ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

কোরবানির সুবাদে অর্থনীতির পালে হাওয়া

প্রকাশনার সময়: ১৭ জুন ২০২৩, ০৭:১৬
ছবি : সংগৃহীত

আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের এক মহান মাধ্যম কোরবানি। কোরবানিদাতারা এতে কোনো লাভ-লোকসানের হিসেব না করলেও আধ্যাত্মিক গুরুত্বের পাশাপাশি এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব কিছুতেই কম নয়। ‘কোরবানি তো শুধু লোকসান; তা না করে এই টাকায় এই, সেই কত উন্নয়নমূলক কাজ করা যেত’ -এমন ধারণা অর্থনীতিতে কোরবানির ইতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে অজ্ঞতারই ফল। কোরবানির মাধ্যমে ধনীদের হাজার হাজার কোটি টাকা গরিবের হাতে চলে যাওয়া কি অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়?

কোরবানির উদ্দেশ্যটা বাণিজ্যিক না হলেও কর্মসংস্থান এবং গতিশীলতা তৈরির মাধ্যমে অর্থনীতির পালে সুবাতাস দিয়ে এর প্রত্যেকটি খাত বা সেক্টরকে গতিশীল করে তোলে। ঘূর্ণায়মান অর্থনীতির গতি প্রবাহে মুদ্রা সরবরাহ, লেনদেন ও আর্থিক কর্মকাণ্ডের প্রসারই আয়।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে ৪০ লাখ ৫৩ হাজার ৬৭৯টি গরু-মহিষ এবং ৫০ লাখ ৩৮ হাজার ৮৪৮টি ছাগল-ভেড়া, মোট ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি গবাদিপশু কোরবানি করা হয়েছে। (প্রথম আলো: ২৪ জুলাই, ২০২১)। ৪০ লাখ ৫৩ হাজার ৬৭৯টি গরু-মহিষের গড় মূল্য ৮০ হাজার টাকা হলে এতে লেনদেন হয়েছে ৩২ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা আর ৫০ লাখ ৩৮ হাজার ৮৪৮টি ছাগল-ভেড়ার গড় মূল্য ১০ হাজার টাকা হলে এ বাবদ লেনদেন হয়েছে ৫ হাজার ৩৮ কোটি টাকা। ২০২১ সালে কোরবানি উপলক্ষ্যে গরু-মহিষ ও ছাগল-ভেড়ায় লেনদেন ৩৭ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২২ সালে কোরবানি বৃদ্ধি পায় ৭ লাখ। ৯৭ লাখ ৭৫ হাজার কোরবানি হয়। এ ৯৭ লাখ ৭৫ হাজার কোরবানিতে লেনদেন ৪১ হাজার ৭২৯ কোটি টাকার। প্রশ্ন হলো, এই ৪১ হাজার কোটি টাকা যাচ্ছে কোথায়? যাচ্ছে গরিবদের ঘরে। প্রায় ৯৯% কোরবানির পশুই কেনা হয় গরিবের কাছ থেকে। গরিব মানুষ সারা বছর গরু লালন-পালন করে কোরবানির হাটে নিয়ে আসে। হাটে গরু বিক্রি করে ধনীদের হাতে তুলে দেয়। আর তারা ঘরে নিয়ে যায় মোটা অঙ্কের টাকা।

কোরবানির পুরো টাকাটাই তাদের ঘরে যায়। একসঙ্গে এতগুলো টাকা পেয়ে তারা তাদের বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণ করে। গরিবের অর্থনৈতিক চাকা সচল হয়। তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। গ্রাম-গঞ্জের বাজারগুলো সচল হয়ে ওঠে।

কোরবানির গোশতেরও সিংহভাগ চলে যায় গরিবের ঘরে। সারা বছর যেসব গরিবপরিবার ভালোভাবে গোশত খেতে পারে না কোরবানির তাদেরকে তৃপ্তিভরে গোশত খাওয়ার সুযোগ করে দেয়। এবার দেশে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ২১ লাখ গবাদিপশু রয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।

কোরবানির পশুর ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর গোসম্পদ পালনের পরিমাণও বাড়ছে। শুধু কুষ্টিয়া জেলাতেই ছোট বড় প্রায় ১৮ হাজার খামার রয়েছে। কোরবানির জন্য দেড় লাখ পশু প্রস্তুত করেন কুষ্টিয়ার খামারিরা। (খোলা কাগজ: ১৮ জুলাই, ২০২১)। এভাবে দেশের বিভিন্ন জেলায় গড়ে ওঠা খামারগুলোতে কর্মসংস্থান হচ্ছে লক্ষাধিক মানুষের। তাছাড়াও কোরবানির পশু পরিবহন, টোল, বখশিশ, বাঁশ-খুঁটির ব্যবসা, পশুর খাবারেও লেনদেন হয় কোটি কোটি টাকা।

কোরবানির চামড়ার মূল্য দরিদ্রদের অধিকার। কোরবানি হওয়া ৪৫ লাখ গরুর প্রত্যেকটি চামড়ার মূল্য গড়ে ১ হাজার টাকা ধরলেও এর মূল্য হয় ৪৫০ কোটি টাকা। আবার ৫২ লাখ ছাগলের প্রত্যেকটির চামড়ার মূল্য ১০০ টাকা ধরলেও এ বাবদ হয় ৫২ কোটি টাকা। গরু ও ছাগলের চামড়া মিলিয়ে এই ৫০২ কোটি টাকা চলে যাচ্ছে সরাসরি গরিবদের হাতে। দুঃখজনক, আমাদের দেশে চামড়া দিয়ে তৈরি পণ্যের দাম অনেক বেশি হলেও চামড়ার মূল্য অনেক কম।

বাংলাদেশে রফতানি খাতে চামড়ার অবস্থান তৃতীয়। কোরবানির ওপর ভর করেই টিকে আছে বিপুল সম্ভাবনার এ খাতটি। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০২১ সালের বছরের জুলাই মাস থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মধ্যেই ৭৮ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি হয়েছে দেশ থেকে। (দৈনিক সময়ের আলো: ৬ মার্চ, ২০২২)।

স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চামড়ার চাহিদা প্রচুর। বাংলাদেশ থেকে ইতালি, নিউজিল্যান্ড, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর চামড়াজাত পণ্য রফতানি করা হয়। ভারতেও বাংলাদেশি চামড়ার কদর কম নয়। মোট চামড়ার ৬০ থেকে ৭০ ভাগই সংগৃহীত হয় কোরবানি ঈদে।

চামড়া শিল্পের মানোন্নয়নে সরকারের আর্থিক সহযোগিতা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, চামড়া শিল্পের জন্য আলাদা শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠা, প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি, চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব নিরসন এবং সর্বোপরি আরও লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউট স্থাপন করলে একদিকে যেমন হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো অন্যদিকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেত লাখ লাখ মানুষ। গার্মেন্ট শিল্পের মতো চামড়া শিল্পও হতো বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী ব্যাপক সমাদৃত আরেকটি শক্তিশালী রফতানি খাত।

চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণে ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা জড়িত। লবণ হলো চামড়া সংরক্ষণের অন্যতম উপাদান। কোরবানি উপলক্ষ্যে লবণের ব্যবসাও চাঙ্গা হয়। চামড়া সংরক্ষণে প্রয়োজন হয় বিপুল জনবলের। তখন শ্রমিকরা পান তাদের শ্রমের চড়ামূল্য। দেশের বিভিন্ন স্থানে চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়।

কোরবানির বর্জ্যেও রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। কোরবানি ঈদে শুধু ঢাকা শহরেই উৎপাদিত হয় ৩৫ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য। কোরবানির প্রত্যেকটি গরু থেকে ১৫ থেকে ২৫ কেজি হাড় ফেলে দেয়া হয়। অথচ উচ্ছিষ্ট শতভাগ রফতানিযোগ্য এসব হাড় দিয়ে ওষুধ, সিরামিক পণ্য, বোতাম, চিরুনি, পুঁতি, বয়স্কদের ব্যবহারের লাঠি, ঘর সাজানোর নানা উপকরণ তৈরি করা হয়।

বিভিন্ন দেশে খাদ্য হিসেবে ব্যবহূত হয় এর নাড়িভুঁড়ি। এ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেয়া গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার হাড় থেকে শুরু করে শিং, অণ্ডকোষ, চর্বি, মূত্রথলিসহ অপ্রয়োজনীয় অংশগুলো প্রক্রিয়াজাত করলে প্রতি বছর শত কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।

কোরবানি উপলক্ষ্যে মশলার বাজার সগরম হয়। প্রতি বছর দেশে ২২ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ, ৫ লাখ মেট্রিক টন রসুন আর ৩ লাখ টন আদার চাহিদা থাকে। এর উল্লেখযোগ্য অংশই ব্যবহার হয় কোরবানিতে। ব্যবসায়ীরা যেমন রামজান কিংবা ঈদের অপেক্ষায় থাকেন তেমনি কামাররাও অপেক্ষায় থাকেন ঈদুল আজহার। ১১ মাস তাদের ব্যবসা একরকম আর কোরবানির সময় তাদের ব্যবসা অন্যরকম।

সারা বছর কামাররা যা আয় করেন তা দিয়ে কোনোরকম সংসার চলে আর কোরবানির সময় যে বাড়তি আয়টুকু করেন তা দিয়েই বিশেষ কোনো কাজ বা সঞ্চয় করেন। ফলে কোরবানি এলেই হাঁপানির বিরামহীন উঠানামা আর হাতুড়ির টং টং শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে কামারপাড়া। মফস্বলের কর্মকাররাও এ সময় প্রতিদিন ২ থেকে ৩ হাজার টাকা আয় করেন।

রাজধানীর কামারশালাগুলোতে এ সময় ২ থেকে ৫ লাখ টাকার মতো বিক্রির আদেশ আসে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সব মিলিয়ে কোরবানিতে এসব পণ্যের বাজার এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বাড়তি আয়ের জন্য পেশাদার এবং মৌসুমী কসাইরাও থাকেন কোরবানির প্রতীক্ষায়।

বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্ক্রিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক হিসেব অনুযায়ী দেশে বছরে যত পশু জবাই হয় এর ৪৫ থেকে ৫০ ভাগ জবাই হয়। পেশাদার কসাইদের পক্ষে সব পশুর চামড়া ছেলা সম্ভব হয় না। বাড়তি চাপ সামলাতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কয়েক হাজার মৌসুমী কসাই ঢাকামুখী হন।

দেশের বিভিন্ন স্থান হতে আগত মৌসুমী কসাইরা জানান, তারা কোরবানিতে তিন দিনে গরু কেটে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা উপার্জন করেন। তাই এমনটি ভাবার সুযোগ নেই যে ‘কোরবানিতে তো হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে’, বরং বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিশীলতা তৈরি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে সম্পদের হাতবদলে বিরাট ইতাবাচক ভূমিকা পালন করে কোরবানি।

লেখক: প্রিন্সিপাল, বাইতুল হিকমাহ একাডেমি, গাজীপুর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ