ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বায়ুদূষণ ঠেকানো এখন সময়ের দাবি

প্রকাশনার সময়: ০২ ডিসেম্বর ২০২২, ১০:২১ | আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২২, ১০:৫৫

পৃথিবীতে অনেক শহর আছে, যেখানে একটিও নদী নেই। সেখানে ঢাকার চারপাশে চারটি নদী। আমরা সেগুলো কাজে লাগাতে পারিনি। সড়ক, নদী ও রেল— সব পথকে সমন্বয় করে গণপরিবহনের কথা বলা হয়েছিল সরকারের ২০১৩ সালের একটি পরিকল্পনায়। চমৎকার পরিকল্পনা ছিল সেটি। আমাদের ভূমি কম, জনসংখ্যা বেশি— সেই বিবেচনায় ভারসাম্যপূর্ণ একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা করতে হলে নদী কিছু চাপ নেবে, সড়ক কিছু চাপ নেবে, রেল কিছু চাপ নেবে। সেই সম্ভাবনাগুলোই কিন্তু মাল্টি মোডাল ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম নামের পরিকল্পনাটিতে বলা হয়েছিল। ওখানে যে কথাগুলো বলা হয়েছিল, সেগুলো কিছুই মানা হয়নি। নদীগুলো দখল হয়ে গেছে। সেতুগুলো হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে।

প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশেও একরৈখিক উন্নয়ন ভাবনার কেন্দ্রে ঢাকা। পাকিস্তান আমলের ২৪ বছর ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানী ছিল। স্বাধীনতার পর ৫২ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। অথচ দেশের একমাত্র মহানগর ঢাকা আজও নির্মাণাধীন। অবকাঠামো, স্থাপনা, বহুতল ভবন, সড়ক, ড্রেনেজ ব্যবস্থা না অন্য কিছু ৫০ বা ১০০ বছরের পরিকল্পনা করে নির্মাণ হয় না। ভাঙা ও গড়ার কাজ একসঙ্গেই চলছে। ঢাকার উন্নয়ন ও সেবার সঙ্গে ডজনখানেক সংস্থা জড়িত। কেন্দ্রীয় কোনো সমন্বয় না থাকায় আমাদের রাজার রাজত্বে, আমরা সবাই রাজা। যে সড়ক তিন মাস আগে ওয়াসা খুঁড়ল, সেই সড়ক আবার তিন মাস পরে ডেসা খোঁড়ে। কোনো নিয়মের ব্যতিক্রম ছাড়াই এভাবেই চলছে দিনের পর দিন। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে মেগা প্রকল্প। মেয়াদ বাড়ে, প্রকল্প ব্যয় বাড়ে। এসব অবকাঠামো উন্নয়নে কিছু মানুষ আলাদিনের চেরাগের দৈত্য হাতে পেয়ে যায়। আবার নীতিনির্ধারকদের আকাঙ্ক্ষা পূরণেও আইকনিক স্থাপনা ভেঙে আধুনিক স্থাপনাও তৈরি হতে থাকে। ঢাকার ঘরে ঘরে এখন কাশির দমকে কান পাতা দায়। সড়ক-অলিগলি সর্দি, কাশিতে আক্রান্ত মানুষে পূর্ণ। শিশু, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ কিংবা বয়স্ক নাগরিকরা হরেদরে শ্বাসকষ্টসহ ফুসফুসের নানা অসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন। শক্তসামর্থ্যরাও রেহাই পাচ্ছেন না।

১৪ নভেম্বর যেদিন বায়ুদূষণে প্রথম হয়েছিল, সেদিন ঢাকার বায়ু মান সূচক ছিল ১৯৫। বাতাসের মান অনুযায়ী অস্বাস্থ্যকর। একিউআই স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে স্বাস্থ্যসতর্কতাসহ জরুরি অবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। শিশু, প্রবীণ ও অসুস্থ রোগীদের বাড়ির ভেতরে এবং অন্যদের বাড়ির বাইরের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেয়া হয়। ছুটির দিন বাদে ঢাকার বাতাস গত কয়েক দিনে দূষণের সূচক কমবেশি একই রকম।

শীত শুরুর আগের সময়টাতে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের অন্যতম শিরোনাম থাকে দিল্লির দূষণ। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর একটি দিল্লি। ধান ওঠার পর পাঞ্জাবের কৃষকরা নাড়া পোড়ান তাদের খেতে। সেই ধোঁয়া বাতাসের সঙ্গে দিল্লিতে প্রবেশ করে। সেখানকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ধুলা, সিসা, ভারী কণা কিংবা তেলচালিত গাড়ির পোড়া কার্বন তাতে মিশে পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। দূষণের হাত থেকে নগরবাসীকে রক্ষার জন্য এ সময়টাতে দিল্লি সরকার রেড অ্যালার্ট জারি করে। মারাত্মক দূষিত বাতাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন শিশু আর বৃদ্ধরা। ফলে শিশুদের আপাত সুরক্ষার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়। জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের ঘরের বাইরে বেরোতে বারণ করা হয়। সরকারি কর্মীদের সশরীর অফিস আসা বন্ধ করে হোম অফিস চালু করা হয়। জোড়-বিজোড় নম্বরের গাড়ি পালা করে বন্ধ রাখা হয়।

কয়েক বছর আগে দিল্লিতে অক্সিজেন ক্যাফে চালুর সংবাদও পাওয়া যায়। বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেট এ বছরের মে মাসে বিশ্বে দূষণজনিত মৃত্যুর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিজ্ঞান সাময়িকীটি জানিয়েছে, বায়ু, পানি, মাটি ও রাসায়নিক দূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। দূষণজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ষষ্ঠ। ২৩ লাখ মৃত্যু নিয়ে শীর্ষ স্থানে আছে ভারত। তবে এককভাবে বায়ুদূষণে মৃত্যুর বিচারে ভারতের পরেই বাংলাদেশের স্থান।

এরপরেই আছে নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা। দূষণ ও দূষণজনিত মৃত্যুতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো ও এখানকার নগরগুলো কেন শীর্ষে থাকছে, তার পেছনে কী কী কারণ আছে, তা বের করা জরুরি। কিন্তু এতে প্রাণ-প্রকৃতি-মানুষ বিচ্ছিন্ন একরৈখিক উন্নয়ন ধারণার যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লেখক ও আন্দোলনকর্মী অরুন্ধতী রায় কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে এ প্রবণতাকে বলেছিলেন, সব দেশ থেকে প্রাণরস নিংড়ে নিয়ে একটা বা দুটো নগরে সমৃদ্ধি গড়ে তোলা। এ ধরনের বাতাসে বাইরে বের হওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু পরিবেশদূষণ এখনও আমাদের নীতিনির্ধারকদের কাছে লিখিত নীতির মতো বিষয়। এটা কমিয়ে আনার কোনো পদক্ষেপ কোথাও কারও ভেতরে নেই। এখানে যে পরিমাণ দূষণ, তাতে ঘরের বাইরে বের হলে মাস্ক না পরে বের হওয়াটা অপরাধ। কিন্তু এই অপরাধটা কী ভুক্তভোগী নাগরিকদের? বাতাসে ভয়াবহ মাত্রার দূষণ অথচ সরকার, সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদফতরের কর্তাব্যক্তিদের বিকার নেই কেন?

ঢাকার বাতাস ভয়াবহ দূষণের জন্য অন্যতম কারণ চারপাশের ইটভাটা। উচ্চ আদালত কয়েক দিন আগে সারাদেশে অবৈধ ইটের ভাটা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগেও উচ্চ আদালত সড়কে পানি ছিটানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন এসব পদক্ষেপ হয়তো দিঘির পানিতে শৈবালের দেয়া কয়েক ফোঁটা শিশিরের মতো। তাতে পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি নাও হতে পারে। শুধু একবার চোখ বন্ধ করে ভাবতে চেষ্টা করুন, দূষণে বছরে দুই লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এর চেয়ে বড় মহামারি আর কী? আমাদের একচোখা উন্নয়ন ভাবনা থেকে কবে বেরিয়ে আসতে পারব আমরা। মোগলদের সময়ে দিল্লি গোটা ভারতবর্ষের রাজধানী। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতিকূলতার কারণেই দিল্লি পৌঁছানো খুব সহজ ছিল না। সে কারণেই হয়তো দিল্লি এখনও ঢের দূর প্রবাদটির প্রচলন হয়েছে।

কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে শীত শুরুর এই সময়টাতে ঢাকা, দিল্লির খুব কাছে চলে আসে। দূষণে কে কাকে পেছনে ফেলবে, এ নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে। ১৪ নভেম্বর সকালে বায়ুদূষণে দিল্লিকে হারিয়ে প্রথম স্থান দখল করে ফেলে ঢাকা। কয়েক ঘণ্টা পর অবশ্য সেই জায়গা দখল করে নেয় দিল্লি। এ তথ্য সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ারের। কোনো কোনো প্রথম হওয়া শুধু গ্লানির নয়, চরম ভোগান্তি আর শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতিরও কারণ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপে বায়ু, পানি, আর্সেনিক. পরিবেশদূষণে প্রথম সারিতে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ, বিশেষ করে ঢাকা। আর একটি দূষণেও আমরা সম্মুখসারিতে আছি বছরের পর বছর ধরে। সেটা মানসিক দূষণ, কেতাবি বাংলায় যাকে দুর্নীতি বলি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দুর্নীতি আর দূষণ প্রকৃতপক্ষেই মানিক জোড়।

এসব কারণে বিশ্বের বাস অযোগ্য নগরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান সপ্তম। একসময় এ দেশে রোগীর আয়ু বাড়ানোর জন্য চিকিৎসকরা হাওয়া বদল করতে পাঠাতেন। আর এখন সেই হাওয়াই বদলে গিয়ে আয়ু কেড়ে নিচ্ছে মানুষের। করোনার কারণে কত মানুষ মারা গিয়েছে, সে সংখ্যা নিশ্চয়ই সবার জানা আছে। কিন্তু অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য লাগতে পারে, এই বুক-ভরা-মধু বঙ্গের দেড় লক্ষাধিক মানুষ প্রতিবছর মারা যাচ্ছে শুধু দূষিত বায়ুর কারণেই। বৈশ্বিক বায়ুমান নিয়ে মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার তাদের ২০২০ সালের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯ সালে দূষিত বায়ুর কারণে বাংলাদেশে ১ লাখ ৭৪ হাজার মানুষ মারা গেছে। সে বছরে অল্প বয়সি শিশুদের মৃত্যুর ২০ শতাংশই ঘটেছে দূষিত বায়ুর কারণে। প্রতিটি শিশুর আয়ু ৩০ মাস করে কমে যাচ্ছে শুধু বায়ুদূষণের কারণে। প্রায় পৌনে এক লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে ঘরের বাইরে বাতাসে ক্ষতিকর অতি সূক্ষ্ম কণা পিএম-২.৫-এর কারণে।

অথচ বাতাসে এ কণার উপস্থিতি হিসাব করেই সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বৈশ্বিক বায়ুমান পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার ২০২১ সালের প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় ১ নম্বরে দেখা যায় বাংলাদেশকে। যা বোঝা যাচ্ছে, বিশ্বের সবচেয়ে কষ্ট বা যন্ত্রণাসহিষ্ণু দেশ হিসেবেও কোনো র‍্যাংকিংয়ে শীর্ষে চলে আসতে পারি আমরা। এখন এ পরিস্থিতি থেকে আদৌ কখনও উত্তরণ ঘটবে, সেটি কারও বলার সাধ্য নেই। সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলার মাটি, জল, বায়ুর এমন হাল হবে, সেটিও কি বুঝে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ? এর যে সহজে কোনো কূলকিনারা হবে না এবং দুঃখের পরে পরম দুঃখ সইয়ে যেতে হবে আমাদের! এ জন্য হয়তো সৃষ্টিকর্তার কাছে আমাদের হয়েই অনুযোগ জানিয়ে গিয়েছেন এভাবে, যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

বায়ুদূষণের কারণে সারাবিশ্বের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় অন্য দেশের মানুষ আমাদের দেশে আসতে নিরুৎসাহিত হবে। দেশে বিনিয়োগ কম হবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। তাই বায়ুদূষণ নিছক পরিবেশগত ইস্যু নয়, এর সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিও সরাসরি জড়িত। শুধু বাঙালিজীবন নয়, বাংলার রূপবৈচিত্র্য, প্রকৃতি, সংস্কৃতি তার মতো করে কে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। এটি বলা খুব বেশি অমূলক হবে না, বিশ্বের আনাচে-কানাচে কত লোকের এই বাংলার প্রেমে পড়ার শুরুই হয় রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে। তাঁর লেখনীর জাদুর টানে কত কত ভিনদেশি মানুষ এ বাংলার জলে তৃষ্ণা মিটিয়েছে, প্রাণ জুড়িয়েছে ঋতু-রকমফেরের হাওয়ায়, বুকভরা বাতাস নিয়ে দৌড়ে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে নদীর তীরে এসে দাঁড়িয়ে গেয়ে উঠেছে, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

নয়া শতাব্দী/আরআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ