দেশের মানুষের বিভিন্ন চলমান সমস্যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি বড় সমস্যা হলো যাতায়াত ব্যবস্থা। যার অবস্থা একবারেই নাজুক। চলাফেরা করতে রাস্তায় বের হলে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন সড়ক ও মহাসড়কসহ বিভিন্ন শহরে যাতায়াতের মান কতটুকু মানসম্মত। যানবাহনের বডির অবস্থা, চালক ও হেলপারের আচার-আচরণ দেখেই মানুষ বুঝতে পারে কতটুকু হবে আরামদায়ক ভ্রমণ। তারপরও সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে সড়ক/মহাসড়কে চলাচলকারী লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলোতে চলতে বাধ্য হয়। দেশের বিভিন্ন চলমান সমস্যায় মানুষ যেমন ভুগছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভোগান্তিতে ভুগছে যাতায়াত করতে গিয়ে। বাংলাদেশের এমন কোনো শহর/বন্দর বা সড়ক/মহাসড়ক নেই যেখানে ফিটনেসবিহীন লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা যানবাহন নেই। বিশেষ করে দেশের শহরগুলোতে চলাচলরত পরিবহনগুলোর বেশির ভাগ পরিবহনের কোনো ফিটনেস নেই।
পরিবহনের ফিটনেসের সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ গাড়ির চালক ও হেলপারের বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই। অথচ তারা শহরবন্দর ও সড়ক/মহাসড়কে বীরদর্পে গাড়ি চালাচ্ছে। এটা এতমাত্র সম্ভব হয় শুধু আমাদের দেশের আইনের কোনো সঠিক প্রয়োগ না থাকার কারণে। একদিকে আইনের শিথিলতা অপরদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর কতিপয় প্রভাবশালী নেতা সঙ্গে রয়েছে আইনপ্রয়োগকারী কিছু অসাধু লোকের দুর্নীতি। যার কারণে দেশের পরিবহন জগতে চলছে একটা অরাজকতা। এসবের ভোগান্তির শিকার হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষগুলো। যাদের নিজস্ব কোনো পরিবহন নেই। তারা বাধ্য হয়ে এসব লক্কড়-ঝক্কড় গাড়িতে চলতে বাধ্য হচ্ছে। ফিটনেস নেই তবুও রাজপথে। চলার যোগ্য নয় তারপরেও চলছে। গাড়ির বেহাল দশা হলেও, ফিটনেস সনদ থাকায় এসবের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না বলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন বলছে।
প্রতিদিন রাজধানীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে হাজারো মানুষ নির্ভর করেন বাসের ওপর। রাজধানীর ১৯৩টি রুটে যাত্রী নিয়ে প্রতিদিন চলে ৫ হাজারের বেশি বাস। আনফিট গাড়িগুলোর কারণে যাত্রীরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সমস্যায় ও ভোগান্তিতে পড়েন। সাধারণ যাত্রীদের জন্য পর্যাপ্ত গণপরিবহন আমাদের দেশে ও ঢাকা শহরে নেই। যা কিছু আছে তাও আবার লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা পরিবহন। দিন দিন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা সে হারে বাড়ছে না গণ পরিবহনের সংখ্যা। আর এই সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে এক ধরনের অসাধু পরিবহন ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। তারা শহর-বন্দর, সড়ক/ মহাসড়কে চলাকালে যাত্রীর চাহিদা বিবেচনা করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন রাস্তায় নামিয়ে দিচ্ছেন লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি। আনফিট গাড়িগুলো সময়ের সঙ্গে চলতে অপারগ এবং এগুলো মাঝপথেই বিকল হয়ে পরে থাকে বেশিরভাগ সময়। যখন একটি গাড়ি মাঝ পথে বিকল হয়ে পড়ে থাকবে তখন সেই গাড়ির যাত্রীরা সময়মতো অফিসে পৌঁছাতে পারবে না, একজন ব্যবসায়ী তার কাঁচামাল সময়মতো আড়তে পৌঁছাতে পারবে না কিংবা একটা ফিটনেসবিহীন অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগী বহনের সময় সেটা বিকল হয়ে গেল তখন ওই রোগীটির প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটে।
আধুনিক ঢাকার আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রধান অন্তরায় হিসেবে এসব আনফিট গাড়িগুলো দায়ী বলে মনে করেন দেশের সুশীল সমাজের লোকজন। এসব আনফিট গাড়ি যদি রাস্তা থেকে সরানো যায় তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা ৮০ ভাগ ভোগান্তিমুক্ত ও সুন্দর হবে। কিন্তু এই গাড়িগুলো খুব সহজেই সরানো যাবে না রাস্তা থেকে। এর পেছনে অনেক প্রভাবশালী মানুষজন জড়িত, এই গাড়িগুলো যে রাস্তায় চলে সেখানে তো আইনের লোক থাকে তারা মনিটরিং করলেই তো সেগুলো আর রাস্তায় চলবে না কিন্তু তারপরেও চলে। কারণ দিনে বিশাল অঙ্কের টাকা অনেকের পকেটে ঢুকে এই ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামলে।
রাজধানীতে চলা বাসগুলোর একটা অংশের এ রকম বেহাল দশা। কোনো বাসের জানালার কাঁচ ভাঙা, কোনোটির হেডলাইট, সিগন্যাল লাইট নেই। আবার কোনো বাসের সিট করছে নড়বড়, খুলে পড়ছে গাড়ির বডির বিভিন্ন অংশ। কোনোটির রং চটেছে বহু আগেই।
রাজধানীসহ সারাদেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচলের বিষয়টি আমাদের বাংলাদেশে এখন আর কোনো নতুন বিষয় নয়। বহু বছর ধরেই এসব গাড়ি নির্বিঘ্নে চলাচল করছে। এসব যানবাহন যারা চালায় তাদের অনেকের বৈধ লাইসেন্স নেই। দীর্ঘদিন ধরেই এই পরিস্থিতি চলছে। সম্প্রতি একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীতে বৈধ লাইসেন্স ছাড়া বিভিন্ন সড়কে কমপক্ষে ৯০ হাজার যানবাহন চলাচল করছে। অধিকাংশ চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। রাজধানীর প্রায় ৭০টি রুটে এসব যানবাহন চলাচল করছে। রাজধানীর বাইরের ফিটনেসবিহীন যানবাহনও প্রবেশ করছে। মাঝেমধ্যে পুলিশ ও বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে অভিযান চালালেও তার কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। নির্বাধেই এসব যানবাহন চলাচল করছে। রাজধানীতেই যদি এত ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন চালক বহাল থাকে, তাহলে দেশের অন্যান্য জেলা শহরের যানবাহনের কী অবস্থা, তা সহজেই অনুমেয়। এসব যানবাহন একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণ করছে, অন্যদিকে যানজট সৃষ্টি ও দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মানুষকে আহত-নিহত করছে। বছরের পর বছর ধরে সড়কে এ ধরনের অরাজকতা চললেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ ও পুলিশ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজধানীতে প্রায় ২০ লাখ নিবন্ধিত যানবাহ চলাচল করে। এর মধ্যে বেশিরভাগই প্রাইভেট গাড়ি। ৫ লাখ হালকা গাড়ি। এর মধ্যেই ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল করছে। এসব যানবাহন শনাক্তের জন্য কোনো বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন পড়ে না। একজন সাধারণ মানুষও সহজেই বুঝতে পারে। বিশ্বের কোনো রাজধানীতে এমন ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল করে কিনা, তা আমাদের জানা নেই। বলা হয়ে থাকে, রাজধানীসহ যে কোনো শহরের যানবাহনের দৃশ্য সেই শহরের সৌন্দর্যের অন্যতম প্রতীক। সভ্যতারও প্রকাশ ঘটায়। উন্নত বিশ্বের গণপরিবহন ও সেগুলোর সৌন্দর্য ও সুযোগ-সুবিধা এতই যে, মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ির চেয়ে সেগুলোতেই বেশি চলাচল করে।
ঢাকার গণপরিবহন হিসেবে বাস, মিনিবাস এমনকি বিআরটিসি বাসের দিকে তাকালে যে কেউ বুঝতে পারবে, আমরা কোনো সভ্য নগরে বসবাস করছি না। আমরা উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছি, উন্নয়নের ডামাডোলের মধ্যে আছি, অথচ আজ পর্যন্ত গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করতে পারিনি। যেখানে বলা হচ্ছে, উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নতির অন্যতম প্রধান শর্ত, সেখানে অবাধে চলছে ভাঙাচোরা ফিটনেসবিহীন যানবাহন। বছরের পর বছর ধরে দেশে যানবাহন ব্যবস্থা বেহাল অবস্থায় রয়েছে। এসব ফিটনেসবিহীন গাড়িতেই বেশি ভাড়া দিয়ে বাধ্য হয়ে যাত্রীদের যাতায়াত করতে হচ্ছে। বলা যায়, যাত্রীরা এক প্রকার জিম্মি হয়ে রয়েছে। এসব যানবাহনের অধিকাংশ চালকের বৈধ লাইসেন্স নেই। এ থেকে বুঝতে বাকি থাকে না, রাজধানীর গণপরিবহন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিরাপদ। অভিযোগ রয়েছে, ট্রাফিক পুলিশও এগুলোর বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয় না। এর কারণ হিসেবে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এসব ফিটনেসবিহীন গাড়ি থেকে উৎকোচ বাণিজ্য কম হয়। এর বিপরীতে ফিট ও বৈধ গাড়ির ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরতে পারলে সেগুলো বেশি বাণিজ্য হয়। ফলে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের দিকে তাদের নজর কম থাকে।
ফিটনেসবিহীন যানবাহন এবং বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া চালক এই দুইয়ের কারণে রাজধানীতে এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি চলছে। বৈধ লাইসেন্সবিহীন চালকরা বেপরোয়া হয়ে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে নিহত ও পঙ্গু হচ্ছে। শুধু এসব যানবাহনের বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন চালকই নয়, অসংখ্য টেম্পোর চালক শিশু, যাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। এরাও বেপরোয়াভাবে চালিয়ে যানজট ও দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। এসব অনিয়ম জানা থাকলেও পুলিশ ও বিআরটিএ’র কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় রাজধানীতে ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন চালক বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে।
পরিবহন জগতে সুশৃঙ্খলা ফিরে আসলে মানুষের উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের সামগ্রীক দিক পরিবর্তন হয়ে যাবে। মানুষ অতি সহজে ব্যবসা-বাণিজ্যের মালামাল পরিবহন করতে পারবে সাশ্রয়ে ও অল্প সময়ে। এত মানুষ লাভবান হবে, মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে মনোনিবেশ করবে। দেশের বেকার সমস্যারও সমাধান হবে। অতএব উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা দেশের ও মানুষের জীবনযাত্রার মানকেও পাল্টে দেবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ