আমরা সবসময়ই বলে থাকি আজ আমি এই কাজটা করবো কাল ওই কাজটা করবো। কিন্তু মাঝেমাঝেই তা করে হয়ে ওঠে না। কারণ হিসেবে হয় আমরা কোনো কাজের উসিলা দেখাই অথবা মনে না থাকার কথা বলি। কিন্তু আমরা কি কখনও খুঁজে দেখেছি আসলে একটা কাজ করতে চেয়েও না করতে পারার পেছনে মূল বিষয়টি কী?
মূল বিষয়টি হচ্ছে তাওফিক। হ্যাঁ, তাওফিক। যেটা না থাকলে কখনও কিছুই করার সাধ্য আমাদের নেই। এটা এমন একটা বিষয় যা নিয়ে একবার ভাবা শুরু করলে আর শেষ হতে চাইবে না।
তাই আমার মনে হয় পৃথিবীতে আমাদের জন্য আল্লাহ তায়ালার দেয়া সবচেয়ে দামি উপহারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো তাওফিক। তৌফিকে না থাকলে কখনও কিছুই করে উঠতে আমরা সফল হই না— চাই তা ইবাদত হোক বা পার্থিব কাজকর্ম। আর বতর্মান এই আধুনিকতার যুগে যখন ফোনেই সবকিছু পাওয়া যায় সেখানেও ইবাদতের তাওফিক না থাকলে কিছুই করার থাকে না।
একটা উদাহরণ দেখা যাক। ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে সহজ ইবাদত হলো জিকির। কেননা এই ইবাদত করতে হলে আপনাকে দুনিয়াবি কোনো কাজ ছেড়ে করতে হচ্ছে না। ফোন স্ক্রিলিং করছেন, হাঁটাচলা করছেন, বসে আছেন বা কাজ করছেন সবসময়ই সব অবস্থাতেই জিকির করা যায়।
আর সর্বশেষ্ঠ জিকির ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ এত সহজ যে এটা উচ্চারণ করতে মুখের নাড়াচাড়াও এতো বেশি লাগে না। কিন্তু এতো সহজ ইবাদত হওয়া সত্ত্বেও আমরা অনেক মানুষই এই ইবাদতটি করতে কেন যেন সময়ই পাই না। কেন পাই না, কেননা তার তাওফিক আমাদের নেই। তাই জিকিরের গুরুত্ব বোঝা সত্বেও করা হয়ে ওঠে না। এই তাওফিক এতোটাই দামি যে এর সৌভাগ্য সবার হয় না।
তাওফিক এমনি এক বিরল নেয়ামত যেটা সহজে নিজের করে নেয়া যায় না। ইমাম ইবনু আলান (রহ.) বলেন, ‘তাওফিক বিষয়টি খুবই দুর্লভ। এজন্যই তা কোরআনে মাত্র একবার উল্লেখ করা হয়েছে।’ (দালিলুল ফালিহিন: ১/২১)
আমরা দেখতে পাই তাওফিকের বিষয়টি কোরআন মাজিদের শুধুমাত্র সুরা হুদে এসেছে— ‘আর, আল্লাহ ব্যতীত আমার (কোনোকিছু করার) তাওফিক (সক্ষমতা) নেই। আমি তার ওপরই ভরসা করি এবং তার দিকেই আমি প্রত্যাবর্তন করব।’ (সুরা হুদ: ৮৮)
এখানে তাওফিকের পাশাপাশি তাওয়াক্কুল বা আল্লাহ তায়ালার ওপর প্রগাঢ় বিশ্বাস রাখার দিকেও নজর দেয়া হয়েছে। তাহলে বোঝা যায় কোনো কাজের তাওফিক পাওয়া রবের প্রতি তাওয়াক্কুলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
তাওফিক যেহেতু খুবই বিরল তাই একজন বিদ্বান বলেছেন, ‘আসমান থেকে তৌফিকের চাইতে দামি কোনো কিছু নেমে আসে না। আর জমিন থেকে ইখলাসের চেয়ে মূল্যবান কোনো কিছু ওপরে উঠে না।’ (আত-তাহবির শারহুত তাহরির, পৃষ্ঠা : ৬২)
ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহ যাকে ভালোবাসেন, তাকে তিনি সেসব কাজ করার তাওফিক দেন, যা তিনি ভালোবাসেন।’
তাই একজন মুমিন হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালার কাছে বেশি বেশি করে নেক আমলের তাওফিক চাওয়া। কারণ আল্লাহ তায়ালা যদি তাওফিক না দেন তাহলে কোনো কিছু করার সাধ্য এই পৃথিবীতে কারোর নেই।
তাওফিক যদিও সহজে পাওয়া যায় না। তবুও একজন ব্যক্তি তাওফিক লাভের জন্য অনেকগুলো পথ অবলম্বন করতে পারেন। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পথ হলো— যেভাবেই হোক, যত কষ্টই হোক আমাদের আল্লাহ তায়ালার দিকে ধাবিত হওয়ার পূর্ণাঙ্গ চেষ্টা করতে হবে। কেননা একজন ব্যক্তি আল্লাহর দিকে ধাবিত হলে, আল্লাহ তায়ালা কখনও তাকে খালি হাতে ফেরান না। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘যে তাঁর অভিমুখী হয়, তাকে তিনি সঠিক পথপ্রদর্শন করেন।’ (সুরা আশ-শুরা: ১৩)
এজন্য আমাদের সবসময় নেক আমলের ইচ্ছে এবং বদ আমলের প্রতি ঘৃণার বিষয়ে আল্লাহর তাওফিক কামনা করতে হবে। পাশাপাশি কখনও গুনাহ হয়ে গেলে দ্রুতই তাওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসার যথাসম্ভব চেষ্টা করতে হবে। কারণ গুনাহই মূলত তাওফিক লাভের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে যায়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা যদি তাঁর কোনো বান্দার কল্যাণ করার ইচ্ছা করেন, তাহলে তাকে কাজ করার তাওফিক প্রদান করেন।’ প্রশ্ন করা হলো, ‘হে আল্লাহর রাসুল! তিনি কীভাবে তাকে কাজ করার তাওফিক দেন?’ তিনি বললেন, ‘তিনি সেই বান্দাকে মারা যাওয়ার আগে নেক আমলের সুযোগ দান করেন।’ (তিরমিজি: ২১৪২)
তাওফিক লাভের আরও একটি চমৎকার উপায় হচ্ছে— ভবিষ্যতে করবো এমন যেকোনো কথায় ‘ইনশাআল্লাহ’ যুক্ত করা। খুব ছোট একটা শব্দ কিন্তু লক্ষ্য পূরণের জন্য যথেষ্ট ভারি। কেননা এর অর্থ হচ্ছে ‘আল্লাহ তায়ালা যদি চান’। এই ইনশাআল্লাহ কথাটা যদি আমরা কোনো কথায় যুক্ত করে বলি তাহলে ওই কাজটা আমরা করার জন্য আমাদের ধ্বংসশীল শক্তি না বরং মহান শক্তিশালী পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করছি। চিন্তা করুন বিষয়টা সত্যিই কতটা মনোমুগ্ধকর। মহান রাব্বুল আলামিনকে আমরা আমাদের কাজের জন্য ভরসা করে রাখছি। যিনি কখনও কিছুই ভোলেন না।
রাসুলুল্লাহ (সা.) এর মক্কা জীবনের সুরা কাহাফ নাজিলের প্রেক্ষাপট মনে করুন। দেখুন সুরা কাহাফের ২৪নং আয়াতটি। অর্থাৎ, ‘তবে (বলো) আল্লাহ যদি চান (তবে করব)। আর কখনও ভুলে গেলে নিজ প্রতিপালককে স্মরণ কর এবং বল, আমি আশা করি আমার প্রতিপালক এমন কোনও বিষয়ের প্রতি আমাকে পথনির্দেশ করবেন, যা এর চেয়েও হিদায়াতের বেশি নিকটবর্তী হবে।’
সুরাটি নাজিলের প্রেক্ষাপট ছিল এমন। যেখানে আমরা দেখতে পাই। যখন মহানবী (সা.)কে ‘আসহাবে কাহফ’ ও ‘জুলকারনাইন’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তখন তিনি প্রশ্ন কর্তাদেরকে এক ধরনের ওয়াদা দিয়েছিলেন যে, আমি এ প্রশ্নের উত্তর তোমাদেরকে আগামীকাল দেব। সে সময় তিনি ‘ইনশাআল্লাহ’ বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। তাঁর আশা ছিল, আগামীকালের ভেতর ওহির মাধ্যমে তাঁকে এসব ঘটনা সম্পর্কে অবগত করা হবে। এটাই আলোচ্য আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট। আয়াতে এ ঘটনার প্রতি ইশারা করে আল্লাহ তায়ালা একটি স্বতন্ত্র নির্দেশনা দান করেছেন।
এরশাদ করেছেন, মুসলিম মাত্রই ‘ইনশাআল্লাহ’ বলতে অভ্যস্ত হওয়া উচিত। ভবিষ্যত সম্পর্কিত কোনো কথাই ‘ইনশাআল্লাহ’ যোগ না করে বলা উচিত নয়। কোনো কোনো রিওয়ায়াত দ্বারা জানা যায়, এ বিষয়ে তিনি যে ওয়াদা করেছিলেন, তাতে যেহেতু ‘ইনশাআল্লাহ’ বলতে ভুলে গিয়েছিলেন, তাই পরবর্তী দিন ওহি আসেনি; বরং একাধারে কয়েক দিন ওহি বন্ধ থাকে। অবশেষে ওহি নাজিল হয় এবং প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাতে এ বিষয়েও শিক্ষাদান করা হয়।
তাহলে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনী থেকেই আমরা জানতে পারি। তাওফিক লাভের জন্য ইনশাআল্লাহ কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বেশি বেশি ইবাদতের জন্য খালেস দিল ও ভবিষ্যতের কাজ ঠিকঠাকভাবে করার জন্য ইনশাআল্লাহ বলা এবং সে অনুযায়ী চেষ্টা করা একজন মুমিনের জন্য সত্যিই অপরিহার্য। কিন্তু ইনশাআল্লাহ বলার পরেও কখনো যদি কোনো কাজ করা হয়ে না উঠে, তখন মনে রাখতে হবে, তাহলে হয়তো ওই কাজ নিশ্চয়ই আমার জন্য কল্যাণকর ছিল না। বাহ্যিকভাবে ভালো মনে হলেও এর তাৎপর্য একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ভালো জানেন।
তাই ভালো কাজের তাওফিক চাওয়ার পাশাপাশি আমাদের উচিৎ সর্বদা ‘ইনশাআল্লাহ’ বলার অভ্যাস গড়ে তোলা। তাহলেই মুমিন হিসেবে আমরা পরিপূর্ণ সফলতা লাভ করতে পারব ইনশাআল্লাহ।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ