অর্থনীতিতে যদি কালো টাকা বৈধ টাকাকে চাপে ফেলে। আধিপত্য তৈরি হয় কালো টাকার। দুষ্টকে পরিপুষ্ট করে। দুর্জনের চাপে সভ্য জন চিড়েচ্যাপ্টা হয়। একটা রাষ্ট্রের জন্য তা বড় বিপজ্জনক। কালো টাকার মালিক সর্বত্র অতি মুনাফার চেষ্টা করে। এরা মিলে তৈরি করে চক্র। তারাই হয়ে পড়তে চায় নিয়ন্ত্রক। ১৯৭৩ সালে আমাদের মোট জিডিপির ৭% ছিল কালো টাকা। সেই কালো টাকা বাড়তে বাড়তে ২০২১-২০২২ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৭৫%, ১৯৭৫ সালে প্রথম কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়। সেই সুযোগ অব্যাহতভাবে বারবার দিতে দিতে কালো টাকা অর্থনীতিতে আগ্রাসী রূপ ধারণ করছে। রাষ্ট্র যদি সুস্থ ধারার অর্থনীতি বাস্তবায়ন না করতে পারে। তবে তার সুযোগ নেবে অতি লোভী দুর্বৃত্তরা।
রাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হবে সভ্য মানুষের পক্ষে। তা না হলে সমাজে অর্থনৈতিক সামাজিক রাজনীতি, ব্যবসা, বাণিজ্য, জীবনযাপন শিক্ষা সংস্কৃতি সবখানে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। এক সময় বর্গি, তারপর ব্রিটিশ, তারপর পশ্চিম পাকিস্তান লুটেছে বাংলার সম্পদ, তারপর স্বদেশি অর্থ পাচারকারীরা। এই পাচারকারী লুটেরাদের দমন শাসন করতে না পারলে পুরো জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে একদিন। এরা চোর— চোর শোনে না ধর্মের বাণী। এদের মুগুর হাতে দমন দরকার। এরা সুযোগ পেলে নব্য ইস্ট ইন্ডিয়া হয়ে দাঁড়াবে। আস্তে আস্তে সর্ব ক্ষেত্রেই এর খারাপ প্রভাব পড়তে থাকে। তখন সমাজের সুস্থ ধারাকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ হয়েছিল অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে। অর্থ কিছু মানুষের হাতে চলে যাবে যার সুবিধাভোগী হবে কিছু মানুষ, অন্যরা হবে বঞ্চিত শোষিত। অনৈতিক অর্থ লোপাটের সুযোগ দিয়ে বার বার কালো টাকার মালিক হওয়ার সুযোগ, সামাজিক নৈতিক ক্ষতিকেই ত্বরান্বিত করে। অথচ হওয়ার কথা ছিল বিপরীত। এই দুষ্ট দুর্বৃত্তদের কারণে দেশে সংকট তৈরি হয়েছে। অঘটন, দুর্ঘটনা ঘটেছে। ইতিহাস সাক্ষী। দুর্নীতিবাজদের কালো টাকা সাদা করার জন্য বারবার সুযোগ দিয়ে উৎসাহিত করা হলে ঐ পথেই হাঁটতে চাইবে সবাই। তখন অবস্থা দাঁড়াবে ভয়াবহ। অথচ সেটাই ঘটছে সব সরকারের আমলেই। যেটা স্বাধীনতার চেতনা আকাঙ্ক্ষাবিরোধী কাজ। এমনটা হলে স্বাধীনতার সুফলটা সাধারণ মানুষের ঘরে পৌঁছাবে কীভাবে?
আমরা লক্ষ্য করি ব্যাংক থেকে একজন কৃষক এক লাখ টাকা নিলে সে যদি নিয়মিত পরিশোধ করে। তো ৯ পার্সেন্ট হারে তাকে পাঁচ বছরের মুনাফা দিতে হয় ৪৫ হাজার টাকা। আর যদি কেউ সেই পরিমাণ টাকা নিয়ে পাঁচ বছরে এক টাকাও পরিশোধ না করে খেলাপি হয়, তাহলে তাকে দিতে হয় আসল এবং আসলের ২০% অর্থাৎ এক লাখ বিশ হাজার টাকা।এখানে যে সময়মতো পরিশোধ করল সে ২৫ হাজার টাকা বেশি দিল। হিসাব কিন্তু তাই বলছে। এক সময় এই হিসাবে নিয়মিত ঋণ গ্রহীতা খেলাপি হবে। কারণ সরল হিসাব সবাই বোঝে। অন্য বড় বড় ঋণের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। উপরন্ত আরও মারাত্মক হলো এক টাকার জামানত অতিরিক্ত ১০ টাকা মূল্য দেখিয়ে ৫ টাকা ঋণ নিতে পারলে সে তো আর টাকা ফেরত দেবে না। ব্যবসা বা উৎপাদনের নামে নবডংকা দেখিয়ে প্রণোদনা বাগিয়ে ঋণ পরিশোধ না করে খেলাপি হবে। ঋণ গ্রহীতা এক টাকার মাল দিয়ে যদি পাঁচ টাকা ঋণ পায় তো চার টাকা লাভ। লস হবে ব্যাংকের। জামানত বিক্রি করলে ঋণ পরিশোধ হবে না। এই ঋণখেলাপিরা ব্যাংকে অর্থ পরিশোধ না করে ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হয়। অর্থ পাচার করে, বিদেশে বউ-বাচ্চাদের জন্য বাড়ি কিনে রাজার হালে আছে অনেকেই। রাষ্ট্রের কাজ হবে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দেশের স্বার্থ রক্ষার্থে।
বড় বড় ব্যবসায়ী নানা অজুহাতে দাম বৃদ্ধি অথবা কম করে অতি মুনাফা করছে। এরা যখন কৃষক— বিক্রেতা কিনবে কম দামে, বিক্রিকালে বেশি দামে। সাধারণ বাজারে ঘাটে, দোকানে নগদ কাস্টমারের চেয়ে বাকি কাস্টমারের কদর বেশি। বাকি কাস্টমার হালখাতায় দাওয়াতপত্র পায়। নগদ যে সে দাওয়াত পায় না। হালখাতায় পহেলা বৈশাখে মিষ্টি, মণ্ডা তারপর দুই-চার হাজার টাকা রেয়াতও পায়। নগদ কাস্টমার এই দেখে দেখে সেও একদিন বাকি কাস্টমার হয়ে যায়। এই সংস্কৃতি মারাত্মক। এটা একটা বৈষম্য মন্দকে উৎসাহিত করা? ভালোকে নিরুৎসাহ করা।
অনৈতিক অর্থের দাপটে আজ সমাজে সর্বত্রই একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে। অনেকেই অনৈতিক অর্থ উপার্জন করে টাকা দেশ থেকে বিদেশে পাচার করছে এতে দেশের অর্থনীতি এবং উৎপাদন দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নানাভাবে কালো টাকা অর্জন অপরাধ যেমন অপরাধ, তদুপরি, পাচারের মতো আর একটা অপরাধ করার পরেও তাদের এই বার বিশেষ সুযোগ দেয়া হলো যে, তারা ১০% দিয়ে কালো টাকা বৈধ করতে পারবে বিনা প্রশ্নে। অথচ সৎ উপার্জনে কর বেশি। তাহলে যারা সৎভাবে উপার্জিত অর্থের মানুষ। সেই মানুষগুলোর প্রতি এটা একটা অবিচার করা হলো। এতে বরং সৎ উপার্জন করা মানুষটি হিসাব করবে যে, আমি অনৈতিকভাবে অর্থ উপার্জন করলে বরং আমি বিশেষ ছাড় পাব। তা হলে ব্যাপার দাঁড়াল অবৈধ অর্থ যে সমাজের অস্থিতির সৃষ্টি করে। অনৈতিকভাবে অর্জিত অর্থ অতি মুনাফা, মাদক, বাজার সেন্টিগ্রেড, ধর্ম রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি— সব ক্ষেত্রেই এর অস্থির অবস্থা তৈরি করে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রভাব পড়ে পুরো সমাজে। তাই অর্থনৈতিক সুস্থ ধারা আবশ্যক। বৈষম্য তৈরি করে দুর্জনের বিরুদ্ধে হোক অর্থনৈতিক নীতি—এটাই সবার কাম্য। যার সুফলভোগী হবে সমগ্র জাতি।
লেখক : কলামিস্ট
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ