মানবসত্তার মনন, বোধ বুদ্ধির বিকাশ ও চিন্তার পরিশুদ্ধতা ঘটে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে। আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি একদিকে যেমন জাতিসত্তার পরিচয় বহন করে অন্যদিকে আমাদের যাপিত জীবনের বিভিন্ন মতাদর্শ ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা আচরণের বৈচিত্র্যও প্রকাশ করে।
ধর্মীয় আবেগও এই সংস্কৃতিরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ যেখানে বাঙালি মুসলমান তার চিরদিনের ধর্মভীরুতাকে সাংস্কৃতিক রূপ দেয়। বঙ্গদেশে ইসলাম প্রবেশের পর আরবীয় ইসলামের রূপ বঙ্গীয় ইসলামে পরিণত হয়। ফলস্বরূপ, ইসলামের মৌলিক আয়োজন থেকে শুরু করে এর রীতিনীতি কিংবা উৎসব উদযাপনেও ইসলামী সংস্কৃতির সাথে বঙ্গীয় সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটবে --এটি স্বাভাবিক।
ঈদ উদযাপন থেকে শুরু করে ইসলামের নানা অনুষঙ্গে তাই বাঙালিয়ানার ছাপ পাওয়া যায়। বঙ্গে ঈদ উদযাপন যে কেবল ধর্মীয় রীতিনীতির অংশ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে এমনটি নয়, বরং বাঙালির এই ঈদ-উৎসব বঙ্গে অসাম্প্রদায়িক চেতনার জন্ম দেয় যেখানে ইসলামী দর্শনেও সেটির কোনো বিরোধিতা নেই। ইসলামী ভাবধারায় ইদকে যেখানে একটি অসাম্প্রদায়িক উৎসবের দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করা হয় বাঙালির ঈদ উৎসব যেন সেটারই অনন্য উদাহরণ।
বাঙালির ঈদ উৎসবে বাঙালি মুসলমান অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষের সাথে যেমনিভাবে সবকিছু ভাগাভাগি করে নেয় তেমনিভাবে অন্য ধর্মে বিশ্বাসী বাঙালিরাও ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে কার্পণ্যবোধ করে না। ধর্মীয় বিশ্বাসে আলাদা হয়েও অনেক বাঙালি নারীরা একে অন্যের হাতে মেহেদি লাগিয়ে দেয়; পিঠা, পায়েস, সেমাই পাঠিয়ে দেয় একে অন্যর বাড়িতে, এমনকি সাঁজ পোশাকেও তারা অনেকে অংশ নেয়-এসবকিছুই যেন এক অসাম্প্রদায়িক চেতনাকেই লালন করে। এখনকার সময়েও তারা একে অন্যকে ঈদ শুভেচ্ছা পাঠায়, একসাথে ঘুরতেও বের হয় অনেকে।
অন্যদিকে, একসময়কার গ্রামীণ ইদগুলোতে ঘুড়ি ওড়ানোসহ বিভিন্ন খেলাধুলার প্রতিযোগিতা বা গ্রামাঞ্চলে নৌকা বাইচ বা হাডুডু, কাবাডির আয়োজন করা হতো। বাঙালি মুসলিম মানসে শুধু নয়, একই সাথে সকল ধর্ম বর্ণের মানুষজনও এধরণের আয়োজনে অংশ নিতো।
ধর্মের মূল বাণী মানুষকে মানুষ হিসেবে পরিচয় দেয়া; অন্য ধর্মের মানুষকে ঘৃণা করার শিক্ষা কোনো ধর্মেই নেই। কোনো ধর্মই সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেয় না; শুধু নিজের ধর্মকেই বড় করে দেখে অন্য সব ধর্মকে ছোট করে দেখা– এটি কখনোই ইসলামের ধর্মেরও শিক্ষা নয়।
মুসলমানদের এই ঈদ উৎসবে ধর্মীয় কার্যকলাপের পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন আয়োজনও থাকে। ঈদের নামাজ পড়া, খুতবা শোনা, যাকাত দেওয়া, ফিতরা আদায় যেমন ধর্মীয় কার্যকলাপের অংশ তেমনি সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় করা, আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া, পরিবারের সবার খোঁজখবর নেওয়া, ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করা এগুলো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের অংশ।
এসকল কার্যকলাপে পুরুষের সাথে বাঙালি মুসলিম নারীদের সমান অংশগ্রহণ সমানভাবে হওয়ার কথা থাকলেও বাঙালি নারীদের এক্ষেত্রে পিছিয়ে রাখা হয়। বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ হওয়া সত্বেও পুরুষের পাশাপাশি নারীরা ঈদের নামাজে সমানভানে অংশ নিতে পারে না; এমনকি তাদের জন্য ইদের নামাজের ব্যাবস্থাও করা হয় না– বাঙালি মুসলিম নারীদের সমান অধিকারের প্রশ্নে এটি নিয়েও ভাবতে হবে।
কবি নজরুলের বলেছিলেন, ‘আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে, তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।’
কবি নজরুল হাতে হাত মিলিয়ে যেই ঈদ উদযাপনের কথা বলেছিলেন বাঙালির এই ঈদ উৎসব যেন সেটিরই পরিশীলিত রূপ- এখানে মুসলিম কালচার কিংবা বাঙালি সংস্কৃতির কোনো দ্বন্দ্ব নেই; উভয়ই অসাম্প্রদায়িক চেতনাকেই ধারন করে।
আমাদের বাঙালির জীবনাচারে এই ইদ উৎসব যেমন আনন্দ নিয়ে আসে, আনন্দ ভাগাভাগি করতে শেখায়, অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রেরণা জাগ্রত করে, তেমনি আমাদের মাঝে ভ্রাতৃত্বেবোধ ও সম্প্রীতির সেতুবন্ধন তৈরি করে– বাঙালির ঈদ উৎসবের এই শিক্ষাই যেন হয় আামাদের চলার পাথেয়।
শিক্ষার্থী গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
নয়াশতাব্দী/জেডএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ