ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভূমিকম্প প্রাকৃতিক না আল্লাহর পক্ষ থেকে

প্রকাশনার সময়: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:৩৪ | আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:৩৬
ছবি : সংগৃহীত

অনেক অসচেতন মানুষ মনে করে ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা নির্ধারিত কিছু প্রাকৃতিক কারণেই ঘটে থাকে, মানুষের কৃত-কর্ম, পাপরাশির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে বাস্তবতা হলো, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এর রয়েছে নির্ধারিত কিছু কারণ ও তাৎপর্য।

ভূমিকম্প কেয়ামতের আলামত ভূমিকম্প সম্পর্কে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.)কে জিজ্ঞাসা করা হলো। তিনি বললেন, ‘সকল প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালকের। ভূমিকম্প আল্লাহ তায়ালার একটি অন্যতম নিদর্শন। তা দ্বারা তিনি মানুষকে ভীতি প্রদর্শন করেন। যেমনিভাবে সূর্যগ্রহণ ও অন্যান্য নিদর্শন ও ঘটনাবলি দ্বারা করে থাকেন। ভূমিকম্পের মাধ্যমে ভীতি প্রদর্শন তাঁর হেকমত। বাহ্যত কারণ হলো, পৃথিবীর শূন্যগর্ভে ধোঁয়া, বাতাস ও পানি সংকীর্ণ জায়গায় চাপা পড়ে বের হওয়ার পথ খোঁজে। তখন জমিন ফেটে যায় এবং আশপাশের ভূমি প্রকম্পিত হয়।’

ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘যখন পৃথিবীতে বায়ু প্রবাহিত হয়ে ভূগহ্বরে প্রবেশ করে, তারপর ধোঁয়া সৃষ্টি হয়ে বের হওয়া অসম্ভব হয়ে যায়। তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে শ্বাস ছাড়ার অনুমতি দেন। এতে সৃষ্টি হয় ভীষণ ভূকম্পন। তাতে মানুষ ভয় পায়, আতঙ্কিত হয়, অন্যায় থেকে দূরে সরে আসে, আল্লাহ তায়ালার নিকটবর্তী হয় এবং তাঁর কাছে মিনতি করে ও লজ্জিত হয়।’

ঘনঘন ভূমিকম্প হওয়া কেয়ামতের আলামত। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সে পর্যন্ত কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যাবৎ না ইল্ম উঠিয়ে নেয়া হবে, ভূমিকম্প বৃদ্ধি পাবে, সময়ের ব্যবধান কমে যাবে, ফেতনা প্রকাশ পাবে, হত্যা খুন-খারাবি বেড়ে যাবে, এমনকি তোমাদের সম্পদ বেড়ে উপচে পড়বে।’

বিশুদ্ধ সনদে আব্দুল্লাহ বিন হাওলা থেকে ইমাম আহমদ (রহ.) বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বীয় হাত মোবারক আমার মাথায় রাখলেন। তারপর বললেন, ‘হে ইবনে হাওয়ালা! যখন তুমি পবিত্র ভূমিতে মতনৈক্য দেখতে পাবে। তখন ভূমিকম্প, বিপদ, দুর্যোগ, ভয়ঙ্কর সব বিষয় ও কেয়ামত এত কাছাকাছি চলে আসবে, যেমন আমার এই হাত তোমার মাথার কাছাকাছি।’

এই ভূমিকম্প আমাদেরকে মহাপ্রলয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে লোক সকল! তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। নিশ্চয় কেয়ামতের প্রকম্পন একটি ভয়ংকর ব্যাপার। যেদিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন প্রত্যেক স্তন্যধাত্রী তার দুধের শিশুকে বিস্মৃত হবে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত করবে এবং মানুষকে তুমি দেখবে মাতাল; অথচ তারা মাতাল নয় বস্তুতঃ আল্লাহর আজাব সুকঠিন।’ (সুরা হজ: ১-২)

ভূমিকম্প আল্লাহর নিদর্শন ভূমিকম্প আল্লাহ তায়ালার একাত্ববাদ ও তাঁর কুদরতের প্রমাণবহ একটি নিদর্শন। বান্দা তাঁর কব্জায় ও রহমতের অধীন। আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য এই পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন। তাতে তাদের জীবিকা ও রিজিক দিয়েছেন। কিন্তু আপনি যদি এই শান্ত পৃথিবী প্রকম্পিত হওয়ার সময় লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখবেন তাঁর ক্ষমতা, ইচ্ছা শক্তি, হিকমত ও একাত্ববাদের স্পষ্ট দলিল। আপনি তাঁর বড়ত্ব নিয়ে চিন্তা করুন, সকল বিষয়ের চাবি তাঁর হাতে। চিন্তা করুন যে মুক্তি পেয়েছে সে কীভাবে মুক্তি পেয়েছে, আর যে ধ্বংস হয়েছে সে কীভাবে ধ্বংস হয়েছে। তাহলে আপনি নিজেই মহাপ্রজ্ঞাময় কুশলী প্রভুর বিশালত্ব বুঝতে পারবেন।

ভূমিকম্প দিয়ে ভয় দেখানো ও উপদেশ দেয়া ভূমিকম্প আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে পৃথিবীবাসীর জন্য হুমকি স্বরূপ। এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি ভীতিপ্রদর্শনের জন্যই সকল নিদর্শন প্রেরণ করি।’ (সুরা ইসরা : ৫৯) একবার ইরাকের কুফার জমিন কেঁপে উঠল। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) বললেন, ‘হে লোক সকল আল্লাহ তায়ালা তোমাদের প্রত্যাবর্তন চান। তোমরা তাঁর দিকে ফিরে যাও।’ অর্থাৎ তিনি চান তোমরা তাঁর অসন্তুষ্টিবিমুখ হও। তাঁর সন্তুষ্টি তালাশ কর। সুতরাং তোমরা তাই কর।

ভূমিকম্প দিয়ে কখনো আল্লাহর প্রতিশোধ ও শাস্তি কখনও ভূমিকম্প কাফেরদের জন্য গজব ও প্রতিশোধ স্বরূপ হয়ে থাকে। আল্লাহ তায়ালা অতীতে অনেক জাতিকে ধ্বংস করেছেন, তাদের কুফরি ও বিশ্বজগতের প্রতিপালকের নবী-রাসুলকে অস্বীকারের কারণে। এরশাদ হয়েছে, ‘আমি প্রত্যেককেই তার অপরাধের কারণে পাকড়াও করেছি। তাদের কারও প্রতি প্রেরণ করেছি প্রস্তরসহ প্রচণ্ড বাতাস, কাউকে পেয়েছে বজ্রপাত, কাউকে আমি বিলীন করেছি ভূগর্ভে এবং কাউকে করেছি নিমজ্জিত। আল্লাহ তাদের প্রতি জুলুম করার ছিলেন না; কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম করেছে।’ (সুরা আনকাবুত: ৪০)

শুয়াইব (আ.)-এর সম্প্রদায়ের ঘটনা বর্ণনায় আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতঃপর পাকড়াও করল তাদেরকে ভূমিকম্প। ফলে সকাল বেলায় নিজ নিজ গৃহে উপুড় হয়ে পড়ে রইল।’ (সুরা আরাফ: ৭৮)

ওমর বিন আব্দুল আজিজ (রহ.) ভূমিকম্প সম্পর্কে বলেন, ‘এই কম্পন দিয়ে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় বান্দাদেরকে শাস্তি দেন।’

ঈমানদারের জন্য রহমত কখনও ভূমিকম্প হয় মুসলমানদের জন্য দুনিয়াতে সাময়িক শাস্তি দিয়ে আখেরাতে পাপমুক্ত করা এবং রহমত হিসেবে তাদের জান্নাত লাভের কারণ। আবু মুসা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার এই উম্মত করুণাধন্য উম্মত আখেরাতে তাদের কোনো শাস্তি নেই। দুনিয়াতে ফেতনা, ভূমিকম্প ও হত্যা তাদের শাস্তি।’ (আবু দাউদ ও আহমদ)

কখনও ভূমিকম্প বিধ্বস্ততার নিচে নিহত ব্যক্তির জন্য মর্যাদার বৃদ্ধির প্রক্রিয়া। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পাঁচ ব্যক্তি শহিদ; ১. মহামারিতে আক্রান্ত, ২. অন্ত্রপীড়াগ্রস্ত, ৩. তিন পানিতে ডুবে নিহত, ৪. ধ্বংসাবশেষের নিচে পিষ্ট এবং ৫. আল্লাহর রাস্তায় নিহত ব্যক্তি।’ (বুখারি ও মুসলিম)

ভূমিকম্প সৃষ্টি জগতের কর্মের প্রতিফল আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের ওপর যেসব বিপদ-আপদ পতিত হয়, তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গোনাহ ক্ষমা করে দেন।’ (সুরা সুরা: ৩০) মহান আল্লাহ আরো ফরমান, ‘স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের দরুণ বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সুরা রুম : ৪১)

পাপ ও গোনাহ সকল বিপদ ও দুর্যোগের কারণ, সুতরাং আমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবো? আমরা কি এ থেকে শিক্ষা নেব? ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘পৃথিবীতে ভূমিকম্প, ভূমিধ্বসসহ সকল দুর্যোগ পাপের প্রতিক্রিয়া। অতএব, তোমরা গোনাহ ছেড়ে দাও, সুদ বর্জন কর, যেনা থেকে দূরে থাক, নামাজ ছেড়ে দিও না, অশ্লীল গান-বাজনা পরিত্যাগ কর, জুলুম কর না, মাপে কম দিও না, মুসলমান ভাইকে অপমান করা থেকে সতর্ক থাক।’

আমাদের করণীয় শাইখুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া (রহ.) বলেন, ‘ভালো-মন্দ বিষয়ে নিয়ম হচ্ছে, বান্দা ভালো ও নেক বিষয়ে এমন কাজ করবে যার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা কল্যাণ দান করবেন। মন্দ বিষয়ে এমন ইবাদত করবে যার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তার থেকে মন্দকে দূরে সরিয়ে দেন। তাই আমাদের করণীয়:

এক. সূর্যগ্রহণের নামাজের ন্যায় ভূমিকম্পের সময়ও নামাজ পড়বে। যেমন ইমাম বায়হাকি বর্ণনা করেন, ইবনে আব্বাস (রা.) বসরায় ভূমিকম্পের সময় নামাজ পড়েছেন। তবে এর জামাত নেই। একাকী নামাজ পড়বে।

দুই. আল্লাহর কাছে তাওবা করবে ও লজ্জিত হবে।

তিন. বেশি বেশি জিকির, দোয়া ও ইস্তেগফার করবে।

ইমাম কুস্তলানি (রহ.) বলেন, ভূমিকম্প, বজ্র, প্রবল ঝড়ো হাওয়া ও ভূমিধ্বসের সময় দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে মিনতি জানানো সবার করণীয়।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ