বিশ্ব এইডস দিবস আজ। বাংলাদেশে প্রতিবারের মতো এবারও দিবসটি পালন করার যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বিশ্ব এইডস দিবস হলো একটি আন্তর্জাতিক দিবস। ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি বছর ১ ডিসেম্বর দিনটিকে বেছে নেয়া হয়। এইচআইভি সংক্রমণের জন্য এইডস মহামারি ছড়িয়ে পড়ার বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে এবং যারা এ রোগে মারা গেছেন তাদের প্রতি শোক পালন করতে এ দিনটিকে বেছে নেয়া হয়েছে। সরকারি ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, বেসরকারি সংস্থাগুলো এবং বিশ্বে বিভিন্ন ব্যক্তি, এইডস প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সবাইকে সচেতন করতে এই দিনটি পালন করে আসছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দাবি করেছেন, গত ৩০ বছরেরও বেশি সময়ে সাড়ে ৭ কোটি মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত ঠিক কোথা থেকে এইচআইভি ভাইরাস এসেছে, তা শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। গবেষকরা বলেন, আফ্রিকার বেলজিয়ান কঙ্গোর রাজধানী কিনসাসা থেকে ১৯২০ সালের দিক প্রথম এইচআইভি ছড়ানোর প্রমাণ মিলেছে।
গবেষক অলিভার পাইবাস এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা প্রথমবারের মতো সব সহজলভ্য প্রমাণ ফাইলোজিওগ্রাফিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করি। এতে ভাইরাসটি কোথা থেকে এসেছে তা পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে ধারণা করা সম্ভব হয়। এর অর্থ ভাইরাসের উৎপত্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেই বলা সম্ভব।
গবেষক নুনো ফারিয়া এ প্রসঙ্গে বলেন, কিনসাসা ওই সময় দ্রুত এগিয়ে চলছিল। মধ্য আফ্রিকার বৃহত্তম শহর হিসেবে পুরো কঙ্গোর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। ঔপনিবেশিক আমলের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৪০ সালের শেষ নাগাদ প্রতি বছর রেলে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ কিনসাসায় যেতেন। জেনেটিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কঙ্গোতে দ্রুত এইচআইভি ছড়িয়ে পড়ে।
২০১৭-এর হিসাব অনুযায়ী, এইডসের জন্য বিশ্বজুড়ে ২৮.৯ মিলিয়ন থেকে ৪১.৫ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছেন এবং আনুমানিক ৩৬.৭ মিলিয়ন মানুষ এইচআইভি সংক্রামিত হয়ে বেঁচে আছে। এর ফলে এটি নথিভুক্ত ইতিহাস অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ অন্যতম জনস্বাস্থ্য বিষয় হিসেবে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের অনেক অঞ্চলে সাম্প্রতিক উন্নত অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল চিকিৎসা পৌঁছানোর ফলে ২০০৫ সালে সর্বোচ্চ সংখ্যায় মৃত্যুর পর এইডস মহামারি থেকে মৃত্যুর হার কমেছে (২০১৬ সালে ১ মিলিয়ন, যেখানে ২০০৫ সালে ছিল ১.৯ মিলিয়ন)।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় এইডস সম্পর্কিত বিশ্ব কর্মসূচির দুজন জনতথ্য কর্মকর্তা জেমস ডব্লু বুন এবং টমাস নেটটার দ্বারা ১৯৮৭ সালের আগস্টে প্রথম বিশ্ব এইডস দিবসের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এইডস সম্পর্কিত বিশ্ব কর্মসূচির (বর্তমানে আনএইডস নামে পরিচিত) পরিচালক ড. জোনাথন মানের কাছে বুন এবং নেটটার তাদের ধারণাটির কথা জানিয়েছিলেন। ড. মান এ ধারণাটি পছন্দ করে এটির অনুমোদন করেন এবং ১৯৮৮ সালের ১ ডিসেম্বর বিশ্ব এইডস দিবসটি প্রথম পালন করা উচিত এমন পরামর্শের সঙ্গে একমত হন। সান ফ্রান্সিসকোর সাবেক টেলিভিশন সম্প্রচার সাংবাদিক বুন ১ ডিসেম্বর তারিখটির সুপারিশ করেছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল মার্কিন নির্বাচনের যথেষ্ট পরে কিন্তু বড়দিনের ছুটির আগে, পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোর দ্বারা বিশ্ব এইডস দিবসের প্রচার সর্বাধিক হবে। এর প্রথম দুই বছরে, বিশ্ব এইডস দিবসের প্রতিপাদ্য শিশু এবং তরুণদের লক্ষ্য করে তৈরি হয়েছিল। এই প্রতিপাদ্যটি বেছে নেয়ার সময়, কিছু ঘটনা উপেক্ষা করার কারণে এর সমালোচনা করে বলা হয়েছিল যেসব বয়সের লোক এইচআইভিতে আক্রান্ত হতে পারে, প্রতিপাদ্যটি রোগটিকে ঘিরে থাকা কিছু কালিমা মোচন করতে এবং পারিবারিক রোগ হিসেবে সমস্যাটির স্বীকৃতি বাড়াতে সহায়তা করেছিল। ১৯৯৬ সালে এইচআইভি/যৌথ জাতিসংঘের এইডস সম্পর্কিত কর্মসূচি (ইউএনএআইডিএস) চালু হয়েছিল, এবং এটি বিশ্ব এইডস দিবসের পরিকল্পনা ও প্রচারের দায়িত্ব অধিগ্রহণ করে। শুধু একটি দিনে মনোযোগ না দিয়ে আনএইডস ১৯৯৭ সালে বছরব্যাপী যোগাযোগ, প্রতিরোধ ও শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়ার জন্য বিশ্ব এইডস অভিযান তৈরি করেছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশের ২৮.৫ শতাংশ নারীই এইডস বিষয়ে অবগত নন। অবশ্য এইডসের অন্তত একটি বাহক সম্পর্কে অবগত ৭১.৫ শতাংশ নারী। ৩৬ শতাংশ নারী সব বাহক সম্পর্কে অবগত। পাঁচ বছর আগে ২০১৬ সালে এ হার ছিল ২৯ শতাংশ। অর্থাৎ বাহক সম্পর্কে নারীদের মধ্যে সচেতনতার হার বেড়েছে ৭ শতাংশ। যদিও ৮-১০ শতাংশ বাড়ানোর পরিকল্পনা ছিল সরকারের। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ১২ লাখ ৯১ হাজার ৬৯ জনের এইচআইভি/এইডস শনাক্তকরণ পরীক্ষা হয়েছে। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩ লাখ ৩২ হাজার ৫৮৯।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে গত বছর নতুনভাবে এইচআইভি সংক্রমিত ৭২৯ জনের মধ্যে পুরুষ ৪২০ জন, নারী ২১০ ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী ১২ জন। গত এক বছরে নতুন আক্রান্তদের মধ্যে সাধারণ জনগোষ্ঠীর ১৮৬ জন (২৬%), রোহিঙ্গা ১৮৮ জন (২৬%), বিদেশফেরত প্রবাসী ও তাদের পরিবারের সদস্য ১৪৪ জন (২০%), ইনজেকশনের মাধ্যমে শিরায় মাদক গ্রহণকারী ৬১ জন (৮%), নারী যৌনকর্মী ১৭ জন (২%), সমকামী ৬৭ জন (৯%), পুরুষ যৌনকর্মী ৫৩ জন (৭%) ও ট্রান্সজেন্ডার ১৩ জন (২%) রয়েছেন।
বিবিএস জরিপে উঠে এসেছে, দেশে ১৪ হাজারেরও বেশি এইডস রোগী শনাক্ত হয়েছেন। চিকিৎসার আওতায় এসেছেন ৮৪ শতাংশ। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালে বাংলাদেশে মৃত্যু হয় ২০৫ জনের। এখন পর্যন্ত মোট মৃত্যু হয়েছে ১,৫৮৮ জনের।
বাংলাদেশে প্রথম এইডস রোগী শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। প্রথম যিনি শনাক্ত হয়েছিলেন, তিনি এখনো সুস্থভাবে বেঁচে রয়েছেন। তিনি নিয়মিতভাবে এইচআইভি চিকিৎসা কর্মসূচির সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। সংক্রমিতদের মধ্যে রয়েছেন নারী ও পুরুষ যৌনকর্মী, সমকামী, যক্ষ্মা আক্রান্ত ব্যক্তি, প্রবাসী শ্রমিক, হাসপাতালে প্রসব সেবা নিতে আসা মা ও রোহিঙ্গা। আক্রান্তদের ৩৩ শতাংশ সাধারণ মানুষ।
এইডস হলে জ্বর, মাথা ব্যথা, ফুসকুড়ি/ পেশি বা যৌথ ব্যথা গলাব্যথা/ ফুসকুড়ি গ্রন্থি গ্রন্থি/ অবসাদ/ অতিসার/ ওজন কমে যাওয়া/ ছত্রাক সংক্রমণ এরকম হতে পারে। এ ছাড়া শুষ্ক কাশি/ বার বার জ্বর আসা। রাতের বেলায় প্রচণ্ড ঘামিয়ে যাওয়া। অনবরত এবং বর্ণনাতীত দুর্বলতা। কিছু স্থানের লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া। এক সপ্তাহের বেশি সময় ডায়রিয়া থাকলে। এর ব্যতিক্রমধর্মী কোনো দাগ জিহ্বা বা মুখের ভিতর দেখা দিলে। স্মৃতিশক্তি ধীরে ধীরে নষ্ট হওয়া ও বিষণ্নতা। এইচআইভি ও এইডস রোগের শারীরিক লক্ষণ দেখা না দিলেও তা রোগীর দেহে বিদ্যমান থাকতে পারে।
এইচআইভির প্রতিরোধের মূল উপাদান হলো শিক্ষা, সচেতনতা, ঝুঁকির মাত্রা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও ধারণা। মানুষের চিন্তায় ও আচরণের ইতিবাচক পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা এইডস প্রতিরোধের অন্যতম উপায়। যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসন মেনে চলতে হবে। বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্ক এড়িয়ে চলতে হবে। একাধিক যৌন সঙ্গী পরিহার করতে হবে। নিরাপদ যৌনক্রিয়ার অভ্যাসের মাধ্যমে অসংক্রামিত মানুষ এইচআইভি সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে পারে। নিয়মিত ও সঠিকভাবে কনডম ছাড়া যৌনমিলন থেকে বিরত থাকতে হবে। অবাধ ও অবৈধ যৌন ক্রিয়া থেকে বিরত থাকাই হলো এইচআইভি সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকার সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। যারা শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে ড্রাগ নেয়, তাদের বেলায় উৎকৃষ্ট উপায় হলো ইনজেকশনের মাধ্যমে ড্রাগ না নেয়া। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে এইচআইভি সংক্রমিত রোগীর সঙ্গে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য সুচ, সিরিঞ্জ, ব্লেড বা অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহার পরিহার করতে হবে। একবার ব্যবহার করা যায় এমন জীবাণুমুক্ত সুচ ও সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে হবে।
শরীরে রক্ত বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গ্রহণের প্রয়োজন হলে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে যে সে রক্ত বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এইচআইভি রয়েছে কি না। যৌনরোগ বা প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ থাকলে এইচআইভি আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই কারও যৌনরোগ বা প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ থাকলে দ্রুত চিকিৎসা করাতে হবে।
এইচআইভি আক্রান্ত মায়ের থেকে সন্তানের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেকখানি। তবে যেসব মায়েরা প্রয়োজনীয় থেরাপি গ্রহণ করেন, তাদের ক্ষেত্রে গর্ভস্থ সন্তান আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা শতকরা ৮৫ ভাগ।
জনসচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে প্রতিরোধমূলক তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
এইডস এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা এইচআইভি বা এইডস দুরারোগ্য ব্যাধি। ১৯৮৯ সাল থেকে ভারত সরকার পরিচালিত ক্লিনিক্যাল গবেষণায় দেখা গেছে, এইচআইভি বা এইডস রোগীদের জন্য হোমিওপ্যাথি ওষুধ কার্যকর। ভারত সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সেন্ট্রাল কাউন্সিল ফর রিসার্চ ইন হোমিওপ্যাথি কর্তৃক প্রকাশিত গবেষণাগ্রন্থ এইচআইভি/এইডস এবং হোমিওপ্যাথিক ম্যানেজমেন্ট, সারা বিশ্বের জন্য একটি আশার আলো। ২২টি হোমিওপ্যাথিক ওষুধের কিনিক্যাল স্টাডি স্থান পেয়েছে ওই গবেষণা গ্রন্থে। আমরা আশা করি, আমাদের সরকার এ ধরনের গবেষণাগ্রন্থ থেকে দিক-নির্দেশনা নিয়ে বাংলাদেশের এইচআইভি বা এইডস রোগীদের জন্য হোমিওপ্যাথি ওষুধের দরজা খুলে দেবে, যাতে করে রোগীরা হোমিওপ্যাথি ওষুধের কার্যকর ফলাফল লাভ করতে পারেন। আর যেকোনো রোগের মহামারীর সময় যে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ অধিকাংশ রোগীর চিকিৎসায় কার্যকর হয় সেই ওষুধ সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে এই রোগ প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা হোমিওপ্যাথিতে যেটা রয়েছে সেই নিরাপদ প্রাকৃতিক ব্যবস্থা নিয়েও সরকারি গবেষণার বিরাট সুযোগ রয়েছে। করোনা, ডেঙ্গু সোয়াইন ফ্লু-র মতো নতুন নতুন ব্যাধিগুলোর জন্য হোমিওপ্যাথিকের ভাণ্ডারে যে সব ওষুধ ইতোমধ্যে সঞ্চিত রয়েছে সরকারি উদ্যোগে গবেষণার মাধ্যমে সে সব ওষুধের কার্যকারিতা যাচাই করলে হোমিওপ্যাথির উন্নয়ন সাধিত হবে। এইডসে আক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচতে মানুষকে আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
চিকিৎসক, কলামিস্ট ও গবেষক।
নয়াশতাব্দী/এমএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ