স্বপ্ন মানেই একটি নিছক কল্পনা নয়। স্বপ্ন মানেই বাস্তবের একটি কল্পচিত্র, স্বপ্ন মানেই গন্তব্য। স্বপ্ন আমাদের জীবনের সবচেয়ে রহস্যময় ও মজার একটি দিক। এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে যেমন পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হয়েছে, তেমনি আগামী ২৮ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশে আর একটি নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। যার নাম মেট্রোরেল। মেট্রোরেল চালুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আরও একধাপ এগিয়ে যাবে। যোগ হবে ডিজিটাল বাংলাদেশে বৈদ্যুতিক ট্রেন। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বহুল প্রতীক্ষিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হওয়ার পর এখন বাংলাদেশে আর একটি স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে চলেছে।
মেট্রোরেল এমনই একটি দ্রুতগতির পরিবহন ব্যবস্থা, যা বিশ্বের অনেক বড় শহরে গণপরিবহনের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম। ১৮৬৩ সালে লন্ডনে প্রথম দ্রুত ট্রানজিট সিস্টেম চালু করা হয়েছিল, যা এখন লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের একটি অংশ। ১৮৬৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এনওয়াইতে তার প্রথম দ্রুত ট্রানজিট রেলব্যবস্থা চালু করে এবং ১৯০৪ সালে নিউইয়র্ক সিটি সাবওয়ে প্রথমবারের জন্য খোলা হয়েছিল।
এশিয়ান দেশগুলোর মধ্যে জাপান হলো— প্রথম দেশ, যেটি ১৯২৭ সালে একটি পাতাল রেলব্যবস্থা তৈরি করে। ভারত ১৯৭২ সালে কলকাতায় তার মেট্রো সিস্টেম নির্মাণ শুরু করে। এরপরে ভারত অন্যান্য শহরেও মেট্রো রেলব্যবস্থা তৈরি করে। বর্তমানে বিশ্বের ৫৬টি দেশের ১৭৮টি শহরে ১৮০টি পাতাল রেলব্যবস্থা চালু রয়েছে। বাংলাদেশেও এবার চালু হচ্ছে স্বপ্নের মেট্রোরেল।
মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকার যানজট অনেকাংশে কমে যাবে। যাত্রীরা নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন। যাত্রা হবে আরামদায়ক, দ্রুতগতির ও নিরবচ্ছিন্ন। ঢাকার বিদ্যমান গণপরিবহন নির্ধারিত সময়ে চলাচল করতে পারছে না। যানজট লেগেই থাকে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বাসে যেতে সময় লাগে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টার বেশি। সেখানে মেট্রোরেলে উত্তরা থেকে মতিঝিল পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র ৪০ মিনিট। এটি প্রত্যাশিত যে, এ ধরনের পরিবহন মানুষের জীবনধারায় পরিবর্তন আনবে এবং তাদের উৎপাদনশীল সময় বৃদ্ধি করে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
মেট্রোরেলের উদ্বোধন হবে আগামী ২৮ ডিসেম্বর। দেশের প্রথম এই বৈদ্যুতিক ট্রেন গণপরিবহনের ক্ষেত্রে আশার এক দিগন্ত খুলে দেবে। শুরুতে মেট্রোরেল চলবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত। এ কারণে চলছে সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। মেট্রোরেল চালু হলে উত্তরা থেকে মতিঝিল হয়ে কমলাপুর রুটের যানজট কমবে, জনজীবনে স্বস্তি মিলবে। আপাতত এই সড়কের অর্ধেক অংশের বিদ্যমান সমস্যার সমাধান মিলবে। বাকি অর্ধেকের মধ্যে মতিঝিল পর্যন্ত আগামী বছরের ডিসেম্বরে এবং কমলাপুর পর্যন্ত অংশ ২০২৪ বা ২০২৫ সালের মধ্যে চালু হবে। মেট্রোরেল ছুটবে ১০০ কিলোমিটার গতিতে। শুরুতে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত আসতে সময় লাগবে প্রায় ২০ মিনিট। পরে পুরো বাণিজ্যিকভাবে চালু হলে যাত্রার সময় লাগবে ১৬ থেকে ১৭ মিনিট। মেট্রোরেল পুরোপুরি চালু হলে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী এই পরিবহনে যাতায়াত করতে পারবেন। মেট্রোরেল আমাদের দেশের জনসংখ্যাকে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির একটি নতুন যুগে আবদ্ধ করবে। উন্নত দেশগুলোয় মেট্রোরেল এবং অন্যান্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন মাধ্যমগুলোকে একত্রিত করে একটি উন্নত রুট সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে, যাতে মানুষ শুধু একটি পেমেন্ট কার্ডের মাধ্যমে তাদের গন্তব্যে ভ্রমণ করতে পারে। বাংলাদেশও উন্নত বিশ্বের মতো একইরকম ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে। সিস্টেমটি ধীরে ধীরে সব ধরনের পাবলিক ট্রান্সপোর্টে প্রসারিত করা যেতে পারে। এটি দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় ডিজিটালাইজেশন আনার পাশাপাশি ধীরে ধীরে নগদবিহীন অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
মেট্রোরেল চালুর আগে সব ধরনের প্রস্তুতি নিখুঁতভাবে যাচাই-বাছাই করে সম্পন্ন করা হয়েছে। দিনের পাশাপাশি রাতেও ট্রেন চালিয়ে দেখা হয়েছে। মেট্রোরেল চালুর পর প্রথম থেকে সব সিটে যাত্রী নেয়া হবে না। ধাপে ধাপে যাত্রীর সংখ্যা বাড়ানো হবে। ২০০ জন, ৩০০ জন এভাবে ধাপে ধাপে বাড়ানো হবে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশে ১০ সেট ট্রেন চলাচল করবে। মেট্রোরেলের সার্বিক বিষয় দেখভালের জন্য কারিগরি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি মেট্রোরেলের কার্যক্রম তদারকি কাজ করবে।
বাংলাদেশে মেট্রোরেল চালু করার জন্য সরকার ‘ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ নামে একটি প্রকল্পের ধারণা নিয়ে কাজ করছিল। অবশেষে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে, ‘ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ বা ‘মেট্রোরেল’ প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) দ্বারা অনুমোদিত হয়।
মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকা শহর থেকে জনসংখ্যার ঘনত্ব কমানো যেতে পারে। মানুষ বাসা ভাড়ায় অনেক কম খরচ করে শহরের বাইরে থাকতে পারবেন এবং অফিস ও অন্যান্য কাজে সহজে ঢাকা থেকে আসা-যাওয়া করতে পারবেন। উদাহরণস্বরূপ, গাজীপুর বা নারায়ণগঞ্জ এলাকায় বসবাসকারী লোকেরা সমস্ত রুটের কাজ হয়ে গেলে এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে মূল শহরে যেতে পারেন এবং কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে পারবেন।
কাজেই, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, মেট্রোরেল সেই স্বপ্নের প্রকল্প, যে প্রকল্প ঢাকা শহরকে বর্তমান অবস্থা থেকে আধুনিকায়নে রূপান্তর করবে। বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যতে উন্নত বিশ্বে পদার্পণ সময়ের ব্যাপার মাত্র। ধারাবাহিক উন্নয়ন অব্যাহত থাকলে সে সময় বেশি দূরেও নয়। সেই সোনালি ভবিষ্যতের উন্নত মহানগর ঢাকার অপরিহার্য অনুষঙ্গ মেট্রোরেল এখন আমাদের গণপরিবহনের নতুন সংযোজন হবে। বদলে যাবে ঢাকার দৃশ্যপট। মানুষের নির্ভাবনায় যাতায়াতের পথটি নতুন আশার আলোয় আলোকিত হলো— এ পাওয়া অনেক বড়। আসলে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি নয়। মানুষের না পাওয়া এত বেশি যে সবাই স্বপ্ন দেখতেও ভুলে গিয়েছিল। সেই মানুষ পদ্মা সেতুর পর পাবে মেট্রোরেল— এ প্রাপ্তি বিশাল। মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হোক একের পর এক— ধাপে ধাপে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ।
লেখক: সাংবাদিক
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ