ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

প্রসঙ্গ : শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থা

প্রকাশনার সময়: ০৭ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:৩৮
ছবি - প্রতীকী

সারাদেশে প্রচলিত একটি শব্দ এখন শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থা। দেশের প্রায় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকি কার্যক্রম ব্যবস্থা চালু করেছে। বাস্তবে এই শরিয়ার বিষয়টা ব্যাংকের চলমান কার্যক্রমের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ তা কি কেউ মনিটরিং করছেন? যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো শরিয়াভিত্তিক সাইন বোর্ড বা লেবেল এঁটে বর্তমান ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাচ্ছে তা তাদের পূর্বের ব্যাংকিং (পূর্বের বলতে শরিয়ার লেবেল লাগানোর আগে) এর সঙ্গে কার্যক্রমগুলোর কী পরিমাণ পার্থক্য, তা নিরূপণ করা উচিত। এই পার্থক্য সম্পর্কিত ব্যাখ্যাটাও গণমাধ্যমে আসা দরকার। দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সব কার্যক্রমের সঙ্গে ইসলামিক কিছু শব্দ জুড়ে দেয়া হচ্ছে একটি বিশেষ কৌশলে। অথচ ঐসব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কার্যক্রমগুলোর মধ্যে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, এই কার্যক্রমগুলোতে চলছে চরম অনৈতিকতা। সেই হিসেবে নির্দ্বিধায় বলা যায় ধর্মকেও ব্যবসায়িক বা কায়েমি স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার বানিয়ে স্বার্থ হাসিলের কাজটি করছে স্বার্থন্বেষী মহল বা গোষ্ঠী।

আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে শরিয়াভিত্তিক কোনো প্রথা চালু ছিল না। সেই সময় কী পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে আর বর্তমানে শরিয়ার লেবেল এঁটে কী পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে তার একটি যথাযথ পরিসংখ্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশ করা উচিত। শরিয়া প্রচলনের আগে ব্যাংকের ঋণখেলাপির হার শরিয়ার প্রচলনের পর প্রায় কয়েক গুণই বেড়েছে। তাহলে শরিয়ার নামে চালু করা অর্থনীতি দেশের জন্য কতটা কল্যাণ বয়ে আনছে তারও একটি হিসাব করার দরকার। ১৯৯০ সালে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। ২০২১ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এসে দাঁড়ায় ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। ১৯৯০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২৭ গুণ। ২০ ও ২১ সালে প্রায় পৌনে দুই বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। এই পৌনে দুই বছরে খেলাপি বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ।

বাংলাদেশের প্রথম সেনাশাসক মে. জে. জিয়া বিসমিল্লাহর ও দ্বিতীয় সেনাশাসক লে. জে এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কার্যক্রমে প্রবল বেগে ধর্মের ব্যবহার শুরু হয়। এই ধর্ম ব্যবহারের গতিধারাটা দিন দিন অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। গত পৌনে দুই বছরে অর্থনীতিতে শরিয়ার কার্যক্রম বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি তারপরও কেন অব্যাহত হারে ঋণখেলাপি বেড়েই চলেছে। সুরা বাকারাহ আয়াত নং ২৮২তে বর্ণিত আছে ‘হে বিশ্বাসীরা, যখন তোমরা নির্দিষ্ট মেয়াদে ধারে কারবার (ব্যবসা) করবে তা লিখে রাখবে। শরিয়াভিত্তিক ঋণ বিতরণের বিভিন্ন পর্যালোচনায় হাদিস অনুসারে যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা হলো,’ ‘ঋণ দাতা যখন মানুষের উপকারার্থে ঋণ প্রদান করে, তা ঋণ গ্রহীতার দীনি ও নৈতিক দায়িত্ব হবে তা যথা সম্ভব তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দেয়া। তা যদি নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ না করে টালবাহানা শুরু করে, মিথ্যা ওজর আপত্তি পেশ করে করতে লাগে, তা সঠিক কাজ হবে না’। সুরা নিসার ৫৮ নং আয়তে বলা আছে ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন হকদারদের হক তাদের নিকট পৌঁছে দিতে।’

ওপরে বর্ণিত আয়াত অনুসারে স্পষ্টত বোঝা যায় যে, ঋণ গ্রহীতার কাছে ঋণ প্রদানকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ বা ব্যক্তিরা হকদার হয়ে যায় তাই প্রত্যেক হকদারের হক পরিশোধ করার বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে ইসলাম ধর্মের আলোকে। অথচ দেখা যায় যে, হকদারের হক পরিশোধ না করে, ঋণখেলাপিরা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে এই অর্থ বিদেশ পাচার পাঠিয়ে দিচ্ছেন। বাংলাদেশের বর্তমান ঋণখেলাপির সংখ্যানুসারে দেখা যায়, শরিয়ার বর্ণনা অনুযায়ী ঋণ গ্রহীতা নির্বাচনে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণ ব্যর্থ। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে কেন শরিয়ার লেবেল নিত্য-নতুনভাবে লাগানো হচ্ছে?

যমুনা ব্যাংকের বগুড়া শাখার ভল্টে পাওয়া গেছে জাল টাকা। তাছাড়া এই ব্যাংকের ভল্টে রয়েছে অযোগ্য নোট। এবং বিনিময় করা যাবে না এরকম টাকাও পাওয়া গেছে। ব্যবহার অযোগ্য নোটের মধ্যে ৩৬৯টি ৫০০ টাকার নোট এবং ৮৬টি ১০০ টাকার নোট। সব মিলিয়ে এসব নোটের মূল্যমান ১ লাখ ৯৩ হাজার ১০০ টাকা। তাছাড়া পেমেন্ট রিফিউজ বা প্রচলনের অযোগ্য সিলযুক্ত নোটও ওই ব্যাংকের ভল্টে রয়েছে।

ইসলামিক ব্যাংক থেকে নভেম্বর মাসের ১ তারিখ থেকে ১৭ তারিখ পর্যন্ত দুই হাজার চারশত ষাট কোটি টাকা তুলে নিয়েছে একটি অসাধু চক্র। কী করে এই চক্র টাকা হাতিয়ে নিল তা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন। এটা অস্বাভাবিক লেনদেন। কারণ এ ধরনের অস্বাভাবিক লেনদেন এর আগে ঘটেনি। ইসলামিক ব্যাংক এতদবিষয়ে একটি প্রেস নোটও দিয়েছে। প্রেস নোট দিয়ে গা বাঁচানো কতটা যৌক্তিক।

বাংলাদেশের প্রথম ইসলামিক শরিয়া অনুসারে ইসলামিক ব্যাংকের পথচলা শুরু। দেশের প্রথম মৌলবাদী অর্থনীতির সূতিকাগার হলো ইসলামিক ব্যাংক। তাছাড়া ইসলামিক ব্যাংকগুলোর বিগত কয়মাসের ঋণ কেলেঙ্কারিটাও ভয়ংকর। একটি দৈনিকের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নানা উপায়ে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামিক ব্যাংক থেকে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার ঋণ ভুল তথ্যর মাধ্যমে তুলে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ইসলামিক ব্যাংক থেকে সাত হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। আর বাকি টাকা হলো, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামিক ব্যাংকের। এরাই কিন্তু শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক।

ধর্মের নামে দেশের অর্থনীতিতে চলছে এক ধরনের লুটপাট। শরিয়া নামে যে ব্যাংক বা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চলছে তা কতটা প্রকৃতার্থে শরিয়াভিত্তিক। এই প্রতিষ্ঠানগুলো যদি শরিয়াভিত্তিক নাই হয়ে থাকে তাহলে কেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক শরিয়ার নামে এ ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কার্যক্রম চালানোর অনুমোদন দিচ্ছে। বর্তমানে দেশে ধর্মটা হয়ে গেছে নিরাপত্তা ঢাল। কারণ ধর্মের নামে সাইন বোর্ড দিয়ে লুটপাট করলে তার অভ্যন্তর বিষয় নিয়ে কেউ কথা বলতে পারবে না। এতদ সম্পর্কিত বিষয়ে কোনো কথা যিনি বলবেন তাকেই নাস্তিক আখ্যা দিয়ে নাস্তানাবুদ করা হয়। ধর্মীয় অনুভূতির সঠিক সংজ্ঞা নাই।

ধর্ম নিয়ে যারা কায়েমি স্বার্থ সিদ্ধি করছে তাদের বাধা দিলে বা সমালোচনা করলে অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ তুলে সমালোচককে জেলে ঢুকানো হয়। রাষ্ট্রীয় বিধি ব্যবস্থায় এ ধরনের কিছু নিয়ম বিদ্যমান থাকায় সুযোগ নিয়ে নিচ্ছি বিশেষ একটি মহল। ১৯৪৭ সালে জিন্নাহ দ্বি-জাতি তত্ত্ব ব্যবহার করে ধর্মের নামে ক্ষমতায় বসেন। ব্যক্তি জীবনে মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ কোনো দিনই ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন না। পূর্ব বাংলার মানুষ পাকিস্তানের এই ধর্ম ব্যবহারের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য বাংলাদেশকে স্বাধীন করে। আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে এসে দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানি আমলের চাইতে বেশি শোষণ করা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে ধর্মের নামে।

সুতরাং রাষ্ট্রসহ সমাজের সর্বস্তরে ধর্মের ব্যবহারটা নিষিদ্ধ করা দরকার।

লেখক : কলামিস্ট

নয়া শতাব্দী/আরআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ