কোনো কোনো বাড়ির মালিকের একত্রে পাঁচ-দশ লাখ টাকা দরকার হলে কারও থেকে এ শর্তে নেয় যে, পাঁচ বছরের জন্য আপনি আমাকে দশ লাখ টাকা দেন। আপনার টাকা ফেরত না দেয়া পর্যন্ত অর্থাৎ পাঁচ বছর পর্যন্ত আপনি আমার বাড়িতে ফ্রি বসবাস করবেন। অথবা অন্যের কাছে ভাড়া দিয়ে আপনি লাভবান হবেন। অনেকটা গ্রাম দেশের জমি বন্ধক দেয়ার মতোই।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে সময় নির্ধারিত থাকে না; বরং বলা হয় যত দিন আপনার টাকা না দেব, তত দিন আমার বাড়ি বা ফ্ল্যাট ভোগ করবেন। এই লেনদেন সম্পূর্ণ নাজায়েজ। কারণ এক্ষেত্রে বাসাটি বন্ধকী বস্তু। আর বন্ধকী বস্তু থেকে উপকার গ্রহণ করা ঋণ দিয়ে লাভ ভোগ করার মতো, যা সুদি চুক্তির অন্তর্ভুক্ত।
মুহাম্মাদ ইবনে সিরিন (রহ.) বলেন, এক ব্যক্তি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর কাছে এসে বলল, এক ব্যক্তি আমার কাছে একটি ঘোড়া বন্ধক রেখেছে। আমি তার পিঠে আরোহণ করেছি। তখন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বললেন, ‘ঘোড়ার পিঠে চড়ে যে উপকার ভোগ করেছ তা সুদ।’ (মুসান্নাফে আবদুর রায্যাক: ১৮০৭১)
ফাযালা বিন উবাইদ (রা.) বলেন, ‘যেই ঋণ কোনো লাভ নিয়ে আসে তা রিবার (সুদের) প্রকারসমূহের মধ্যে একটি।’ (সুনানে কুবরা: ১০৯৩৩)
সিকিউরিটি বাড়িয়ে দিলে ভাড়া কমিয়ে দেয়া
পূর্বোক্ত পদ্ধতির কাছাকাছি আরেকটি পদ্ধতি চালু হয়েছে। তা সচরাচর সিকিউরিটির মতো নয়; বরং কোনো এলাকায় সচরাচর সিকিউরিটি যদি পঞ্চাশ হাজার হয় এক্ষেত্রে এর চেয়ে অনেক বেশি যেমন চার/পাঁচ লাখ টাকা নেয়া হয়। এই অতিরিক্ত সিকিউরিটি দেয়ার কারণে ভাড়া একেবারে কমিয়ে দেয়া হয়। যেমন সাধারণ অবস্থায় ভাড়া যদি দশ হাজার টাকা হয়ে থাকে এক্ষেত্রে তার থেকে এক-দুই হাজার টাকা ভাড়া নেয়া হয়। যত দিন সিকিউরিটির টাকা ফেরত না দেবে তত দিন ভাড়া এ রকম কম থাকবে।
এই পদ্ধতিও সম্পূর্ণ নাজায়েজ। মর্টগেজ পদ্ধতির মতো এটিও ঋণ দিয়ে মুনাফা ভোগ করারই আরেক প্রকার। তাই এ পদ্ধতিও সম্পূর্ণ বর্জনীয়। বেশি পরিমাণ সিকিউরিটি জমা নিলেও ভাড়া সাধারণত অন্যান্য বাসাবাড়িতে যেমন নেয়া হয় তেমনই নেয়া উচিত। অস্বাভাবিক ভাড়া কমালে তা বন্ধকী সম্পত্তি থেকে উপকৃত হওয়া বা ঋণের কারণে লাভবান হওয়ার আওতায় পড়ে নাজায়েজ হবে।
সিকিউরিটি মানি প্রসঙ্গ
বাড়ির মালিকরা ভাড়াটিয়া থেকে অগ্রীম কিছু টাকা সিকিউরিটির জন্য নিয়ে থাকে। এই অগ্রীম টাকা আদায়ের বিভিন্ন নিয়ম থাকে। নিয়মের ভিন্নতার কারণে এর হুকুম ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন-
* কারও এমন নিয়ম থাকে, এক বা দুই মাসের ভাড়া অগ্রীম দিতে হবে। যা বাড়ি ছেড়ে দেয়ার সময় শেষ দুই মাসের ভাড়া হিসেবে ধরা হবে। এক্ষেত্রে তা ফিকহে ইসলামির দৃষ্টিতে অগ্রীম ভাড়া হিসেবে ধর্তব্য হবে। সিকিউরিটি মানি তথা বন্ধক হিসেবে গণ্য হবে না।
* দোকান বা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়ার জন্য দুই-তিন লাখ বা আরও বেশি টাকা অগ্রীম নেয়া হয়। এরপর মাসে মাসে কিছু কিছু করে সকল টাকা ভাড়ার সঙ্গে কেটে নেয়। পরবর্তীতে ফেরতযোগ্য হিসেবে কিছুই রাখা হয় না। এমনটি হলে এটাও অগ্রীম ভাড়া হিসেবে গণ্য হবে।
এই দুই ক্ষেত্রে অগ্রীম হিসেবে যা নেয়া হয় সে টাকার মালিক বাড়িওয়ালাই হবে। সুতরাং এ টাকা সে নিজ প্রয়োজনে খরচ করতে পারবে এবং এটি তার জাকাতযোগ্য সম্পদ বলে গণ্য হবে। তাই জাকাতবর্ষ শেষে এ টাকা থেকে কিছু অবশিষ্ট থাকলে তাকেই এর যাকাত দিতে হবে। ভাড়াটিয়াকে এর যাকাত দিতে হবে না।
* আর যদি অগ্রীম নেয়া এই টাকা থেকে ভাড়া হিসেবে কোনো কিছু কাটা না হয় এবং চুক্তি শেষ হওয়ার আগের মাসগুলোর ভাড়া হিসেবেও গণ্য করা না হয়, বরং ভাড়াটিয়া বাড়ি ছাড়ার সময় তাকে এ টাকা ফেরত দেয়ার শর্ত করা হয় তাহলে এই টাকা সিকিউরিটি মানি বলে গণ্য হবে।
ফিকহি দৃষ্টিকোণ থেকে সিকিউরিটি মানি রাহান তথা বন্ধকী সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত। আর বন্ধকগ্রহিতার জন্য বন্ধকী বস্তু দ্বারা উপকৃত হওয়া জায়েজ নেই। সে হিসেবে বাড়ির মালিকের জন্য এই অগ্রীম টাকা খরচ করা জায়েজ নয়। সাধারণ নিয়মে টাকাগুলো নিজের কাছে বা ব্যাংকে রেখে দেয়া আবশ্যক। কিন্তু আজকাল অনেক বাড়িওয়ালা বন্ধকের উক্ত নিয়ম মেনে চলে না। বরং প্রায় সবাই এ টাকা খরচ করে ফেলে। জমা রাখে না। তাই কোনো কোনো ফকিহ এই খরচকে বৈধতা দেয়ার জন্য এই টাকাকে বন্ধক না ধরে ঋণ বলতে চান। আর এটাকে ভাড়ার সঙ্গে শর্ত না করে ভিন্নভাবে লেনদেন করতে বলেন। তাদের ভাষ্যমতে এভাবে করলে বাড়িওয়ালার জন্য তা ব্যবহার করা বৈধ হবে। অবশ্য অন্য অনেক ফহিহ এটাকে সিকিউরিটি তথা বন্ধকই বলেন। দলিলের দিক থেকে এ মতটিই শক্তিশালী।
প্রকাশ থাকে যে, এ টাকাকে বন্ধক ধরা হলে সমস্যা হলো বাড়িওয়ালার জন্য তা ব্যবহার করা জায়েজ নয়। আর ঋণ ধরা হলে সমস্যা হলো, ভাড়ার সঙ্গে ঋণ প্রদানের শর্ত করার কারণে ভাড়া-চুক্তি ফ্যাসেদ হয়ে যায়। এ কারণে সিকিউরিটি মানির ক্ষেত্রে নিম্নের যে কোনো একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা নিরাপদ।
* একে অগ্রীম ভাড়া ধরা। অর্থাৎ বাড়ি ছেড়ে দেয়ার সময় শেষের দিকের মাসের ভাড়া ধরা হবে এবং সে অনুযায়ী আমল করা হবে। আর অগ্রীমের পরিমাণ বেশি হলে প্রতি মাসেই নগদ ভাড়ার সঙ্গে একটা অংশ ভাড়া হিসাবে কর্তন করা হবে। এ টাকা পরবর্তীতে ফেরতযোগ্য হিসেবে ধরা হবে না। এভাবে অগ্রীম ভাড়া ধরা হলে এর মালিক বাড়িওয়ালাই হবে। এক্ষেত্রে সে তা ব্যবহার করতে পারবে এবং যাকাতও সেই আদায় করবে।
* কোনো কোনো সময় বাড়িওয়ালা সিকিউরিটির টাকা দিয়ে বাড়ির সজ্জায়ন করে বা ফিটিংস ইত্যাদি লাগায়।
এক্ষেত্রে ভাড়াটিয়ার সঙ্গে নিম্নোক্ত পদ্ধতিতে চুক্তি করা যেতে পারে। ভাড়াটিয়া এসব কাজ নিজ দায়িত্বে বা বাড়িওয়ালার দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী নিজের টাকা দিয়ে করে নেবে এবং তা ভাড়াটিয়ার মালিকানা হিসেবে গণ্য হবে। এরপর যখন বাসা ছেড়ে দেবে তখন বাড়িওয়ালার কাছে একটি দাম ধরে জিনিসগুলো বিক্রি করে দেবে। এ পন্থা অবলম্বন করলে বন্ধক নিয়ে তা খরচ করার জটিলতাও থাকে না। আবার জাকাত কে দেবে এই প্রশ্নও আসে না। কেননা ভাড়াটিয়া যেহেতু ওই টাকা খরচ করে ফেলেছে তাই তার ওপর এর জকাত আসবে না। আর বাড়িওয়ালাও এ টাকার মালিক হয়নি বিধায় তাকেও এর জাকাত দিতে হবে না।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ