ। আল্লাহর নির্দেশের কথা জানতে পেরে বিবি হাজেরা (আ.) খুশিমনে বললেন, তাহলে তিনি আমাদের ধ্বংস হতে দেবেন না। মহান আল্লাহর প্রতি কী অগাধ বিশ্বাস ও ভরসা লালন করেছেন নবীপত্নী হাজেরা (আ.)!
কিছুদিনের মধ্যে খাদ্য ও পানি শেষ হয়ে গেল। এক সময় নিদারুণ পিপাসা তাঁকে পানির খোঁজে বের হতে বাধ্য করল। শিশু ইসমাইলকে উন্মুক্ত স্থানে রেখে তিনি ‘সাফা-মারওয়া’ পাহাড়ে সাতবার ওঠানামা করেন। তাঁর এ ছোটাছুটি আল্লাহতায়ালা এতটাই পছন্দ করেছেন যে, কিয়ামত পর্যন্ত আগত বংশধরদের জন্য তাঁর অনুসরণ আবশ্যক করে দিয়েছেন। হাজীরা সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সাতবার চক্কর দিয়ে বিবি হাজেরা (আ.)-এর স্মৃতিচারণ করেন।
জমজম কূপের অস্তিত্ব
পিপাসাকাতর পুত্র ইসমাইলের জন্য পানির তালাশে পাগলিনীর মতো দৌড়াতে লাগলেন মা হাজেরা (আ.)। এক পর্যায়ে তিনি শুনতে পান, কে যেন আওয়াজ করছে। হাজেরা (আ.) বললেন, ‘তুমি যদি সাহায্য করতে পার, তবে সামনে আস। অতঃপর জিবরাইল (আ.) পায়ের আঘাতে একটি পানির ঝরনাধারা বইয়ে দিলেন। বর্তমানে এ ঝরনার নামই জমজম কূপ। জিবরাইল (আ.) বললেন, তুমি চিন্তা কর না। আল্লাহ তোমাকে এবং এই শিশুকে ধ্বংস করবেন না। এখানেই রয়েছে আল্লাহর ঘর। যার নির্মাণকাজ এই শিশু ও তাঁর পিতার ওপর আল্লাহ নির্ধারণ করে রেখেছেন। শুষ্ক মরুভূমিতে পানির সন্ধান পেয়ে বনি জুরহাম গোত্রের লোকেরা সেখানে বাস করার জন্য মা হাজেরা (আ.) এর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করল। তিনি বললেন, বসবাস করতে পার, কিন্তু পানির মালিকানা সত্ত্বের অংশীদার হতে পারবে না। তারা এ শর্ত মেনে নিল। আর এভাবেই পবিত্র মক্কায় গড়ে ওঠে জনপদের ভিত্তি। বিবি হাজেরা (আ.) ছিলেন এই নগরীর মাতা।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ