ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভাসানীর জন্মদিন ও কাগমারী সম্মেলনের ইতিবৃত্ত

প্রকাশনার সময়: ১২ ডিসেম্বর ২০২২, ১৪:১৭

মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ১৪২তম জন্মদিন আজ। তিনি ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার জীবনের বড় অংশই কাটিয়েছেন টাঙ্গাইলের সন্তোষে। তিনি তার কৈশোর-যৌবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি তৎকালীন বাংলা-আসাম প্রদেশ মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। মওলানা ভাসানী দেশের নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির জন্য সারা জীবন আন্দোলন ও সংগ্রাম করেছেন। লাইন-প্রথা উচ্ছেদ, জমিদারদের নির্যাতন বিরোধী আন্দোলনে সারাজীবনই তিনি সাধারণ মানুষের কল্যাণে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। তার উদ্যোগে ১৯৫৭ সালে কাগমারীতে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন বাংলাদেশের রাজনীতিতে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি সর্বদলীয় ওয়ার কাউন্সিলের উপদেষ্টা ছিলেন। স্বাধীনতার পর তার সর্বশেষ কীর্তি ছিল ফারাক্কা লং মার্চ।

'কাগমারী সম্মেলন' নামটি শুনলে যে মানুষটির কথা স্মরণে আসে তিনি হলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। প্রসঙ্গত, এ সম্মেলনের ইতিহাস ও ফলপ্রসূতার সাথে এই মানুষটির আদর্শ গভীরভাবে সম্পৃক্ত। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের পক্ষ থেকে এক বজ্রধ্বনি। বিশ্বের বুকে তিনি এমনই এক রাজনীতিক, যিনি ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েও নিপীড়িত মানুষদের স্বার্থ রক্ষার্থে সে ক্ষমতার আসন ত্যাগ করে হয়ে উঠেছেন গণমানুষের নেতা। যিনি সমভাবাপন্ন মানুষদের সমন্বয়ে যেমনি রাজনৈতিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ঠিক তেমনি আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবার ঘটনায় তিনি সে রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে প্রত্যাবর্তনে দ্বিধাবোধ করেন নি। জীবন সারাংশের বিভিন্ন অধ্যায়ে তিনি ফকির আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলনের মতো সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বেশকিছু আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

এক পর্যায়ে তিনি অনুভব করেন, জনসাধারণের মুক্তির জন্য রাজনৈতিক আন্দোলন খুব গুরুত্বপূর্ণ। সে বিশ্বাস থেকেই তিনি ধীরে ধীরে রাজনৈতিক পথে ধাবিত হতে শুরু করেন নিজের আদর্শ ও আস্থা অবিচল রেখে। ১৯৩৭সালে তিনি আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। সেসময় লাইন প্রথার বিরোধিতা করে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯৪৪সালে মওলানা ভাসানী আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৫-৪৬ সালে আসাম জুড়ে মুসলিম লীগের সমর্থনে বাঙালিদের বিরুদ্ধে 'বাঙ্গাল খেদাও' আন্দোলন শুরু হলে ব্যাপক দাঙ্গা দেখা দেয়। সেসময় তিনি মুসলিম লীগের পক্ষ ত্যাগ করে এ আন্দোলনের বিরোধিতা করেন। ১৯৪৭সালে পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নেয়ার নিমিত্তে তিনি কারাবরণ করেন।

কারাভোগ শেষে ১৯৪৮সালে দেশে ফিরে তিনি বুঝতে পারেন, পাকিস্তান স্বাধীন হবার পরও নিরীহ-নিপীড়িত বাঙালিদের মুক্তি মেলেনি। তখন, তিনি সেসময়কার বিরোধী দলগুলিকে নিয়ে সম্মেলনের আয়োজন করেন। ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন, ঢাকার টিকাটুলীর কে. এম. দাস লেনের 'রোজ গার্ডেন' প্যালেসে ঐতিহাসিক এ সম্মেলন আয়োজিত হয়। সে সম্মেলন থেকেই জন্ম হয় একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দল 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ'। সর্বসম্মতিক্রমে, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দলটির সভাপতি ও শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং এ.কে. রফিকুল ইসলাম।

এই দলটি গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো- পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে বাংলার নিপীড়িত মানুষকে মুক্ত করা। ১৯৫৩ সালের ৩রা ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তানের গণতন্ত্রী দল ও নেজামে ইসলাম দল মিলে গঠন করে নির্বাচনভিত্তিক বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট যুক্তফ্রন্ট। ১৯৫৪ সালের ৮ই মার্চ থেকে ১২ই মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পায়। এর মধ্যে, এককভাবে ১৪৩টি আসন পায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। ২৪ বছরের পাকিস্তান শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে দু'বছর প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল। ১৯৫৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে দলের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দেওয়া হয়; নতুন নাম রাখা হয়: 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ'।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কোয়ালিশন সরকারের দায়িত্বে থাকার সময় পাকিস্তান সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক চুক্তি করে। এর পাশাপাশি সেসময় বাগদাদ চুক্তি, সিয়েটো চুক্তিসহ বেশ কয়েকটি চুক্তিতে পাকিস্তান অন্তর্ভুক্ত হয়। দলীয় প্রধান মওলানা ভাসানী এসকল চুক্তির বিরোধিতা করেন। তিনি মনে করেন, এ চুক্তির মাধ্যমে ইঙ্গো-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চেতনা বীজ পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর হৃদয়ে অঙ্কুরোদগম হবে; যা বাংলার নিপীড়িত মানুষের অধিকার ও এদেশের মানুষের স্বাধিকার আন্দোলনকে খর্ব করবে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মওলানা ভাসানীর এ দাবিকে অগ্রাহ্য করেন। দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সমর্থন করেন। মতপার্থক্যের কারণে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ -এর মধ্যে ভাঙন শুরু হয়।

এমতাবস্থায়, মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালের ৬ থেকে ১০ই ফেব্রুয়ারী টাঙ্গাইল শহরের অদূরে কাগমারীতে এক বিশাল সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আহ্বান করেন। সম্মেলনের নাম দেন- 'পাকিস্তান শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্মেলন'। সম্মেলনে দেশের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ভারতীয় কবি তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়সহ দেশের কবি-সাহিত্যিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, দিনমজুরসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ অংশ নেন। সম্মেলন উপলক্ষ্যে সেদিন টাঙ্গাইল শহর থেকে কাগমারী পর্যন্ত সড়কে বিশ্বের মহামানবদের স্মরণে ৫১টি তোরণ নির্মাণ করা হয়। তন্মধ্যে, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তোরণ, ইমাম গাজ্জালী তোরণ, মহাত্না গান্ধী তোরণ, লেনিন তোরণ, কাজী নজরুল ইসলাম তোরণ, পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু তোরণ, কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তোরণ উল্লেখযোগ্য। সে সম্মেলনে দাঁড়িয়ে ভাষণে মওলানা ভাসানী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সাম্রাজ্যবাদী চুক্তিগুলি থেকে সরে আসার আহ্বান জানান। সে ভাষণে মওলানা ভাসানী দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেন- বাংলার মানুষের ওপর পাকিস্তান সরকারের এ নির্যাতন-নিপীড়ন যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে আগামী দশ বছরের মধ্যে বাংলার মানুষ পাকিস্তানকে 'আসসালামু আলাইকুম' তথা বিদায় জানাবে।

মওলানা ভাসানীর এ বক্তব্য বাংলার স্বাধীনতাকামী জনগণের মধ্যে স্বাধিকার আন্দোলনের বীজ বপন করে। যার চূড়ান্ত পরিণতি হয় ১৯৭১সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। এর থেকে বোঝা যায়, বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের পেছনে যে ঐতিহাসিক ঘটনাবলির রচনা হয়েছে, তার সূতিকাগার এ কাগমারী সম্মেলন। কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর উত্থাপিত দাবিগুলি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গ্রাহ্য করেননি। দলীয় এ মতানৈক্যের জের ধরে মওলানা ভাসানী 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ' এর সভাপতিত্বের পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং দল থেকে বেরিয়ে এসে ১৯৫৭ সালের ২৪ থেকে ২৫শে জুলাই এক গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনে গঠন করেন 'ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি' বা 'ন্যাপ', যা বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে সমাদৃত।

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতাকামী চেতনায় ও স্বাধিকার আন্দোলনে কাগমারী সম্মেলনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আর এ সম্মেলন আয়োজন ও জনসাধারণকে স্বাধীনতাকামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে যে মানুষটি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, সে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এ দেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে মর্যাদা প্রাপ্তির অবশ্যই দাবি রাখেন।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

নয়াশতাব্দী/এমএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ